Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Wastage Natural resources

একেই কি বলে উন্নয়ন

নদী ব্রিজের উপর রৌদ্রের খরতাপ। চোখে পড়ছে মলিন নদীখাত, তার শুষ্কতা। জলহীন নদীর ধারে বড় পাম্প বসিয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে জল।

শীর্ণ কেলেঘাই নদী। তার জল পাম্প করে তুলে ভরা হচ্ছে মাছ চাষের ঝিল।

শীর্ণ কেলেঘাই নদী। তার জল পাম্প করে তুলে ভরা হচ্ছে মাছ চাষের ঝিল।

অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৪ ০৮:২১
Share: Save:

ফাল্গুনের ঝকঝকে রৌদ্রময় দিন। পথের ধারে পলাশের গুচ্ছে বসন্ত এসেছে। মেদিনীপুর শহর থেকে পথ গেছে জাতীয় সড়ককে আড়াআড়ি চিরে কুসুমডাঙা হয়ে কেলেঘাই নদীর তীরে পাথরঘাটার দিকে। পথে পড়ল হাঁদলার মোড় আর বড় গ্রাম চকমুকুন্দ। দু’পাশে কেবল ধানের সবুজ। বাতাসে কচি ধানচারার হিল্লোল। সমতল শস্যের মাঠে কোনও মহীরুহ চোখে পড়ে না। দশগ্রাম থেকে ডান দিকে ঘুরে কিছুটা গিয়ে কেলেঘাই ব্রিজ। কাঁসাই, শিলাবতী, দ্বারকেশ্বরের মতো ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে নয়, কেলেঘাই নদীটি ঝাড়গ্রাম থেকে বেরিয়েছে। বয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ভিতর দিয়ে, তার পর কাঁসাইয়ের সঙ্গে মিশে নাম নিয়েছে হলদি নদী ।

নদী ব্রিজের উপর রৌদ্রের খরতাপ। চোখে পড়ছে মলিন নদীখাত, তার শুষ্কতা। জলহীন নদীর ধারে বড় পাম্প বসিয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে জল। পাশেই মাছ চাষের জন্য বড় জলের ভান্ডার। বাদা অঞ্চলের মতো এখানে একে ভেড়ি বলে না, বলে ঝিল। চাষ চিংড়ির নয়, রুই-কাতলা মাছের। সন্দেশখালির সঙ্গে অমিল শুধু এইটুকুতে। না হলে কেলেঘাইয়ের তীর বরাবর নতুন যে ঝিলগুলি জেগেছে, দশ বছর আগেও তারা ছিল চাষের জমি। প্রলোভন, চাপ ইত্যাদি ত্রিমুখী আক্রমণে চাষিকে বাধ্য করা হচ্ছে জমি ঝিলের জন্য লিজ়-এ দিতে। আগের দিন কাঁসাইয়ের তীর এলাকায় চাষ দেখেছি। শসা, গাঁদাফুল, আলু। এক দিন যেখানে বালুচর ছিল, সেখানে বালি নিঃশেষ। বেরিয়ে পড়েছে মাটি। কাঁসাইয়ের বুক থেকে এত বালি তোলা হয়েছে যে, এখন বাধ্য হয়ে বন্ধ করা হয়েছে বালি তোলা। কেলেঘাই আরও দুঃখী। তার জল পাম্প করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নদীর বুক খালি করে।

কথিত আছে কেলেঘাই নদী পথে চৈতন্যদেব পুরী অভিমুখে গিয়েছিলেন, কেলেঘাই বেয়ে হলদি হয়ে। এখানে সারা দিন বাতাসে যে মাইক নিনাদিত সঙ্কীর্তন ধ্বনি ভাসে, তা চৈতন্যের রেখে যাওয়া ভক্তি-পরম্পরা। ভক্তির সঙ্গে কতিপয় প্রভাবশালীর লোভ আর পরিবেশের প্রতি আগ্রাসনের কোনও বিরোধ নেই। এখন কেলেঘাই যে পথে বয়েছে, তা মূল গতিপথ নয়। নদী আগে বইত আমগাছিয়া থেকে রসুলপুর। জলের ঢাল ছিল সেই পথেই। সে পথটা এখন মজে গেছে। বুড়োবুড়ির দহের কাছে কেলেঘাই আর কাঁসাই যেখানে মিশেছে, সেই জায়গাটি অপরিসর। ফলে জলের গতি রুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। আরও দক্ষিণে ঘাটাল শহরে বন্যা আসে বর্ষার শেষ ভাগে। সিংলাইয়ের মোড়ে আড়াআড়ি দেওয়া বাঁধে কেলেঘাইয়ের পুরনো ও নতুন খাত আলাদা হয়ে গেছে দেখা যায়।

অযোধ্যাপুরের কাছে চায়ের দোকানে দুধ দেওয়া ঘন চা আর সুজির বিস্কুট খেতে খেতে নদীর কথা হল স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে। ওঁরা কেলেঘাইকে বলেন, আমার নদী। এত টান, মায়া নদীর উপর। এক নদীর জন্য একটি ওয়েবসাইট, তা ছাড়া ওয়েব ও মুদ্রিত ম্যাগাজ়িন বার হয়, তার বিষয় পরিবেশ, নদী ও সাহিত্য। নাম ও কেলেঘাই। পাঁচ জনই শিক্ষক। তাঁদের শৈশবের শিক্ষকও আছেন দলে। এক জন গবেষণা করেন। পরিবেশকর্মী সকলেই।ছোটখাটো চাষবাস আছে। নদীর ভাবনায় জড়িয়ে আছেন সর্বক্ষণ।

দ্বারকেশ্বর, কংসাবতীর থেকে কেলেঘাই কিন্তু আলাদা, বললেন পরিবেশ গবেষক। কেন আলাদা? কেলেঘাইয়ের জল রক্ষা করে এক অনন্য সামাজিক বাস্তুতন্ত্রকে। এর কূলে বসবাসকারী রাজবংশী জেলেদের জীবন নদীর উপর সতত নির্ভরশীল। নদীর কূলের আশেপাশে একদা ছিল বহু ওয়েটল্যান্ড বা জলাজমি। একটিই ফসল হত তাতে। আর বর্ষাকালে পাওয়া যেত নানা রকমের মাছ। জলাজমিগুলিকে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে আবদ্ধ করে বাণিজ্যিক মাছ চাষ চলেছে বহু বছর হল। এখন যে সব ঝিল বা মিষ্টি জলের ভেড়ি তৈরি হয়েছে, তাতে মৎস্যজীবীদের জীবিকা নষ্ট হয়েছে। কারণ সুলভ, সহজলভ্য মাছগুলি হারিয়ে যাচ্ছে নদী অববাহিকা থেকে। এ কেবল ধীবরদের জীবিকার সঙ্কট নয়, গরিবের আহারে পুষ্টির সঙ্কটও বটে। জলাভূমিগুলি ভেড়িতে পরিণত হয়েছে বলে রায়ত চাষিরা লিজ়-এর টাকা পান, বিঘে প্রতি পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা। সেটা চাষ থেকে আয়ের চেয়ে বেশি। তবে জমি তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ জমি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কোনও দিন পেলেও বছর পনেরো লাগবে জমির নিজ চরিত্র ফিরিয়ে তাকে চাষযোগ্য করে তুলতে। বাণিজ্যিক চাষ বদলে দিয়েছে পুরনো চাষের পদ্ধতি। নদীর আড়াআড়ি বাঘালের সংখ্যা বেড়েছে। তাতে মিশেছে প্লাস্টিক, নাইলন নেট, ফাইবার শিট। ফলে নদীতে আগাছা, কচুরিপানা ইত্যাদির জন্ম বিঘ্নিত হয়েছে।

নদী তীরে আগে ছিল হিজলের বন। হিজলের শিকড় মাটিকে রক্ষা করে, জলে তার বেড়া দিলে টেকে বছরের পর বছর। কেলেঘাইয়ের শাখানদী বাগুই-এর তীরে এখনও রয়ে গেছে কিছু হিজলের বন। জঙ্গল বিভাগ স্থানীয় গাছে আগ্রহী নয় মনে হল। কেবল ইউক্যালিপটাস লাগায়। এ গাছগুলি বাড়ে দ্রুত, কিন্তু নীচে জলস্তর নেমে যায়। আগাছা গজায় না নীচে। সামনেই পটাশপুর। এখন বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হয়ে গেছে। বৃক্ষ আচ্ছাদন নষ্ট হওয়ার ফলে। শামুকখোল পাখি আগে শিকার করত চন্দ্রবোড়া সাপকে। এখন শামুকখোল শিকার করছে মানুষ। চন্দ্রবোড়ার বংশ বৃদ্ধি এমন ভাবে হচ্ছে যে, বহু মৃত্যু হচ্ছে সাপের কামড়ে।

অযোধ্যাপুর পেরিয়ে পটাশপুরের রাস্তা। সেখানে দেখা পেলাম কেলেঘাইয়ের উপনদী বাগুইয়ের। নদী পেরিয়ে নৈপুর। নৈপুরের পুরনো স্কুল শান্তিসুধা ইনস্টিটিউশন। যুবকরা সবাই এখানকার ছাত্র। মাস্টারমশাইও আছেন সঙ্গে। পটাশপুরের পর বড় গ্রাম টেঁপরপাড়া। তার পর পাথরঘাটা। পাথরঘাটায় শ্রীচৈতন্য এসেছিলেন। এখানকার শিবমন্দিরে রাত্রি যাপন করেছিলেন, কথিত আছে। সে মন্দির এখন আরও বড়, আরও সুন্দর করে তৈরি হচ্ছে। পুরনো চুনসুরকির গাঁথনির জায়গায় এসেছে সিমেন্ট-কংক্রিট। পুরনো নন্দী ষাঁড়ের মূর্তি দু’টি টান মেরে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে। পুরনো কেলেঘাইয়ের ধারা গিয়েছে এই পাথরঘাটা দিয়ে।

বিপন্ন কেলেঘাই, তার জীববৈচিত্র ফেরাতে ক’জন তরুণের কণ্ঠ সরকার পর্যন্ত পৌঁছয় না। অথচ তাঁদের কাজ নিয়ে আগ্রহী বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক অধ্যাপকও। ছোট এক নদী। ১২০ কিলোমিটারের মতো তার চলনপথ। কিন্তু মানুষের জীবন, জীবিকা, প্রকৃতির ভারসাম্য রাখায় তার কত যে কাজ। এ নদীর ছোট-বড়-মাঝারি মাছেদের দিন শেষ হয়ে আসছে। আইড়, পরাল, পাঙ্গাস, চিতল, নয়না, খুড়সি কালবোস, সনা পুঁটি, ভাতুয়া, কই, পাঁকাল, ট্যাংরা, এরা নিঃশেষ হতে বসেছে; কাঁকড়া, জলা ইঁদুর, কচ্ছপ, উদ্বিড়ালের মতো প্রাণীরাও এখন বিলুপ্তপ্রায়। শুষ্ক নদীখাতের পাশে সারি সারি রুই-কাতলার ঝিল জাগা গ্রামাঞ্চলে বাতাসে ভেসে বেড়ানো সঙ্কীর্তনকে মনে হয় হাহাকার।

এ কেমন উন্নয়ন? যেখানে প্রকৃতির সম্পদকে বিনষ্ট করে জনাকয়েকের লোভ, শাসনব্যবস্থার উদ্ধত নিস্পৃহতা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy