মা গো, তোমার কাছে কি কিছু টাকা আছে? তোমাকে তো টাকা জমাতে বলেছিলাম।” উত্তর আসে, “হ্যাঁ দিদি, তোমার কথাটা তো আমার মনে আছে।” যিনি উত্তর দেন, সেই তরুণী আসন্নপ্রসবা।
“...গর্ভাবস্থায় আমরা প্রত্যেক মাকে বলি যে, একটা করে বোকা ভাঁড় রাখবে, ওই বোকা ভাঁড়ের মধ্যে একটু একটু করে টাকা ফেলবে। সরকারি ব্যবস্থা তো আমাদের আছেই, যদি সেই সময়ে না পাওয়া যায় তোমাকে ওই টাকাটা দিয়ে ব্যবস্থা করে হাসপাতালে পৌঁছতে হবে।”— কী ভাবে সঞ্চয় করতে হবে, সে বিষয়ে পেশাদার পরামর্শদাতার কথা এগুলি নয়। হাওড়ার চড়াপাঁচড়া গ্রামের আসন্নপ্রসবাদের এই পরামর্শ দিচ্ছেন এক কর্মজীবী মানুষ, আরজিনা খাতুন। রোজা রেখে ‘ক্ষীণ’ হয়ে আসা শরীর নিয়েও সঙ্কটের শেষতক তিনি সঙ্গত্যাগও করছেন না প্রসবযন্ত্রণায় কাতর মায়ের। এই বিপর্যস্ত সময়ে আরজিনার সঙ্গে ছিল না সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স ‘মাতৃযান’। পাওয়া যায়নি আঞ্চলিক সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের নিঃশর্ত সহায়তা। আরজিনা এক জন আশাকর্মী। গ্রামের নানা ঘরে ঘুরে ঘুরে সুস্বাস্থ্যের দিকটি খেয়াল রাখাই ওঁর পেশার লিখিতপড়িত কর্তব্য। অথচ, গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের দিনে মায়ের মুখোমুখি যদি কোনও ঘোর সঙ্কট এসে দাঁড়ায়, কেমন করে মা নিজের সঞ্চয়ের বলে তার মোকাবিলা করবেন, সেই সমাধানের কথাও নিয়ম করে বলে রাখেন তাঁরা।
এই কথাগুলি শোনা গিয়েছিল গত ১৮ জুলাই প্রতীচী ইনস্টিটিউট, প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্টের উদ্যোগে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রসারিত ‘সহযোগ’ মঞ্চের সূচনা অনুষ্ঠানে। ওই দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আড়াইশো জনেরও বেশি মানুষ। স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, পরিবেশকর্মী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে কাজে যুক্ত মানুষ, প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষা-গবেষক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীদের মতো বিবিধ কাজে যুক্ত এই যোগদানকারীদের কাছে প্রতীচী ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আবেদন করা হল ‘সহযোগ’-এর সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে যুক্ত থাকার জন্য।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত বক্তা এবং অন্য বক্তাদের কথায় এই বোঝাপড়ায় পৌঁছনো গেল যে— অতিমারির যে অসময় আমরা পেরোচ্ছি, তাতে সমাজের প্রত্যেক সদস্য যদি নিজেদের নির্ধারিত, এমনকি অনির্ধারিত কাজের সূত্রে নিত্যসম্বন্ধ থাকতে পারি, তা হলে এই বিপুল সঙ্কটকেও প্রচ্ছন্ন করে দিয়ে প্রকট হতে পারে সম্ভাবনার বাস্তবতা। এই মঞ্চের যোগদানকারীদের দ্বারা সংগঠিত নানা গবেষণা ও প্রতিবিধানমূলক কাজের আলোচনায় পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের যে সেতু তৈরি হবে, তার সাহায্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য, মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির জোগানকে সুনিশ্চিত করা, স্কুলছুট, স্কুলে অনুপস্থিতির সমস্যা, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহের মতো সমস্যাগুলির নিষ্পত্তি, গণঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে পরিবেশ বিষয়ক সঙ্কটমুক্তি, আদিবাসী মানুষদের বিশেষ প্রয়োজন ও অধিকার, শিক্ষাক্ষেত্র-সহ সর্বত্র বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের মর্যাদা, লিঙ্গবৈষম্য বা সার্বিক ভাবে বৈষম্য সম্পর্কে সচেতনতায় ঘাটতি পূরণ করার কাজ করা অনেকাংশে সহজ ও সম্ভব হবে। এই ব্যাপ্ত যোগাযোগের পরিসরের সাহায্যে পরস্পরকে নানা সামুদায়িক উদ্যোগমূলক কাজে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানোর সুযোগ বাড়বে।
বিপন্ন সময়কাল আমাদের বোঝাল যে, সঙ্কটকালে কঠোর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক বিধিরীতি দিয়ে মানুষের কর্তব্যবোধকে বেঁধে রাখা চলে না। এমনকি সংগ্রামের এই সময়ে কেবল ভৌগোলিক পরিচিতি, পেশাগত পরিচিতি, লিঙ্গগত পরিচিতি, বা যে কোনও সামাজিক গোষ্ঠীগত পরিচিতির গৌরবেও মগ্ন থাকা চলে না। নিজের চিরকালীন পোশাক বদলে গায়ে দিতে হতে পারে একেবারে ভিন্ন কাজের মানুষের পোশাক। কথা বলতে হতে পারে সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনও মানুষের স্বার্থে। এই দেড় বছরের পর্বে প্রতীচীর এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে, যেখানে শিক্ষক স্কুলে নির্ধারিত কাজ ছাড়াও আসছেন বাচ্চাদের পরিবারের জন্য খাদ্যদ্রব্য, বা স্বাস্থ্য-কিট জোগাড়ের সন্ধান পেয়ে— বণ্টন করছেন নিজ নিজ উদ্যোগে; কখনও বা অভিভাবকদের জন্য আয়োজন করছেন স্বাস্থ্য-সচেতনতা শিবির; সমীক্ষা করে ডেটাবেস বানিয়ে রাখছেন বাচ্চাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার; বাচ্চার পরিবারের কত জন প্রতিষেধক নিলেন সে ব্যাপারে হিসাব রাখছেন, সতর্ক করছেন নিয়ম করে।
সহযোগের সূচনা অনুষ্ঠানে জানা গেল যে, বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক বেনজির সুলতানা ও সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীরা পরিকল্পনা করছেন স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় অঞ্চলের বাচ্চাদের সঙ্গে প্রত্যেক দিন কিছু সময় বসার— লেখাপড়ার কাজটা কী ভাবে এগোনো যায়, তা দেখার। একই ভাবে নিজের গ্রামের বাচ্চাদের লেখাপড়ায় সাহায্য করতে উদ্যোগ করছে হিঙ্গলগঞ্জের সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা পরিবেশকর্মী অঙ্কিতা মণ্ডল। অবিরাম ভূমিকা বদল— চিকিৎসক বা পরিবেশকর্মী স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিচ্ছেন শিক্ষা সহায়কের।
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় প্রকোপ ছাড়াও অতিমারির সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের মতো বেঁচে থাকার অপরিহার্য ও বুনিয়াদি দরকারগুলির প্রশ্নে সরকারি ভূমিকাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকেনি। দীর্ঘ দেড় বছর সময়কালে শিক্ষা প্রসঙ্গে ন্যূনতম অর্থবহ বন্দোবস্তও চোখে পড়েনি, স্কুল স্তরে মিড-ডে মিলের খাদ্যসামগ্রীতে দুশ্চিন্তাজনক রকমের ফাঁকি দেখা গিয়েছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে মিড-ডে মিলের উপায় বন্ধ হয়ে আছে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এএনএম বা আশাকর্মীদের কষ্টসাধ্য কাজে অপর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য। বিপন্ন মানুষকে মেনে নিতে হয়েছে সব। যাঁদের সব কিছু কিনে ফেলার সুযোগ নেই, যাঁদের কাছে সরকারি ব্যবস্থাই নির্বিকল্প— তাঁদের পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এই সময়কাল। এ দফায় বোঝা গিয়েছে যে,
সমাজের বিভিন্ন মানুষের সংহতির বোধ না থাকলে, স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ না থাকলে, এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আমাদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকাটুকুও হয়ে উঠত না। সেই সেতুটুকুই বেঁধে চলা এই মুহূর্তে প্রধানতম কাজ।
নির্দিষ্ট পেশায় নিযুক্ত নানা মানুষের নির্ধারিত কাজগুলির মধ্যেকার আড়াল সরানোর, এবং তাদের সংযুক্ত করার প্রয়োজন যে কতখানি, তা অতিমারি প্রত্যেক মুহূর্তে দেখিয়ে চলেছে। প্রতি দিন বোঝা যাচ্ছে, যে কোনও উপায়ে নিজের সঙ্গে সঙ্গে সহবাসীকেও সঙ্কটমুক্ত করার কাজে মানুষ জুড়ে যাবেই। কখনও প্রতিবর্তে, কখনও বা পরিকল্পনা করে। এ জন্যই মানুষ তার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনকে সুষ্ঠু সামাজিক জীবনের চেহারা দিতে পেরেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy