শীতের দুপুরে শিশুদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। বছর পাঁচেকের শিশু আনমনে এঁকে চলেছে সমুদ্রের নীল, তার উপর পেল্লায় এক জাহাজ। অপটু কচি হাত কালো রং বুলোয় জাহাজের চিমনির মাথায়। ওটা ধোঁয়া। তার পর হঠাৎ কী ভেবে যেন জাহাজের পাশে এঁকে ফেলে একখানা ছাই রঙের বেড়াল। “বেড়াল কেন আঁকলি? বেড়াল কি সমুদ্রে থাকে?” “থাকে না, কিন্তু ওর তো তখন জল তেষ্টা পেয়েছিল।” বিচারকরা কি আর এমন উদ্ভট কল্পনাকে প্রশ্রয় দেন? ফলে, একখানি সান্ত্বনা পুরস্কারও জুটল না তার।
এই হল শিশুমন। সে মন একরঙা নয়, পুরস্কারলোভীও নয়। সে মন অনায়াসে ছুটে বেড়ায় কল্পনার গলিঘুঁজিতে। সব সময়ই নিজের যুক্তি সাজায়। নিজের জগৎ গড়ে তোলে। বড়দের অতি পরিপক্ব মন, পরিণত বুদ্ধি তল পায় না তার। সমস্যা হল, এখনকার শিশুরা সেই রঙিন জগৎ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের কল্পনার পরিসরটুকু, যা এক সময় বড় হয়ে ওঠার এক অতি আবশ্যক শর্ত বলেই মনে করা হত। শিশুমাত্রেই নানা রকম আকাশকুসুম কল্পনা করবে, আজগুবি প্রশ্ন করবে— সেই সত্য অভিভাবকরা জানতেন, মানতেনও। কিন্তু এখন সেখানেও পরিবর্তনের ছোঁয়া। চার-পাঁচ বছরের শিশুরাও এখন যথেষ্ট পরিণত। তাদের আঁকায়, গানে, নাচের ভঙ্গিতে, এমনকি একান্ত নিজস্ব খেলার সময়টুকুতেও ‘শিশুসুলভ’ আচরণগুলি ফুটে ওঠে না। বরং অন্যকে নকল করাই যেন তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই আচরণকে বড়রা ‘পাকামি’ বলে হেসে উড়িয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু শিশুর দুনিয়া থেকে তাদের এই হ্যাঁচকা টানে বেরিয়ে আসা আদৌ ‘স্বাভাবিক’ কি না, তা নিয়ে বোধ হয় ভাবার সময় এসেছে। কারণ, শৈশব যদি অকালে ফুরিয়ে যায়, শিশু যদি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভাবতে না শেখে, কল্পনার ডানা না মেলে, তবে তার নিজস্বতা তৈরি হতে পারে না। সে তখন এক নিখুঁত যন্ত্রমানব হয়, প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে না।
আমরা সাধারণত শিশুর জগৎটিকে ছিঁড়েখুঁড়ে তাকে নিখুঁত, আরও বেশি নিখুঁত করে তোলার দিকে ঠেলে দিতে চাই। প্রথাগত পড়াশোনা, প্রথাগত ভাবনার বাইরে যদি কেউ পা রাখে, শিকল ছিঁড়ে বেরোতে চায়, অমনি তার ডানাখানা ছাঁটার কাঁচি খুঁজতে থাকি। এই প্রবণতা অবশ্য আজকের নয়, আমাদের ছোটবেলাতেও ছিল। সে আমলেও রেজ়াল্ট বেরোনোর পর ‘ও যদি পারে, তবে তুই পারলি না কেন?’ গোছের আক্ষেপ-বাক্য শুনতে হত। কিন্তু এখন সেই আক্ষেপের অপেক্ষা করলে চলে না। কারণ, সামাজিক চাপ। পারিবারিক নয়, এই চাপের বৃত্ত তার চেয়ে ঢের বড়। এবং এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকায় সমাজমাধ্যম। সেই জগতে দেখনদারির ছড়াছড়ি। পড়াশোনা, গান, নাচ, খেলা— সবেতেই ‘অসামান্য’ কৃতিত্বের প্রদর্শন। সেই ভার্চুয়াল সমাজই স্থির করছে সাফল্যের মাপকাঠি, খুঁজে দিচ্ছে সবচেয়ে দ্রুত শিখরে পৌঁছনোর এক ছকবাঁধা পথ। আর অভিভাবকরা যত বেশি সেই দুনিয়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছেন, নিজের অজানতেই তাঁরাও সেই ছকের অংশ হয়ে সন্তানদের সেখানে টেনে আনছেন। এমন একমাত্রিক দুনিয়ায় শিশুর নিজস্ব জগৎ ঠাঁই পায় না। বরং বইখাতা সরিয়ে খানিক আজগুবি ভাবনায় নিজেকে ডুবোতে চাইলে তৎক্ষণাৎ তাকে শুনতে হয়— এত ভাবিস কেন? ভাবা বন্ধ করতে পারিস না?
এই প্রবল প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় শিশুমনের হারিয়ে যাওয়ার শুরু বেশ কয়েক বছর ধরেই। আর তাতে শেষ পেরেকটি পুঁতল অতিমারির আগমন। তুমুল বাড়ল শিশুদের মোবাইল-আসক্তি। যেটুকু কল্পনা এই ইঁদুর-দৌড়ের ভিতরেও তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল, শিশুর মোবাইল মগ্নতা সেই রেশটুকুও কেড়ে নিল। স্মার্টফোনের কল্যাণে শিশুর সামনে জ্ঞানভান্ডার উন্মুক্ত হয়েছে, এ কথা অস্বীকারের জায়গা নেই। সেই ইন্টারনেট শিশুর মধ্যে অসীম জ্ঞানের সঞ্চার করতে পারে, কিন্তু তাকে ভাবতে শেখায় না। সে নিজের চেষ্টায় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরে না। প্রতিটি প্রশ্নের ব্যাখ্যা তার হাতের কাছেই সাজানো থাকে। মায়ের মুখে গল্প শুনে সে একটা ছবি মনে মনে তৈরি করে না, কার্টুন তাকে সে ছবি এঁকে দেখিয়ে দেয়। মেঘের মধ্যে হাতি, সিংহ আবিষ্কারের আগেই জেনে যায়, কোন মেঘে বৃষ্টি হয়, কোন মেঘে শরৎ আসে। শিশুরাই নাকি ধুঁকতে থাকা পৃথিবীর জীবনীশক্তি। ভয় হয়, আগামী দিনে এই সবজান্তা যন্ত্রমানবদের ভিড়ে জীবনীশক্তিটুকু হারিয়ে যাবে না তো?
আজ শিশুদিবস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সাজবে, শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান চলবে, তাদের হাতে হয়তো উঠবে বেলুন, লজেন্স। কিন্তু দিন ফুরোলে কালকে থেকে আকাশ দেখার সুযোগ মিলবে কি? অঙ্ক ক্লাসে জানলার বাইরে নতুন পাখির বাসায় মন দিলে ডায়েরিতে অভিযোগ উঠবে না তো? অনুষ্ঠান-আড়ম্বরের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ, শিশুদের মতো করে শিশুদের বোঝার, তাদের কথা শোনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বোধ হয় বড্ড কঠিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy