পুজোর পরে স্কুল খুলবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ঘোষণাকে স্বাগত। করোনা অতিমারিতে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব পালন করেছে সরকার। এখন যথাসম্ভব সতর্কতার সঙ্গে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। এ বার ভাবা দরকার, দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, কী কী উপায়ে তা সামাল দেওয়া যায়। এই চ্যালেঞ্জ জয় করতে গেলে কয়েকটি কাজ করা যেতে পারে।
প্রথম কাজ হল, সিলেবাস শেষ করার উপর জোর না দিয়ে শিশুদের লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে পারার দক্ষতা তৈরি করা। যত দূর বোঝা যাচ্ছে, খুব বেশি শিশু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। বাড়িতে পাঠানো প্রশ্নের উত্তর লিখেও তারা সম্ভবত খুব বেশি কিছু শেখেনি। অনেকে লেখাপড়া থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন, যেটুকু শিখেছিল তা-ও ভুলে গিয়েছে। তাই আগেই শিক্ষকদের দেখতে হবে, ছাত্রছাত্রীরা কে কতটুকু লিখতে-পড়তে পারছে। তারা এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা বুঝে নিয়ে তাদের এমন ভাবে পড়াতে হবে, যাতে তারা নিজের শ্রেণির উপযুক্ত লেখা ও পড়ার ক্ষমতা আয়ত্ত করে।
এ ব্যাপারে ‘প্রথম’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির শিক্ষাপদ্ধতি বেশ কাজে লাগে, তা প্রমাণিত। এই সংস্থার কর্মীরা প্রথমেই একটি পরীক্ষার মাধ্যমে পড়ুয়ার ক্ষমতার ধাপ নির্ধারণ করে নেয় (যেমন, শিশুটি অক্ষর চেনে না, অথবা, অক্ষর চেনে কিন্তু শব্দ পড়তে পারে না, কিংবা শব্দ পড়তে পারে কিন্তু বাক্য পারে না)। তার পর একই ধাপের ছেলেমেয়েদের একটি দলে নিয়ে এসে, তাদের উপযোগী পাঠ পড়ায়। ওই শিশুরা বয়স অনুসারে স্কুলের নানা শ্রেণির পড়ুয়া হতে পারে, কিন্তু লেখাপড়ার পাঠ নেয় এক সঙ্গে। যে নিজের ধাপের দক্ষতা আয়ত্ত করে ফেলে, সে চলে যায় পরবর্তী দলে। দেখা গিয়েছে, এমন করে কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে প্রায় শ্রেণি-উপযোগী দক্ষতায় পৌঁছে যায় ছেলেমেয়েরা। দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে বহু পড়ুয়া সম্ভবত শ্রেণি-উপযোগী লিখতে-পড়তে পারার ক্ষমতা হারিয়েছে, তাই এখন এই পদ্ধতি বিশেষ কাজে লাগতে পারে। তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়াকে শুরু করতে হতে পারে প্রথম শ্রেণির পাঠ থেকে, পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াকে দ্বিতীয় থেকে। শ্রেণির সিলেবাস ধরে পড়াতে গেলে তার সুযোগ মিলবে না। প্রতিটি ছেলেমেয়ে লিখতে-পড়তে, অঙ্ক করতে পারার ক্ষমতা রপ্ত যাতে করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই স্কুলশিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার। যে কোনও সময়েই এটা সত্য, কিন্তু এখন এটা না করলেই নয়।
দ্বিতীয় কাজ হল, প্রতিটি শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এ বিষয়ে সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার একটা স্লোগান তৈরি করতে পারে, যা একশো শতাংশ শিশুকে স্কুলে ফেরানোর ডাক দেবে। একটিও শিশু যেন বাড়িতে, ফসলের খেতে, দোকান-বাজারে, কল-কারখানায় থেকে না যায়। বিশেষত স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের বাড়ির কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে স্কুলে। কাজটা সহজ হবে না, কারণ বহু পরিবার অতিমারির জেরে রোজগার হারিয়েছে। কাল যারা ছিল স্কুলপড়ুয়া, আজ তাদের কেউ মায়ের সঙ্গে লোকের বাড়িতে কাজে যাচ্ছে, কেউ বাবার দোকান সামলাচ্ছে, কেউ বাড়ি থেকে দূরে চলে গিয়েছে রোজগারের আশায়। কিন্তু এই শিশুদের হারিয়ে ফেলা চলবে না। অতিমারির কঠিন সময়ে কিছু শিশু তো স্কুলছুট হবেই: এমন মনোভাব দেখা দিলে তা হবে ভয়ঙ্কর— শিশুর জন্য, দেশের জন্যেও। প্রতিটি শিশুকে ফিরতে হবে স্কুলে, এই অঙ্গীকার হতে হবে শর্তহীন, সংশয়হীন। দারিদ্রের সঙ্গে দেশকে লড়াই করতে হলে দরিদ্রের শিশুকে স্কুলেই ফেরাতে হবে, কাজে পাঠানো চলবে না।
দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর সব শিশুকে যেমন ফিরিয়ে আনা চাই, তেমনই সব শিশুর নিয়মিত স্কুলে আসা নিশ্চিত করা চাই। মুশকিল হল, স্কুলের রেজিস্টার দেখে শিশুদের প্রকৃত উপস্থিতি সব সময়ে বোঝা যায় না। স্কুলে সব পড়ুয়াকে নিয়ে আসা, এবং তাদের নিয়মিত পঠন-পাঠনের অংশীদার করে তোলার জন্য দরকার স্কুলগুলির উপর নজরদারির একটা ব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিমবঙ্গে স্কুল পরিদর্শন ব্যবস্থা ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। বাম আমল থেকেই ইনস্পেক্টরদের ক্ষমতা কমেছে, শিক্ষক ইউনিয়ন শক্তিশালী হয়েছে। সেই সঙ্গে যথেষ্ট ইনস্পেক্টরও নেই। অথচ, এখন গ্রাম-শহরের প্রতিটি স্কুলে নজরদারি চাই। তাই অন্যান্য সমাজ সংগঠনকেও জড়িয়ে নিতে হবে। যে এনজিও-রা শিক্ষা-সহ বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ করছে, তাদের দায়িত্ব দিতে হবে, যাতে কোনও গ্রাম বা পুর-এলাকায় একটিও স্কুলছুট শিশু থেকে না যায়। বার বার সমীক্ষা করতে হবে। ‘চাইল্ডলাইন’ পরিষেবাকেও সক্রিয় করা যায়। নির্যাতিত শিশুর সঙ্গে স্কুলছুট শিশুর তথ্যও চাইল্ডলাইনে জানাতে উৎসাহিত করতে হবে সকলকে। স্কুলপড়ুয়াকে স্কুলের বাইরে রাখা যে অপরাধ, সেই দৃষ্টিভঙ্গি এখন সমাজে তৈরি করা দরকার।
এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে মেয়েদের স্বনির্ভর দলগুলি। এত দিন এই সব গোষ্ঠীর মেয়েরা স্কুলের সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রধানত মিড-ডে মিল প্রস্তুতির জন্য। স্কুল খোলার পরে অন্তত কয়েক মাস তাদের ভূমিকা আরও প্রসারিত করা যেতে পারে। নিজের গ্রামের প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে যেহেতু স্বনির্ভর দলের মেয়েদের পরিচয় রয়েছে, তাই স্কুলে না-যাওয়া শিশুদের সন্ধান পাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন নয়। স্কুলের সঙ্গে সংযোগ রেখে শিশুদের স্কুলমুখী করার কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলগুলিকে কিছু সাম্মানিক দেওয়ার কথাও ভাবতে পারে সরকার। সমাজকল্যাণ, পঞ্চায়েত, শিক্ষা, প্রভৃতি নানা দফতরের বিবিধ তহবিল থেকে ওই টাকা খরচ করা যেতে পারে। এতে শিশুদের স্কুলে ফেরানোর সামাজিক গুরুত্বের একটা ধারণা তৈরি হতে পারে। যে সব এলাকায় অনেক শিশু স্কুলছুট হয়েছে, স্থানীয় শিল্প বা বাজারে বহু শিশু কাজ করছে, সেখানে পঞ্চায়েত-পুরসভা, শ্রম, সমাজকল্যাণ, নারী ও শিশুকল্যাণ প্রভৃতি প্রশাসনিক দফতরগুলিকে সক্রিয় হতে হবে শিশুশ্রমিকদের স্কুলে ফেরাতে।
যদি সরকার ও সমাজের যৌথ প্রচেষ্টায় বাস্তবিক সব শিশুকে স্কুলে ফেরানোর চেষ্টা চলে, তা হলে হয়তো দেখা যাবে, অতিমারি-উত্তর বাংলায় আরও বেশি ছেলেমেয়ে নিয়মিত ক্লাস করছে স্কুলে। আগে যারা অলক্ষ্যে, অবহেলায় স্কুলছুট হত, বিশেষ নজরদারির ফলে তারাও এখন স্কুলে ফিরেছে। যে ছেলেমেয়েরা পড়া না পেরে সর্বদা লজ্জিত, সঙ্কুচিত হয়ে থাকত, তারা শ্রেণি-উপযোগী পাঠ দ্রুত রপ্ত করার ফলে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছে।
ইতিহাস বার বার দেখিয়েছে, কঠিন সময়কে কাজে লাগাতে অনেকটা এগিয়ে যায় মানুষ। অতিমারি তেমনই একটা সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের সামনে। এ সুযোগ সত্যিই কাজে লাগাতে পারলে হয়তো দেখা যাবে, আগামী বছরগুলিতে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। যে পাঁচ লক্ষ শিশু প্রতি বছর স্কুলের পাঠ শেষ হওয়ার আগেই ‘নিখোঁজ’ হয়ে যায়, তারা সবাই থেকে যাচ্ছে ক্লাসঘরে, স্কুলের শেষ পরীক্ষা অবধি। এখন পুজোর পরে স্কুল খোলার অপেক্ষা।
অর্থনীতি বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy