আক্রান্ত: সাংবাদিকের উপর হামলার পর মিছিলে পা মিলিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা, আগরতলা, ৯ সেপ্টেম্বর। পিটিআই।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। মিডিয়াতে যে খবরগুলো উঠে আসছে, তার সারসংক্ষেপ করলে দেখা যায়, নৈরাজ্য নেমে এসেছে ত্রিপুরায়। আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের অভিমুখ বহুমুখী। পরিকল্পিত ভাবে সিপিএম পার্টি অফিস আক্রমণ করা হয়েছে। আগরতলার স্থানীয় সংবাদপত্র প্রতিবাদী কলাম এর অফিসে বিজেপি নেতা ও কর্মীরা ভাঙচুর চালিয়েছেন, চার জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ছবি ও ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়, যখন কাগজ, জরুরি নথিপত্র, কম্পিউটার এবং সিসিটিভি ক্যামেরাকে ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, বিরাট সংখ্যক পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ত্রিপুরার ইতিহাসে কোনও সংবাদপত্রের অফিসকে এ ভাবে আক্রমণ করা হয়নি। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, আক্রমণকারীরা সশস্ত্র হয়ে এসেছিল। শুধু লাঠি নয় বা অন্যান্য সূক্ষ্ম ধারালো অস্ত্র নয়, প্যান্টের পকেটে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র, কোমরে বাঁধা গামছার উপর থেকেও দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট।
এগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? মনে হয় না। মানিক সরকার দাবি করেছেন, তাঁকে অন্তত ১৫ বার নিজের কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বাধা দেওয়া হয়েছে। মফস্সল ও গ্রামে অবস্থা আরও শোচনীয়। এই প্রবন্ধ লেখার জন্য যোগাযোগ করেছিলাম বিভিন্ন শ্রেণি, জাতি ও পেশায় থাকা, রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে। অধিকাংশ মানুষই কথা বলতে চাননি। খানিক আশ্বস্ত করার পর বাকিরা স্পষ্ট বলেছেন, তাঁদের নাম যেন না লেখা হয়। দু’জন তাবড় রাজনৈতিক নেতা ফোন নামিয়ে রেখেছেন। সবাই যেন ভীত, আতঙ্কিত।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এই ক’দিন আগে এক ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার পঞ্চায়েত অঞ্চলে গিয়েছিলেন সরকারি লিস্ট নিয়ে। সেই লিস্টের নাম মিলিয়ে কাজ করা যাবে না বলে দাবি করে এলাকার মানুষ। উনিও নাছোড়। শেষ অবধি মারধর করে, জামাকাপড় ছিঁড়ে, ওঁর মোবাইল ছিনতাই করেছে কিছু মানুষ। পঞ্চায়েত স্তরে রাজনীতির এটাই দস্তুর এখন: যে কোনও বিরোধিতা দেখলেই আক্রমণ।
এই চরম অনিশ্চয়তার পরিস্থিতিতে ত্রিপুরায় নতুন করে গোল বেধেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে ঘিরে। কিছু দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু-সহ ১০ জনের প্রতিনিধি দল ত্রিপুরায় গিয়েছেন, স্থানীয় মানুষ ও নেতাদের মনে সাহস জোগাতে। রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অনেকটা সময় দিচ্ছেন ত্রিপুরায় সংগঠন আর দৃশ্যমানতা বাড়ানোর জন্য। প্রশান্ত কিশোরের টিমকে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ত্রিপুরায় দেখা গিয়েছে কয়েক বার।
হিংসা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম সফর থেকেই তাঁকে বাধা দেওয়া হয়েছে মিছিল বা সভা করতে, তাঁর কনভয়ের উপর আক্রমণ করা হয়েছে। অরুণচন্দ্র ভৌমিক প্রকাশ্যে বিজেপির পার্টি মেম্বারদের নির্দেশ দিয়েছেন, আগরতলা এয়ারপোর্টে তৃণমূল নেতাদের নামতে দেখা গেলে, ‘তালিবানি কায়দায়’ মোকাবিলা করতে। তৃণমূল যাতে সভা-সমাবেশ-মিছিল করতে না পারে, কোভিডের অজুহাতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
সঙ্কটের শুরুটা বোধ হয় ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে ত্রিপুরার নির্বাচনে ২৫ বছরের বাম শাসনের অবসানে, যখন ক্ষমতায় আসে বিজেপি। অপ্রত্যাশিত ছিল না সেই বিজয়। এক, সিপিএম আমলের শেষ দিকে জনসংযোগ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বামপন্থী নেতাদের অহঙ্কার আর ঔদ্ধত্য বিজেপিকে শক্তিশালী করেছিল। সে সময় মানুষের ভোট যতটা না ছিল বিজেপির সমর্থনে, তার থেকেও বেশি ছিল সিপিএমকে পরিহার করার মানসিকতা থেকে। মানুষের ক্ষোভকে বৈজ্ঞানিক ভাবে বিশ্লেষণ করেছিল বিজেপি, আই-টি সেলের সাহায্যে। ভোটার লিস্টের পৃষ্ঠা ধরে কৌশল নির্ধারণ করেছিল। বিজয়ের রথ কেউ আটকাতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা মোট ৪২ বার ত্রিপুরায় এসেছিলেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী, এক সপ্তাহের মধ্যে গিয়েছিলেন ৩ বার। প্রধানমন্ত্রী জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে সপ্তম বেতন কমিশন অনুসারে মাইনে পাবেন সরকারি কর্মচারীরা। সব স্তরে ৩০-৪০ হাজার টাকা মাইনে বেড়ে যাবে। ‘ফিক্সড পে’-র কর্মচারীদের পার্মানেন্ট করা হবে। ব্যাঙ্কে ১ ঘণ্টায় টাকা ঢুকে যাবে, মিসড কল দিলে চাকরি পাওয়া যাবে। যুবকদের স্মার্টফোন দেওয়া হবে। লোভ দেখানো হয়, এনরেগা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অন্য ভাতার পরিমাণ যেখানে ৭০০ টাকা ছিল, ২০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। বিজেপি স্বপ্নের জাল বুনেছিল, কেন্দ্রে-রাজ্যে এক সরকার থাকলে, কেন্দ্রীয় হারে সব সুবিধে পাওয়া যাবে।
তৃতীয়ত, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে অনেক বছর ধরে কাজ করছিল আরএসএস। তাদের সংগঠনকে বিশেষ আমল দেননি বামপন্থীরা। পাহাড়িরা অল্পে খুশি। রেশন, পানীয় জল, টাইম-কলের জল, ওষুধ, এলাকায় টিউবওয়েল, এই সব সুবিধে পঞ্চায়েতের থেকে পেতে চান। বিজেপি পাহাড়িদের বুঝিয়েছিল, সিপিএম তাঁদের এত দিন ঠকিয়েছে। পাহাড়ে টাকা বিলিয়েছে, আদিবাসীদের জাতিগত অস্তিত্বকে তুলে ধরে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। পাহাড়িদের বিভ্রান্ত করে বলেছে, আদিবাসীদের জন্য আলাদা রাজ্য হবে। সরল মানুষদের ম্যাপ দেখিয়েছে, এটা তোমাদের দেশ, ‘তিপ্রাল্যান্ড’। ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি)। সত্তাপরিচিতির রাজনীতি দিয়ে আদিবাসীদের মানসিক ভাবে আলাদা করে দিয়েছে।
৩ মার্চ, ২০১৮, সরকার তৈরির মাত্র তিন মাস পর থেকে পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদের মতো লোকাল বডি সব ভেঙে দিয়েছিল বিজেপি। ২০১৮ সালের পর কোনও বার মানুষ ভোট দিতে যেতে পারেননি। এই সাড়ে-তিন বছরে ত্রিপুরার উন্নতি ও অগ্রগতির স্বাভাবিক অভিমুখ ও গতি শ্লথ হয়েছে। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন বামপন্থীরা। মানিক সরকারের কেন্দ্র ধানপুরে দেড় বছর পর ঢুকতে পেরেছেন। সোনামুড়ার বক্সনগরে পাল্টা আক্রমণ হিসাবে বাইকবাহিনীর রাতে আগুন লাগানোর ভয়ানক ঘটনা উল্টে বামপন্থীদের কিছুটা অক্সিজেন দিয়েছে।
এই ডামাডোলের মধ্যে ‘টিপরাহ ইন্ডিজেনাস প্রগ্রেসিভ রিজিয়োনাল অ্যালায়েন্স’ বা ‘তিপ্রা মথা’র প্রধান প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য দেববর্মন, ত্রিপুরা রাজবংশের সন্তান হিসাবে নিজের দল তৈরি করেছেন। মুখে বলছেন, তাঁর ‘থানসা’ মানে ঐক্য চাই। কিন্তু বাস্তবে, রাজানুগত্যকে কাজে লাগিয়ে রাজপরিবারের সদস্যদের দিয়ে আদিবাসীদের মধ্যেও ফাটল ধরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ‘পুইলা জাতি’-র ধারণাকে তুলে ধরে অন্ধ রাজভক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এপ্রিলের অটোনমাস ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল (এডিসি) নির্বাচনে ২০টি আদিবাসী আসনে বিজেপি ও তার সহযোগী দল আইপিএফটি-কে হারিয়ে ‘তিপ্রা মথা’-র জয়লাভ বিজেপির আশঙ্কাকে বাড়িয়েছে। এঁদের দাবি ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’। ‘তিপ্রা মথা’ সুপ্রিমো অসম জাতীয় পরিষদ (এজেপি)-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন ইতিমধ্যেই। স্পষ্ট বলেছেন, কোনও মৌখিক প্রতিশ্রুতি নয়— যে দল তাঁদের ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ তৈরি করার সপক্ষে লিখিত পত্র দেবে, তাঁরা তাদের সমর্থন করবেন। এক দিকে তৃণমূলের সঙ্গে জোট বাঁধার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, আবার প্রয়োজনে কংগ্রেসের সমর্থন নিতেও পিছপা হবেন না, সেটা জানিয়েছেন।
২০২৩-এ ভোটে ত্রিপুরায় এক ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা। বামপন্থীদের মতে, ত্রিপুরায় মেরুকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে, তবু তাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। জাতীয় ও পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় দেখানো হচ্ছে, তৃণমূল না বিজেপি? মানুষ ভাববে, মিডিয়া যেমন বলছে, বিজেপিকে আটকাতে পারে শুধু তৃণমূল। যে কংগ্রেসিরা বিজেপি হয়েছিলেন, তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ক্ষমতায় আসার মতো অবস্থা তৈরি হলে হয়তো প্রকাশ্যে আসবেন। তৃণমূল ঠিক বিজেপির কায়দায় এগোচ্ছে, পার্টির সর্বভারতীয় চেহারার প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরার জন্য ত্রিপুরাকে ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসাবে বিবেচনা করছে। কিন্তু দলের আপাতত কোনও ঘোষিত মুখ বা নির্দিষ্ট ভাবমূর্তি নেই। হাতে মাত্র দেড় বছর। বিরোধী ভোট যদি ভাগ হয়, তা হলে কিন্তু বিজেপিরই লাভ। শোনা গেল, পুজোর পরে নাকি ত্রিপুরাতেও ‘খেলা হবে’।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার
মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy