ওয়াশিংটনের মতে, বিশ্বে হানা দিয়েছে এক নতুন ভূত: ভ্লাদিমির পুতিন। অসহায় ইউক্রেনের উপর যিনি নিজের সেনাবাহিনী নামিয়ে দিয়েছেন। রাজধানী কিভেও বোমা ফেলার হুমকি দিয়েছেন। বিশ্বব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি এখন বিপন্ন, এবং পশ্চিম তা ঠেকাতে দৃঢ়সঙ্কল্প। অন্তত গল্পটা তেমনই শোনা যাচ্ছে।
ইউক্রেনে তা হলে ঠিক কী ঘটছে? দ্বন্দ্বের সামনের সারিতে রয়েছে সে দেশের দু’টি অঞ্চল: লুহানস্ক ও ডনেৎস্ক ওব্লাস্ত বা প্রদেশ, যাদের এক সঙ্গে ডনবাস বলা হয়। যেখানে রুশ জাতির মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ, ইউক্রেন থেকে তাঁরা আলাদা হতে চান। এই সব এলাকায় গত আট বছর ধরে সংঘর্ষ চলছে, মারা গিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এই দুই অঞ্চলকে— লুহানস্ক গণপ্রজাতন্ত্র ও ডনেৎস্ক গণপ্রজাতন্ত্র— ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করেই এই দ্বন্দ্বে পা দিয়েছেন পুতিন। তাদের সঙ্গে মিত্রতার চুক্তি করেছেন, সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তাদের সাহায্যের আর্তিতে সাড়া দিয়ে ডনবাসে সেনা পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার সকালে ঘোষণা করেছেন, ডনবাসে ‘ক্রমবর্ধমান ইউক্রেনীয় আগ্রাসন’-এর প্রতিক্রিয়ায় ‘আমি এক বিশেষ সেনা অভিযান চালানোর কথা ভেবেছি’। এই অঞ্চলগুলিতে ইউক্রেনীয় সেনার সম্ভাব্য অভিযান প্রতিরোধে সে দেশের সীমান্তে যে রুশ বাহিনী জড়ো করা হয়েছিল, তাদেরই এ বার এলাকা ‘রক্ষা’য় পাঠানো হয়েছে। রুশ নেতা সফল ভাবে ইউক্রেনকে ভাগ করে ফেলেছেন। এতেই চটেছে ওয়াশিংটন।
এর প্রতিক্রিয়ায় জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইউক্রেন, যাতে নাগরিকরা অস্ত্র ধরতে পারেন। রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে রাষ্ট্রপুঞ্জেও আবেদন জানিয়েছে তারা। কিছু দিন আগেও সেনা সংঘাতের কথা উড়িয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি বলেছিলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনও বড় মাপের যুদ্ধ হতে পারে না। রুশ ফেডারেশনের দিক থেকেও বড় উত্তেজনা তৈরি হবে না।” কিন্তু বৃহস্পতিবার যখন ডনবাসের চার পাশে নানা জায়গা থেকে বিস্ফোরণের খবর আসতে শুরু করল, তখনই বোঝা গেল যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু এক দল অখুশি রুশকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে, ব্যাপারটা এতখানি সহজ নয়। এখানে তিন রকমের বিষয় রয়েছে। প্রথমটা নীতিকেন্দ্রিক— পরিস্থিতির দাবির কথা বলে রাশিয়া যে ভাবে গায়ের জোরে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তা কি গ্রহণযোগ্য? ভারতের মতো স্থিতাবস্থায় বিশ্বাসী হলে বলপূর্বক সীমান্ত পাল্টে দেওয়ার ঘটনা নিন্দনীয় মনে করতেই হয়— বিশেষত তার দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চিন ও পাকিস্তান যখন বহু দশক ধরে সেই চেষ্টাই করে চলেছে। খেদের কথা, জাতিগোষ্ঠীর প্রশ্ন কখনওই ক্ষমতাবানকে নিরস্ত করে না, ইতিহাসের গতিপথও নির্ধারণ করে না। এ ক্ষেত্রে রাশিয়াও অন্য রকম কিছু নয়, অর্থাৎ পশ্চিমি শক্তিগুলো যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে তা যথাযথ নয়। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে পশ্চিমও কিন্তু আন্তর্জাতিক সীমান্ত পাল্টে দিয়েছে, সার্বভৌম রাষ্ট্র দখল করেছে, একাধিক দেশ ভেঙেছে। আফ্রিকার অধিকাংশ এবং এশিয়ার অনেকাংশ তাদের বিপজ্জনক ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ প্রক্রিয়ার ফল। ভারতও এই সাম্রাজ্যবাদী শল্যছুরিকার শিকার হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমের হাতে বড় মাপের পুনঃসজ্জার শিকার হয়েছে পূর্বতন যুগোস্লাভিয়া। তাদেরই সমর্থনে সে দেশের ‘বলকানাইজ়েশন’ হয়েছে, আর ক্ষুব্ধ অসহায় রাশিয়াকে তা বসে বসে দেখতে হয়েছে। একেবারে হিসাব করে টুকরো করা হয়েছে যুগোস্লাভিয়াকে। সার্ব-রা যখন প্রতিবাদ করেছে, তখন এই বিভাজন-প্রক্রিয়া মসৃণ করতে এসে পড়েছে নেটো।
বস্তুত মস্কো যখন বলে যে, রাশিয়ার বড় অংশকে ভুল ভাবে ইউক্রেন রাষ্ট্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন সে দাবি খুবই চিনের মতো শোনায়। চিনও তো বলে, তাইওয়ান অরুণাচল লাদাখ ও অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে, তা কখনওই একক নয়, সপক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণও উপস্থিত। শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা হল, কোনও দেশ কি একটা বিপজ্জনক কাজ করার পর তার পরিণতি এড়িয়ে যেতে পারে? সেখান থেকেই দ্বিতীয় প্রশ্ন ওঠে: কিভের ক্ষমতাসঙ্কট নিয়ে ঠিক কেন এতখানি উত্তেজিত পশ্চিম, বিশেষত ওয়াশিংটন? সিরিয়া যখন ইসলামি যোদ্ধাদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছিল, যখন সেখানকার নাগরিকদের বিরুদ্ধে জঘন্য অত্যাচার ঘটছিল, এবং প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সাহায্য চাইছিলেন, তখন তো এতখানি চিন্তিত দেখায়নি তাদের! তুরস্ক যখন কুর্দিশ অঞ্চল আক্রমণ করে কুর্দদের একেবারে খতম করে দিতে উদ্যত হয়েছিল, তখনও তো তার মিত্র দেশকে কোনও কড়া কথা বলেনি ওয়াশিংটন! এই তালিকা দীর্ঘ করাই যায়। তা হলে কিভের প্রতি পশ্চিমের এই উদ্বাহু সংহতি কেন?
এর উত্তর নিহিত ইতিহাসে। ঠান্ডা যুদ্ধ আসলে ঠিক কখনওই শেষ হয়নি, সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন ঘটলেও রাশিয়ার সঙ্গে শত্রুতার অন্ত ঘটেনি। রাশিয়ার বিপুল পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার, তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং কলহপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আমেরিকার অনেকেই স্থায়ী প্রতিপক্ষ বলে মনে করেন।
সাম্প্রতিক কালে একাধিক জায়গায় আমেরিকাকে রুখে দিয়েছে রাশিয়া। ইরাক ও লিবিয়ায় জমানা বদল ঘটলেও সিরিয়ায় যে তা হতে পারেনি, তার পিছনে একমাত্র কারণ রুশ সেনার উপস্থিতি, আল-আসাদের সরকারকে রক্ষা করতে তাদের যুদ্ধবিমানের আবির্ভাব। মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলিতেও ওয়াশিংটনকে সফল ভাবে আটকে দিয়েছে মস্কো। সম্প্রতি পশ্চিমি শক্তিগুলির সঙ্গে তাদের সংঘাতে চিনের সঙ্গে জোট বেঁধেছে তারা। রাশিয়ার শক্তি সরবরাহের উপর ইউরোপের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা নিয়েও চিন্তিত ওয়াশিংটন। জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস দ্বিগুণ পরিমাণে পৌঁছে দিতে বল্টিক সাগরে যে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প তৈরি হয়েছে, ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে তার নিন্দা করায় সেই প্রকল্প এখন বিতর্কের মুখে। এই ১১ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার প্রকল্পের কাজ গত বছর শেষ হলেও, আমেরিকার আপত্তি ও ইউরোপের দ্বিধায় এখনও তা চালু হয়ে ওঠেনি। এখন জার্মানি জানাচ্ছে, ইউক্রেনে রুশ কার্যকলাপের ফলেই তারা বাধ্য হয়ে এই প্রকল্প বাতিল করছে। যদিও, তা সম্ভবত সাময়িক।
বৃহত্তর ছবিটা হল, ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। প্রেসিডেন্ট পুতিন কোনও গণতন্ত্রের আদর্শ নন, তবে নিজের দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কেউ তাঁকে দোষ দিতে পারবেন না। বাস্তব হল, ওয়াশিংটন যে রাশিয়াকে এখনও সম্পূর্ণ মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারেনি তার কারণ হলেন পুতিন, পশ্চিমে যাঁকে বলে ফ্যাসিস্ট, উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদী, এবং ভূ-রাজনীতির পক্ষে হঠাৎই বিপজ্জনক হয়ে ওঠা এক নেতা। পুতিন তাঁর নিজের বিশ্বে সেটাই করার চেষ্টা করছেন পশ্চিমি শক্তিগুলো যা করে থাকে তাদের অঞ্চলে— নিজের প্রভাববৃত্তে প্রভুত্ব করা, ও তার সংজ্ঞা বেঁধে দেওয়া। এক লেখক যেমন বলেছেন, অতলান্তিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ‘আমেরিকান হ্রদ’ বানিয়ে ফেলার জন্য, অথবা আমেরিকা ও ইউরোপে নিজের স্বার্থরক্ষা করার কারণে আমেরিকার প্রতি কিন্তু কোনও ক্ষোভ প্রকাশ করেনি রাশিয়া। অন্য দিকে, নেটো ক্রমাগত পূর্ব অভিমুখে এগিয়েছে, রাশিয়ার প্রভাববৃত্তকে ছোট করে এনেছে। ইউক্রেনে এসে অবশেষে আপত্তি করেছেন পুতিন, এবং তাঁর প্রভাবাধীন প্রধান অঞ্চলগুলিতে পশ্চিমি অগ্রগমনের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ইউক্রেনকেও তিনি নেটোয় যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। সে কাজ ঠিক হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন দার্শনিক।
প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির পিছনে অন্যতম মস্তিষ্ক, প্রয়াত নোবেলজয়ী পদার্থবিদ জোসেফ রটব্লাট এক বার বলেছিলেন, “ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের চিন্তা থেকেই গিয়েছে। তখন আমরা শুনেছিলাম যে, পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারই নাকি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা প্রশমিত করতে পারে। আর এখন বলা হচ্ছে, পারমাণবিক অস্ত্র সব রকমের যুদ্ধই থামিয়ে দেয়।” সাতাশ বছর আগের এই মন্তব্যের পরে পৃথিবী খুব বেশি বদলায়নি। সেই বিগত যুগের বাধ্যবাধকতাই এখনও বিশ্ব শাসন করে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy