প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে আমরা যদি স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারতের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-অবদানের হিসাব নিতে বসি, তো ঠিক কী দেখতে পাব? মনে হবে, প্রায় ৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজাল ছিন্ন করে এবং তারও আগের প্রায় এক শতাব্দীব্যাপী ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাস মনে রাখলে এ দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি এক নাটকীয় ঘটনা।
প্রায় দুই শতাব্দী জুড়ে দ্রুত অবক্ষয় এবং তার পরবর্তীকালে এক স্থবিরতাকে অতিক্রম করে ভারত আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, তা অনেকাংশেই শ্লাঘার বিষয়। ১৯৪৭ সালে যেখানে দেশবাসীর গড় আয়ু (এটি সর্বোৎকৃষ্ট মাপকাঠিগুলির একটি) ছিল ৩২ বছর, সে অবস্থান থেকে ভারত নতুন গতিশীলতাকে আত্মস্থ করে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তার স্বাধীনতাকে এক নতুন লক্ষ্যে স্থিত করে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতির প্রতি একনিষ্ঠ ভাবে আত্মনিয়োগ করে।
পশ্চিমী ভাষ্যকারদের বৈরী মতামত (যেমন, আমেরিকান সাংবাদিক এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ সেলিগ হ্যারিসন ১৯৬০ সালে বলেছিলেন, ভারতে পাকিস্তানের মতো সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা এই গণতন্ত্র খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়বে। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী এবং জাতিভেদমূলক মনোভাব দ্বারা পরিচালিত হয়ে উইনস্টন চার্চিল মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারত ভূমধ্যরেখার মতো এক জাতি-সমষ্টির বেশি কিছু নয়) সত্ত্বেও ভারত ঐক্যবদ্ধ ভাবেই টিকে থাকে এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক পরিসরে মুষ্টিমেয় গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম হিসেবে বিরাজমান থাকে। এগুলি নিঃসন্দেহে ভারতের কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, ভারত তার প্রতিশ্রুত নবযুগ আনতে পারেনি এবং বেশ কিছু দুর্ভাবনাময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাকে পার হতে হয়েছে এবং হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এ দেশ গত তিন দশকের মধ্যে বিশ্বের উন্নততর অর্থনীতির অন্যতম হিসাবে মাথা তুলতে সমর্থ হয়েছে। অনাগত ভবিষ্যতে যে ভারত বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে দ্রুততম গতিছন্দের অধিকারী হয়ে উঠবে, তা বলা যায়। চলতি বছরেই ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। অথচ এক দশক আগেও বিশ্বের প্রথম ১০টি অর্থনীতির তালিকায় এ দেশের নাম ছিল না।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকগুলিতে সঠিক বিন্দুতে অবস্থান করেও বার বার বিশ্ব রাজনীতিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষ অবলম্বন করে এসেছে। বিশ্ব মানচিত্রে এই দেশ এক ‘দুর্ভাবনা-মুক্ত’ অঞ্চল হিসবেই চিহ্নিত। পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশ হিসেবে ভারত এক স্থিতিশীল এবং অকপট অবস্থানে বিরাজ করে। দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অমীমাংসিত সঙ্ঘাতে রত হলেও বাকি গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে তার সম্পর্ক ইতিবাচক। পূর্বের ভৌগোলিক অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ভারত পোষণ করে না। সমস্যা তৈরি করার চাইতে তার সমাধানের প্রতিই এ দেশ বেশি আগ্রহী। যেমন পরিবেশ পরিবর্তনের সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ভারত সর্বদা ইতিবাচক উদ্যোগই দেখিয়ে এসেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদানের দিক থেকে দেখলে এ দেশ তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র হিসাবে অবস্থান করছে।
কিন্তু এ কথাও মানতে হবে যে, এই সব খতিয়ানের মধ্য বহু জোড়াতালি রয়েছে। ৭৫ বছরের দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে এবং এক উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি হাতে পেয়েও ভারত তিনটি প্রাথমিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় রেখেছে— ম্যাট্রিকুলেশন স্তর পর্যন্ত সর্বজনীন স্কুলশিক্ষা, সর্বজনীন ও সুষ্ঠু স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সকলের জন্য জীবিকার নিশ্চয়তা। আমেরিকান সাহিত্যিক, দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরুকে অনুসরণ করে বলা যায়, ভারতীয়রা এক বিপন্ন জীবনই যাপন করে চলেছেন।
এই প্রাথমিক ব্যর্থতাগুলির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আরও দু'টি বিষয়— জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু উপকরণের সর্বজনীন সরবরাহে ব্যর্থতা (যার মধ্যে বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং দূষণহীন পরিবেশও পড়ে) এবং অন্যটি যথাযথ আইনশৃঙ্খলা তথা বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রের দিকে নজর করলে দেখা যায় যে, এ দেশে কারাবন্দিদের সামগ্রিক সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ‘বিচারাধীন’ হিসেবে চিহ্নিত। এই ব্যর্থতাগুলির সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে ক্রমবর্ধমান পরিবেশদূষণ এবং সেই সঙ্গে কোনও স্থায়ী কৃষিব্যবস্থার অভাবের কারণে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান জলাভাব। এই ব্যর্থতাগুলি থেকে যাঁরা সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁরা অবশ্যই সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ। মূলত দলিত এবং আদিবাসী, পরিযায়ী এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। এক কথায় বলতে গেলে ‘ক্ষমতাহীন’রা।
সে দিক থেকে দেখলে ভারতীয় সমাজ এক সাম্য ও ন্যায়-রহিত সমাজ। এই সব ব্যর্থতাগুলি সর্বসমক্ষে স্বীকৃতয় কিন্তু (মূলত বিশদ বিশ্লেষণ এবং অনুধাবনের অভাবে) সেগুলি নিরাময়ে দ্রুত এবং ফলপ্রসূ পদক্ষেপ করা হয়ে ওঠে না। ক্রমপ্রসরণশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতি যে মনোযোগ দেওয়া হয়ে থাকে, তা আসলে এক প্রকার নজর ফিরিয়ে থাকা। কারণ, মধ্যবিত্তরা আদপেই ‘মধ্য’ অবস্থানে বিরাজ করে না। বরং তারাই সমাজের উচ্চবর্গীয় অংশের এক-চতুর্থাংশ এবং অন্য ভাবে দেখলে, তারা সমাজের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীদের অন্যতম। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাফল্যের কাহিনিগুলি আসলে উপরের স্তরের মানুষেরই সাফল্যগাথা। কিন্তু সে দিক থেকে তাকে ছোট করে দেখা হয় না।
ইতিমধ্যে যে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান এক নিরলঙ্কৃত গণতন্ত্রের কথা বলে (অর্থাৎ কি না নিয়মিত নির্বাচনে উঠে আসা জনগণের শাসন) এবং প্রশাসনের উপর ভিতর ও বাইরে থেকে চাপ প্রদান করা হচ্ছে, এমন এক ভঙ্গিমা প্রদর্শনকারী উদারপন্থী গণতন্ত্রের শক্তি প্রদর্শন করে, তারা যে অন্তরে-বাহিরে বছরের পর বছর ধরে অবক্ষয়িত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আইনসভার কার্যক্রম ক্ষীণ, বিচারালয়গুলির আচরণ অনিশ্চয়তায় পূর্ণ এবং স্থানীয় স্তরে সরকার অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু। এমনকি, রাষ্ট্রের সঙ্গে বাজারের সম্পর্কও সমস্যাদীর্ণ। রাষ্ট্র ও ব্যক্তিমানুষের মধ্যে সম্পর্কের কথা না বলাই ভাল।
আগামী ২৫ বছরে একটি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের উত্থানকে আরও অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী ভাবে স্বীকার করা যেত, যদি এই দেশ তার প্রাতিষ্ঠিনিক এবং নৈতিক ব্যর্থতাগুলির দিকে দৃষ্টি দিত, যদি অসাম্য এবং অন্যায় দূরীকরণে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখত। এ সব ঘটলে হয়ত জগৎসভায় চলতি শতকটি ‘ভারতের শতক’ হিসেবেই বিবেচিত হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy