পাঁচ দশক আগে লেখা সত্যজিৎ রায়ের গ্যাংটকে গণ্ডগোল আজও বাঙালির কৈশোরের সিলেবাসের অঙ্গ। বঙ্গবাসী এখন জলবায়ু পরিবর্তনে খাপ খাওয়াতে হাওয়া বদলের জন্য ঘন ঘন ছুটছে পাহাড়ে। পড়শি পাহাড়ি রাজ্যের রাজধানী গ্যাংটকে পর্যটনের দাপট বাড়ছে। গত পাঁচ দশকে পরিষেবা-কেন্দ্রিক অর্থনীতির পথে পাহাড়ে নগরায়ণ ঘটেছে। বেড়েছে হোটেল, সড়ক, সেতু ইত্যাদির নির্মাণ। এই প্রেক্ষিতে উত্তরের সমতল শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটকের মূল জাতীয় সড়ক বরাবর উত্তরোত্তর ভূমিধসের কারণে অবস্থা শোচনীয়। গ্যাংটক যাতায়াতের পথে তা বহুগুণ বিপদ বাড়িয়ে তুলেছে।
মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সিকিমের পণ্য, যাত্রী-পরিবহণের ‘লাইফ লাইন’ শিলিগুড়ি-গ্যাংটক ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। এই ১১৪ কিমি লম্বা সড়কপথের সিংহভাগই পাহাড়ি অঞ্চলে। তার ৫৫% পশ্চিমবঙ্গে, বাকিটা সিকিমে। সিকিমের সঙ্গে চিন, ভুটান, নেপালের সীমান্ত থাকায় জাতীয় ক্ষেত্রেও এই সড়ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন রাস্তার অন্তর্জলি যাত্রা দুই রাজ্যের অধিবাসীদের কাছে বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। ইন্ডিয়ান রোডস কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে পথটির বিকল্পের সন্ধান আলোচিত হয়েছে। বিপদ এড়াতে বিকল্পের খোঁজ করছেন দেশের সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী, এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
সাম্প্রতিক কালে যে ভাবে জোশীমঠের মতো জনপদ চোখের নিমেষে ধসে গিয়েছে সেই বিপদের সঙ্কেত এ রাজ্যের দার্জিলিং, কালিম্পঙে, সিকিমের রংপো, মঙ্গনে মিলছে কি না— তা দু’রাজ্যেই চর্চার বিষয়। ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক যে পাহাড়গুলির ঢাল কেটে তৈরি হয়েছে সেগুলি ভঙ্গুর শিলাস্তর ও আলগা মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। হিমালয়ের এই অংশের শিলাস্তর নবীন। সেগুলির স্থায়ী সাম্যাবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। ফলে এমন পাহাড় কেটে তার উপরে রাস্তা, সেতু, সুড়ঙ্গ তৈরি হলে ভারসাম্যের বিঘ্ন ঘটে। ফলে ধস প্রবণতা বাড়ে। পাহাড় জুড়ে পর্যটন-কেন্দ্রিক অর্থনীতির পথে বেড়ে ওঠা নির্মাণের সামগ্রীর জোগান দিতে পাহাড়ি সড়কে প্রতি দিন ভারী পণ্যবাহী ট্রাক, যন্ত্রপাতির আনাগোনা গত দু’দশকে বেড়েছে। পাহাড়ের ঢালে পাঁচ-ছ’তলা অট্টালিকার সারি উঠলেই ‘গেল গেল’ রব ওঠে। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় ভারী ট্রাক যাওয়ার চাপ প্রায় পঁচিশ তলা বাড়ির ভিতের চাপের সমান! অপরিকল্পিত উপায়ে ঢাল কেটে তৈরি অপরিসর রাস্তায় ভারী গাড়ির চাপই এখন ধসের ভরকেন্দ্র। রাস্তার চলমান বহুতলের সারির মতো ভারী যানের বিপদ ক্ষয়রোগের মতো ধীর লয়ে ঢালের স্থায়িত্বকে গ্রাস করে। সরু ভারী গাড়ির চাপে রাস্তা সংলগ্ন পাথর-মাটির ভারসাম্য তীব্র বিঘ্নিত হয়। এই যাত্রাপথের বিভিন্ন ঝোরাগুলি ছিল পাহাড়ের বৃষ্টির জলের স্বাভাবিক নিকাশি। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে ঝোরাগুলি এমন অবরুদ্ধ যে সেই অঞ্চলে বাড়ছে ধস প্রবণতা। কালি ঝোরা, রবি ঝোরা, সেথি ঝোরা এমনই ধস-প্রবণ এলাকা।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যেও পাহাড়ের নদীতে কাজ চলছে। তিস্তার বুক চিরে ব্যারাজ, বাঁধের বেলাগাম নির্মাণ স্বাভাবিক জলপ্রবাহকে বিঘ্নিত করেছে। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার উপর প্রস্তাবিত ৪৭টি প্রকল্পের ন’টির কাজ সম্পূর্ণ, ১৫টির কাজ চলছে। বাকি ২৩টি প্রকল্পও শুরু হওয়ার পথে। জমছে নুড়ি-পাথরের স্তূপ, মজে যাওয়া নদীর মতো তিস্তার জলধারণ ক্ষমতা ক্রমে কমছে। বর্ষার টানা প্রবল বৃষ্টিতে নদীখাত উপচে জল চার পাশ ভাসিয়ে বইছে। কলকাতার ঠনঠনিয়ার মতোই, উপচানো তিস্তার জলে খাবি খাচ্ছে তিস্তা বাজারের মানুষ। উল্লেখযোগ্য যে, এই সড়কের এক দিকের ঢাল যেমন পাহাড় লাগোয়া, তার উল্টো দিকের ঢাল কিন্তু মিশেছে নদীতে। ফলে প্রবল বেগে ছুটে চলা তিস্তার স্রোত সেই সড়কের ঢালের নীচের অংশও ভেঙে দিচ্ছে। সেই কারণেও ধস নামছে রাস্তায়।
গ্যাংটক থেকে নেমে আসা ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন পাহাড় কেটে তৈরি। সেখানে সারা বছরই বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ফলে পাহাড়ের পাথর-মাটির বাঁধন আলগা হয়ে ঢালের ভারসাম্যের বিঘ্ন ঘটে, বাড়ে ধসের ঝুঁকি। এমন ঝুঁকিপ্রবণ পাহাড় ফাটিয়ে রেলের টানেল নির্মাণ হলে এলাকার ঢালের স্থায়িত্বের ঝুঁকি আরও বাড়ে। এ কথা ঠিক, ইউরোপে পাহাড়ি সুড়ঙ্গপথে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন ছোটে। কিন্তু, হিমালয়ের তুলনায় ইউরোপের আল্পস অনেক পোক্ত ও পুরনো। সেই পোক্ত পাহাড়ে যা নিরাপদ, তা সিকিম দার্জিলিঙে আলগা পাথরের পাহাড়ে অত্যন্ত ঝুঁকির। উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গধস তো হিমালয় চিরে যত্রতত্র সুড়ঙ্গ বানানোরই পরিণাম!
গাছপালার শিকড় আলগা পাথর-মাটিকে বেঁধে রাখে বলে ঢাল বেয়ে নামা ধস রোধ করা যায়। অর্থাৎ, পাহাড়ের গায়ের সবুজ গাছগাছালি ধসের প্রতিষেধক। কিন্তু গত কয়েক দশকের উপগ্রহ চিত্রে স্পষ্ট, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের চেয়েও বেশি হারে ছাঁটা হয়েছে পাহাড়ের সবুজ। কারণ, সেই বেলাগাম নির্মাণ। ফলে উত্তরোত্তর বেড়েছে ঢালে ধসের ঝুঁকি। এক-একটা ধসে হারিয়ে যাচ্ছে শয়ে শয়ে গাছ। পাহাড় জুড়ে এই ধস রুখতে আশু প্রয়োজন পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ, নদীর পাড় ঘেঁষা ঢালে রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করা। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজেই যে পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র আজ বিশ বাঁও জলে, বোঝার সময় হয়েছে। আশা করা যায়, বিপন্ন জাতীয় সড়কের বিকল্প রুটটি রচিত হবে পুরনো রাস্তার ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের পথেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy