চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাজ অলড্রিন। উইকিমিডিয়া কমনস।
একটা তোলপাড় করা ঘটনা ঘটে গিয়েছে বা ঘটছে, কিন্তু তা কেন ঘটছে? খবরের কাগজে সত্যি কথা লিখছে, না কি এমন কিছু আছে যার কথা প্রকাশ্যে লেখাও যায় না? সেই অনুসন্ধান করতে গিয়ে কিছু মানুষ এমন তত্ত্বের অবতারণা করেন, যেটা সাধারণ মানুষের ভাবনাচিন্তার থেকে অনেকটাই আলাদা একটা বাঁকা পথে চলে। যে-হেতু সামাজিক বাস্তবতা গণিতের যুক্তিবদ্ধ রাস্তায় হাঁটে না, যে-হেতু সেখানে পরম সত্যের থেকে অনেক বেশি সহজলভ্য হল কিছু দৃষ্টিকোণ, তাই আপাত-সত্যের আলোআঁধারিতে দাঁড়িয়ে এই ধরনের তত্ত্ব অনেক মানুষ বিশ্বাসও করতে শুরু করে দেন। এরই নাম কনস্পিরেসি থিয়োরি, বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব— দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে যা মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি স্বাস্থ্যগত সচেতনতাকেও মূলত নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করে আসছে।
গত শতকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণটির সূত্রপাত হয় ১৯৮৭ সালে, যখন আমেরিকার প্রখ্যাত আণবিক জীববিজ্ঞানী পিটার ডিউসবার্গ একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে কোনও ঠাসবুনট প্রমাণ ছাড়াই ঘোষণা করলেন যে, এডস নামক মারণরোগটির পিছনে এইচআইভি-র কোনও ভূমিকা নেই। এটা সেই সময়, যখন এইচআইভি এবং এডস মানবজাতির এক প্রতিকারহীন বিপদ হিসাবে উঠে আসছে; পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে শুরু হচ্ছে রোগটি নিয়ে জনসচেতনতা অভিযান; এবং বাজারে আসতে চলেছে অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল থেরাপি— রক্তে এইচআইভি-র মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
ডিউসবার্গ-এর তত্ত্বটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল, বিশেষ করে অ্যাফ্রো-আমেরিকান এবং সমকামীদের মধ্যে, এইচআইভি সংক্রমণ নিয়ে যাঁরা আগে থেকেই সামাজিক ভাবে কোণঠাসা ছিলেন। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সংস্থার হাতে এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে বিস্তর প্রমাণ থাকলেও অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে, এডস আসলেএক ধরনের ক্ষয়রোগ, যার কারণ অপুষ্টি এবং মাদকের ব্যবহার। এইচআইভি-র সঙ্গে এর যোগসূত্র খোঁজাটা আসলে আমেরিকান ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলোর মানুষকে বোকা বানিয়ে মুনাফা লোটার একটা বিরাট ষড়যন্ত্র।
সেই শুরু। পরবর্তী দশকে থাবো এমবেকি-র শাসনাধীন দক্ষিণ আফ্রিকার জনস্বাস্থ্যে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আমেরিকা ছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লক্ষ লক্ষ এইচআইভি আক্রান্ত মানুষ এই তত্ত্বকে বিশ্বাস করে নিয়মিত অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ওষুধ খেতে অস্বীকার করেন, এবং এডস-এর বলি হন। আজও এই তত্ত্বে আস্থাবান কিছু গোষ্ঠী আছে— বিশ্বাস না হলে নিকোলাই নাৎত্রাসের দি এডস কনস্পিরেসি: সায়েন্স ফাইটস ব্যাক বইটা পড়ে দেখতে পারেন। একই ভাবে টিকে আছেন নব্য-নাৎসিরা, যাঁদের অনেকের বক্তব্য, হিটলারের জার্মানিতে হলোকস্ট বা ইহুদি-নিধন যজ্ঞ বলে কিছুই ঘটেনি, পুরোটাই ছিল একটা সোভিয়েট ধাপ্পাবাজি। রয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি-র লোকজন, যাঁরা বিশ্বাস করেন এবং বাকিদের বিশ্বাস করাতে চান যে, পৃথিবীর আকার আসলে একটা সমতল চাকতির মতো, ওই সব অভিগত গোলক-টোলক হচ্ছে বিজ্ঞানীদের মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার ফিকির।
১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বরে টেক্সাসের ডালাসে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যা করার জন্য আটক করা হয় লি হারভি অসওয়াল্ডকে। সে দিনই স্থানীয় জেলে পাঠানোর সময় রাস্তায় অসওয়াল্ডকে গুলি করে হত্যা করেন টেক্সাসের একটি নাইটক্লাবের মালিক জ্যাক রুবি। এখান থেকেই শুরু হয় এক বড়সড় ষড়যন্ত্র তত্ত্বের— আজও আমেরিকার প্রবীণ নাগরিকদের একটা বড় অংশ মনে করেন যে, কেনেডির হত্যার পিছনে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র সক্রিয় ভূমিকা ছিল, কারণ ফিদেল কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে সিআইএ-র পরিকল্পনায় কেনেডি যথেষ্ট সমর্থন জোগাননি। ১৯৯৭ সালে প্যারিসের এক টানেলে গাড়ি দুর্ঘটনায় যখন প্রাণ হারান ব্রিটেনের যুবরানি ডায়ানা, তাঁর মৃত্যুকেও হত্যা বলে প্রতিপন্ন করার জন্যে রাজপরিবারের কেচ্ছা, অবৈধ প্রেম এবং রাজনীতিকে মিশিয়ে অন্তত তিন রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দাপিয়ে বেড়ায় সে দেশের গণমাধ্যমে।
দুনিয়া কাঁপানো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের তালিকায় থাকবে চন্দ্রাভিযানও— অনেকেরই বিশ্বাস যে, ১৯৬৯-এর জুলাইতে নিল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদের মাটিতে পা রাখার ব্যাপারটা পুরো সাজানো, প্রকাশিত ভিডিয়োটি আসলে হলিউডের স্টুডিয়োতে শুট করা। তালিকায় স্থান পাবে ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি হানা-র নেপথ্যে আমেরিকার সরকার এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ভূমিকা নিয়ে জল্পনাও। বেশ কিছু সাংবাদিক এই তত্ত্বের স্বপক্ষে বিভিন্ন পরোক্ষ প্রমাণ পেশ করেছেন। এঁদের দাবি, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অজুহাতেই আমেরিকার প্রশাসন আফগানিস্তান আক্রমণ করার রাস্তা করে নিয়েছিল— মূলত পেট্রোডলারের লোভে। এই তালিকায় সর্বশেষ বড় সংযোজন কোভিড অতিমারির নেপথ্যে চিনের জীবাণু-অস্ত্র নিয়ে গবেষণা— সেই তত্ত্ব অনুসারে, পুরো অতিমারিটাই আসলে পৃথিবীর জনসংখ্যা একটু কমিয়ে দেওয়ার একটা কৌশল। যে-হেতু এ ধরনের তত্ত্ব সত্যি ও মিথ্যার মাঝের ধূসর অঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকে, ফলে সাধারণ মানুষও নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুসারে এগুলোকে বিশ্বাস করেন বা করেন না।
ভারতও পিছিয়ে নেই। নেতাজি বা লালবাহাদুর শাস্ত্রী-র রহস্যময় মৃত্যুর পিছনে একাধিক তত্ত্ব আছে— এই তত্ত্বগুলো নিয়ে তৈরি বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোও অনেকেই দেখেছেন। ১৯৬৬-তে ভারতীয় পারমাণবিক গবেষণা কর্মসূচির জনক হোমি জাহাঙ্গির ভাবার ফ্রান্সে বিমান-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পিছনে সিআইএ-র ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তাঁদের বিশ্বাস, সেই ঠান্ডা লড়াইয়ের জমানায় এটা ছিল সোভিয়েট রাশিয়ার এই বন্ধুরাষ্ট্রে পরমাণু বোমা সংক্রান্ত গবেষণাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার আমেরিকান ষড়যন্ত্র। একই ভাবে, কখনও ফিসফিসিয়ে তো কখনও উচ্চগ্রামে ভেসে বেড়ায় সঞ্জয় গান্ধীর বিমান-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর নেপথ্যে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে জল্পনা, অথবা এই তত্ত্ব যে, ২০০৪-এর সুনামি আসলে ভারতের একটি পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণে কিছু ভুলত্রুটি ঘটে যাওয়ার ফল। নোটবন্দির পর চালু হওয়া ২০০০ টাকার নোটে নজরদারির জন্য ইলেক্ট্রনিক চিপ লাগানো থাকার তত্ত্ব তো এই সে দিনের কথা। বাদ থাকে না এমনকি চিন সীমান্তের কাছে, লাদাখের কংলা পাস-এ অনেকটা আমেরিকার এরিয়া ৫১-এর ধাঁচে ভারতের অন্তরিক্ষযান বা ইউএফও-র ভান্ডার গড়ে তোলার মতো তত্ত্বও।
ওয়াশিংটন ডিসি-র আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা সিনথিয়া মিলার-ইদ্রিস’এর মতে, ব্যাখ্যার অতীত মৃত্যু— তা অতিমারি পরিস্থিতিতে এক সঙ্গে বহু সাধারণ মানুষেরই হোক, অথবা প্রেসিডেন্ট কেনেডি লেডি ডায়ানার মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বেরই হোক— জনমানসে তৈরি করে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ। প্রতিকারহীন বিপর্যয়কে স্বীকার করতে না চাওয়াটাই মানুষকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতি আকর্ষিত করে। এ ছাড়াও এর পিছনে থাকে সরকারের তরফে ধারাবাহিক ভাবে রটানো মিথ্যাগুলোকে অন্তত কখনও কখনও মানুষের ধরে ফেলা।
কিন্তু আজকের এই তথ্যসন্ত্রাসের যুগে, ব্যাপারটা শুধু এখানেই থেমে নেই— ভোট-ভিত্তিক রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হয়ে উঠেছে অপপ্রচারের এক আবশ্যিক অস্ত্র। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিভাজনের রাজনীতিতে একেবারে সামনের সারিতে জায়গা করে নিয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ‘লাভ জেহাদ’-এর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। যদিও এই তত্ত্বের পক্ষে কোনও জোরালো প্রমাণ গৈরিক শিবিরের হাতে নেই, কিন্তু ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে এমন আইন প্রবর্তিত হয়েছে, যাতে মানুষ পুলিশকে কথিত ‘লাভ জেহাদ’-এর অভিযোগ জানাতে পারে এবং ফৌজদারি অভিযোগ দায়েরের অনুমতি দেওয়া হয়। ২০১৪-য় উত্তরপ্রদেশে বিজেপির রাজনৈতিক ভিত্তিকে পোক্ত করতে রীতিমতো অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে ‘লাভ জেহাদ’।
আমেরিকার বিদেশনীতি সংক্রান্ত বহু ষড়যন্ত্র তত্ত্বের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ধনকুবের ও বিনিয়োগকারী জর্জ সোরোস-এর নামটি এ বার ছড়িয়ে গেল ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ময়দানেও। ভোটের হাওয়ায় হিন্দুত্ববাদীদের ভাসিয়ে দেওয়া অজস্র টুইটে দাবি করা হল, সোরোস-এর আর্থিক মদতে কেমন ভাবে সিএএ-র বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে তাতিয়ে মানুষকে খেপিয়ে তোলার ষড়যন্ত্র হয়েছে, রাহুল গান্ধী কী ভাবে সোরোস-এর অঙ্গুলিহেলনেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন, এবং ভারতীয় অর্থনীতির অপরিসীম ক্ষতি করতে সোরোস কী ভাবে বিভিন্ন বিরোধী দলকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানি-র সমালোচনা করতে প্ররোচিত করছেন!
গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষই শেষ পর্যন্ত ইতিহাস রচনা করেন। কিন্তু আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা যদি অশিক্ষার সঙ্গে মিশে মানুষকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের দিকে টেনে নিয়ে যায়, টাকা ও সংগঠনের জোরে যে কোনও বিরুদ্ধস্বরকে যদি দেগে দেওয়া যায় অ্যান্টি-ন্যাশনাল ও বিদেশি শক্তির মদতে পুষ্ট বলে? তা হলে সেই ইতিহাসের অভিমুখও গণতন্ত্রের রাস্তা পাল্টে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঘুরে যেতে পারে। ভারত যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে এই কথাগুলো মাথায় রাখা অতি জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy