Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
‘প্রগতিশীল’রা যা বলেন না

ব্যক্তিস্বাধীনতার ছলে পিছিয়ে পড়া মানসিকতার তোষণ

হিজাব কারও আত্ম-অভিব্যক্তির রূপ হতে পারে, তবুও স্কুলের মেয়েরা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিণতমনস্ক নয়। তাদের হিজাব সম্পূর্ণত চাপিয়ে দেওয়া।

স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২২ ০৫:১৪
Share: Save:

আমাদের ছোটবেলায় অনেক বাঙালি বাড়িতেই নিয়ম ছিল যে, হিন্দি গান শোনা যাবে না। রেডিয়োতে ‘বিবিধ ভারতী’ চালানো একেবারে অপরাধের পর্যায়ে ছিল। লুকিয়ে হিন্দি গান শুনে ধরা পড়লে দুর্ভোগ ছিল বেশ। তখন বাড়িতে নিয়ম করে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি শুনতে হত, আর বড়জোর বাংলা আধুনিক গানের অনুরোধের আসর। এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয় অনেকেরই আছে। এখন বুঝতে পারি, ছোটবেলায় এর মাধ্যমে আমাদের মধ্যে কিছু বাঙালিসুলভ মূল্যবোধ, কিছু অভ্যাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা হয়তো কাম্য ছিল। তখন, সেই স্কুলপড়ুয়া-বেলায় যদি আমরা বলতাম যে, ‘বিবিধ ভারতী’-তে হিন্দি গান শোনা আমাদের ‘চয়েস’— আমাদের চয়নের অধিকার— নির্ঘাত কানমলা খেতে হত। এই অধিকার আমাদের ছিল না। ভাগ্যিস!

অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে ‘চয়েস’ নিয়ে খানিক ধারণা আছে। সেই সূত্র ধরে বলি, শুধু নাবালক অবস্থায় নয়, সমস্ত বয়সেই চয়নের অধিকারের একটা সীমা থাকে। আমার কোনও পছন্দ বা কোনও কাজ যদি সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বা সঠিক বার্তা বহন না করে, তা হলে সেই ‘চয়েস’ বা সেই কাজটি কাম্য নয়। অর্থশাস্ত্রে একে নেগেটিভ এক্সটার্নালিটি বা নেতিবাচক অতিক্রিয়া বলা হয়— আমার পছন্দ, তাই রাতদুপুরে গাঁকগাঁক করে লাউডস্পিকার বাজাব, তা করা যায় না। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তির ‘স্বাধীনতা’ একটু খর্ব করাই বিধেয়। কত দূর, সেটা ঘটনার উপর নির্ভর করে। কেউ যদি বলেন যে, করোনা সারানোর জন্য আমি গোমূত্র পান করছি, তা হলে তাঁকে তিরস্কার করা উচিত। কিন্তু কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি যদি করোনার প্রতিষেধক হিসাবে গোমূত্র বিক্রি করেন, তাঁকে গ্রেফতারও করা যায়।

হিজাব পরার প্রথাটির মধ্যে যে রক্ষণশীলতা, পশ্চাৎমুখিতা আছে, কোনও উদারপন্থী সমাজই সেই কথাটা অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু, তার মধ্যে নেতিবাচক অতিক্রিয়া আছে কি? না থাকলে, কোনও ব্যক্তিবিশেষ যদি রক্ষণশীল হতে চান, পিছিয়ে থাকতে চান, তাতে আমরা দুঃখ পেতে পারি, কিন্তু আপত্তি করতে পারি না। আমি বলব, হিজাব পরার মধ্যে নেতিবাচক অতিক্রিয়া আছে। যত বেশি সংখ্যক মেয়ে হিজাব পরবেন, ততই তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, এবং অন্যদের উপর ততই চাপ তৈরি হবে এই প্রথা অনুসরণ করার জন্য। যাঁরা হিজাবে বিশ্বাস করেন না, প্রগতির পথে অগ্রসর হতে চান, তাঁরাও ক্রমে বাধ্য হবেন মাথা ঢাকতে। এই চাপ প্রতিহত করা ব্যক্তির পক্ষে কঠিন— এবং, সেই কারণেই সমাজের অধিকার এবং দায়িত্ব এই প্রথার প্রতিবাদ করা।

একুশ শতকে আমরা কেন হিজাব বা ঘোমটা নিয়ে মাথা ঘামাব, সেটা বোঝা সত্যিই দুষ্কর। হিজাবে মাথা ঢাকা, বা লম্বা ঘোমটা দেওয়া কারও অধিকার হতেই পারে, কিন্তু এটা যদি উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে সেটি চিন্তার বিষয়। যে দেশে তসনিম মির মেয়েদের অনূর্ধ্ব উনিশ ব্যাডমিন্টনে বিশ্বের এক নম্বর হয়ে এখন সিনিয়রদের খেলায় বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছেন, সে দেশের মুসলমান মেয়েরা কেন মাথা ঢাকা নিয়ে মাথা ঘামাবে? কেন তারা তসনিমকে আদর্শ করবে না? বিগত দু’বছরে স্কুল ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা নিয়ে তো এদের কোনও মাথাব্যথা দেখলাম না?

যারা হিজাব পরছে, সেই মেয়েদের চেয়ে— যারা তাদের হিজাব পরতে বাধ্য করছে, সেই সমাজের চেয়েও— ভয়ঙ্কর হলেন সেই তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা মাথা ঢাকার আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করেন ধর্মাচরণের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে। তাঁদের নিজেদের সন্তানরা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, প্রগতির সমস্ত সুফল পূর্ণমাত্রায় আহরণ করবে, কিন্তু অন্য একটি শ্রেণির মেয়েরা মাথা-মুখ ঢেকে থাকবে, কারণ এটা তাদের স্বাধীনতার ব্যাপার! পুরনো, পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষকে অনুপ্রাণিত না করে সেগুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকাটাই যে ‘স্বাধীনতা’— এমন একটি ন্যারেটিভ তৈরি করতে তাঁরা ব্যস্ত।

কেন, সেই কারণটা হয়তো আমরা সবাই জানি বা বুঝি। কিন্তু কেন আমাদের জীবনের সমস্ত আঙ্গিকে রাজনীতি বা রাজনৈতিক ধ্যানধারণা প্রভাব ফেলবে, কেন আমরা বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে ‘ঠিক’-কে ঠিক, ‘ভুল’-কে ভুল বলতে পারব না— তা নিয়ে গভীরে ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে। পর্দার মতো পশ্চাৎপদ এবং অপমানজনক প্রথা খুব কমই আছে, এবং এটি সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রে সত্য। মাথা-মুখ ঢেকে থাকাটা কোনও দিন কারও আত্মপরিচিতির অভিব্যক্তি হতে পারে না। এ রকম প্রথা থেকে মানুষকে বার করে আনাটাই প্রগতি। ঠিক যেমন গোবর আর গোমূত্রের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরোনো প্রয়োজন, সেই রকম এই জাতীয় অভিব্যক্তি থেকেও মুক্ত হওয়া, সমাজকে মুক্ত করা আমাদের অবশ্যকর্তব্য। স্কুলের মেয়েদের হিজাব পরার প্রতিবাদ করা জরুরি, কারণ যদি ধরেও নিই যে, হিজাব কারও আত্ম-অভিব্যক্তির রূপ হতে পারে, তবুও স্কুলের মেয়েরা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিণতমনস্ক নয়। তাদের হিজাব সম্পূর্ণত চাপিয়ে দেওয়া।

আসলে, যুবসামাজকে সদর্থক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বা সঠিক দিকনির্দেশ দেওয়া কঠিন কাজ। তার জন্য শিক্ষা প্রয়োজন, পরিশ্রম প্রয়োজন, সাহস প্রয়োজন। নতুন কিছু ভাবার ক্ষমতা থাকা দরকার। কিন্তু ‘থোড় বড়ি খাড়া’ করে যদি জীবনের আখেরটা গোছানো যায়, তা হলে ক্ষতি কি? সমাজের ভাল করে কী হবে? আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে, অন্যের সন্তান যেন মাথা ঢেকে থাকে। কিন্তু এটা আমাদের গড়ার সময়, আধুনিক চিন্তাধারা নিয়ে এগোনোর সময়। আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের খুব বড় সরাসরি সম্পর্ক আছে। তাই ভাবনা-চিন্তার পশ্চাৎপদতা আমাদের অর্থনৈতিক ভাবেও পিছিয়ে দিতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ গুরুজনের ভূমিকা নেওয়া উচিত, ঠিক যেমন আমাদের মা-বাবারা করেছেন। বলা উচিত, আগে লেখাপড়াটা ঠিকঠাক করো, পোশাক নিয়ে পরে ভাববে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম পরলে, ড্রেস কোডের মতো অনুশাসন মানলে স্বাধীনতা খর্ব হয় না, ক্ষতিও কিছু হয় না। ভবিষ্যৎ ভাল হলে অনেক বড় ‘চয়েস’, অনেক উচ্চমানের স্বাধীনতা অপেক্ষা করছে। সম্ভব হলে তসনিম মির হওয়ার চেষ্টা করো, আর সবাইকে ঠিক ভাবে অনুপ্রাণিত করো।

পাঠক, ভেবে দেখুন তো, পরিচিত প্রগতিশীলদের মুখে এই কথাগুলো গত এক মাসে ঠিক কত বার শুনেছেন?

অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy