হিসাববিহীন, প্রচুর— এই অর্থে ‘জলের মতো’ বলে বাংলায় একটি বাগ্বিধি ছিল, যেটা আজ আর সচরাচর ব্যবহার হয় না। বাস্তব অবস্থা যখন সেই রকম ছিল তখন এমন কথা প্রচলিত থাকতে পারে, বাস্তবতা পাল্টে গেলে তার স্মৃতিচিহ্ন কথা সব বইয়ের নির্জল পাতায় পড়ে থাকে। আমাদের সুজলা দেশে এখন নতুন বাস্তবতা— জলাভাব। চৈত্র মাস শুরু হয়নি, এখনও বাতাসে গাছপালায় বেশ বসন্তের আমেজ, কিন্তু ইতিমধ্যেই বাংলার নানা অঞ্চলে পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছে। পুর এলাকায় জল না আসার নোটিস, টিউবওয়েলে, রাস্তার কলে জল কমে যাওয়া জানান দিচ্ছে— সঙ্কট আসন্ন।
আজ বেশ কয়েক দশক হয়ে গেল আমাদের কেবল পানীয় জল নয়, দৈনন্দিন ব্যবহারের বেশির ভাগ জলই মাটির তলা থেকে পাম্পের সাহায্যে উপরে তুলে আনতে হয়। এই প্রসঙ্গে সদা উচ্চারিত বিখ্যাত সেই ‘রাস্তার কলের খোলা মুখ’ থেকে সঙ্কটের কিছুই বোঝা যাবে না। ভূগর্ভস্থ জল অর্থাৎ মাটির তলায় যে জল জমা থাকে সেই ভান্ডারটি নিয়মিত প্রাকৃতিক ভাবে ভরা হতে থাকে। সৃষ্টির আদি কাল থেকে জমা কিছু জল যা ভূতলের অনেক গভীর কোনও কোনও স্তরে জমা আছে, সেগুলো সাধারণ ভাবে উত্তোলিত হয় না।
মাটির উপরিভাগের মতো মাটির নীচে জমা জলেরও বড় অংশ আসে আকাশ থেকে। বর্ষার যে জল ভূতলের উপরের পুকুর হ্রদ দিঘি জলাভূমি নদীকে ভরে দেয়, সেই জলই নিয়মিত মাটির ভিতরে প্রবেশ করে নানা পথ দিয়ে। জলাভূমি ও অরণ্য বৃষ্টির জলের একটা বড় অংশকে মাটির তলায় চলে যেতে দিত (recharging)। ফলে মাটি সরস, নদীগুলি শীত-গ্রীষ্মেও জলপূর্ণ থাকত। তা ছাড়াও বজায় থাকত মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা।
বনের ভিতরের মাটি, নদী তীরের মাটি, সাধারণ ভাবে নিম্ন অঞ্চলের মাটি মোটামুটি বছরের অনেকটা সময়েই স্যাঁতসেঁতে থাকত। এমনকি অপেক্ষাকৃত বড় নদীদের জলের প্রবাহ শীত-বর্ষায় দৃশ্যত খুব বেশি তফাত হত না। নদীখাতের গভীরতা ছাড়াও তার অন্যতম কারণ হত, মাটির তলার জল নিয়মিত ভাবে নদীর মধ্যে চুইয়ে আসা। নানা ভাবে বৃষ্টির জল প্রবেশ করেই সম্পদে ভরে রাখে ভূগর্ভের ভান্ডার। সেখানেও আছে বহমান জলস্রোত এবং স্থির জলস্তর। কতখানি জল ভরা হলে কতটা জল তোলা যাবে, তার নির্দিষ্ট হিসেব আছে এবং তা কখনওই ‘যত্র আয় তত্র ব্যয়’-এর নয়। এই সমস্তটা পাল্টে যাচ্ছে অতি দ্রুত, এমনকি গত মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ভূগর্ভের জলস্তর উল্লেখযোগ্য ভাবে নেমে গিয়েছে।
মানুষ-সহ সমগ্র প্রাণজগতের অস্তিত্বের একটি প্রাথমিক শর্ত যে পরিপার্শ্বে যথেষ্ট জলের উপস্থিতি, সে কথা এখন কাউকে বোঝাবার দরকার হয় না। আশ্চর্য এটাই যে তবু জল ফুরিয়ে আসছে, ভূগর্ভস্থ জলস্তর উদ্বেগজনক ভাবে কমছে— এই সাবধানবাণী, বিশেষত শিক্ষিত নাগরিকদের মনে, বিশেষ কোনও ছাপ ফেলছে না। অদ্ভুত এক ‘সব ঠিক হো জায়েগা’র ঘোরে বাস করছি আমরা। প্রযুক্তি আর নিজের টাকা, দুই আলাদিনের জিন আমাদের কথা দিয়েছে যা কিছু চাই, তার সব স্বপ্ন দেখাবে।
বাস্তব কিন্তু তা বলে না। যে ভারত চিরকাল সুজলা বলেই সুফলা, বর্তমানে তার স্থায়ী জলভান্ডার বিপন্ন, কারণ তাতে জল ভরার পরিমাণের সঙ্গে জল তুলে নেওয়ার পরিমাণের কোনও সঙ্গতি নেই। বৃষ্টির যে অজস্র বিশুদ্ধ জল এই দেশ এখনও নিয়মিত ভাবে পায়, সেই জল সংরক্ষণের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিগুলি আমাদের কয়েক হাজার প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস গড়েছিল, মাত্র একশো বছরের মধ্যে তা বিপর্যস্ত হতে বসেছে মূলত চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ভাবে সেই জলের সংস্থান নষ্ট হওয়ার কারণে।
ভূগর্ভস্থ জলের খবর প্রাচীন মানুষদের অজানা ছিল না। রামায়ণ এবং মহাভারত, এই দুই মহাকাব্যেই তার উল্লেখ আছে। গঙ্গার পরিচয় দিতে গিয়ে রামায়ণ বলে ত্রিপথগামিনী সুরধুনীর ধারা ভোগবতী নামে পাতালে বহমানা হন। মহাভারতে দেখা যায়, শরশয্যা শায়িত ভীষ্মের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য অর্জুন ভোগবতীর ধারাকে ভূতলে তুলে আনেন। এবং ভারতীয় পুরাণে এই এক বার মাত্র ছাড়া আর কোথাও পাতালজল তোলার উল্লেখ দেখা যায় না। সেখানে আজ দেশের পানীয় জলের বেশির ভাগটাই উত্তোলিত হয় ভূগর্ভ থেকে।
এই তীব্র সঙ্কট বিষয়ক সতর্কবার্তা আজ কয়েক বছর ধরে সারা পৃথিবীতেই বারে বারে দিয়ে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিকদের বিভিন্ন সংগঠন। ভূগর্ভের জলের প্রধান দু’টি সমস্যা নিয়ে অন্যান্য বছরের মতোই সরকারের উদাসীনতা নিয়ে আক্ষেপ করছে সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপল। এক দিকে ভূগর্ভে জল পৌঁছনো ও উত্তোলনের অসামঞ্জস্য, অন্য দিকে ভূগর্ভস্থ জলস্রোতগুলির উদ্বেগজনক দূষণ। তাঁদের দীর্ঘ ও সযত্ন সমীক্ষা থেকে প্রকাশ যে, ভূপৃষ্ঠের যে-সব অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা দিয়ে বৃষ্টিজল গড়িয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করে (ক্যাচমেন্ট এরিয়া), মনুষ্য হস্তক্ষেপের ফলে সেগুলি অস্বাভাবিক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। তার ফলে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্রও তীব্র সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। এই কথাগুলো প্রমাণের জন্য অবশ্য কোনও অ্যাকাডেমিক পেপারের বিশেষ প্রয়োজন নেই, নিজেদের আশপাশে চোখকান খোলা রাখলেই তা যথেষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট কেবল সেই স্থানিক জানাকে ব্যাপ্তির স্বাক্ষর জোগায়। ভূগর্ভস্থ জলের ক্যাচমেন্ট এলাকাগুলির মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ জায়গায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল ইত্যাদি ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। সে সব জায়গা অন্য ভাবে ব্যবহৃত হওয়ার দরুন যথেষ্ট জল ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারে না।
জলাভূমি ও অরণ্য বৃষ্টির জলকে মাটির তলায় চলে যেতে দিত। ফলে মাটি সরস, নদীগুলি শীত-গ্রীষ্মেও জলপূর্ণ থাকত। উত্তোলিত জল পূরণ হয়ে যেত। বর্তমানে সরকারি নিয়ম সত্ত্বেও অতিরিক্ত কংক্রিট ব্যবহার ও ব্যাপক অরণ্য এবং জলাভূমি ধ্বংসের ফলে বৃষ্টিজল মাটির নীচে যাওয়ার হার আশঙ্কাজনক ভাবে কমে গিয়েছে। অন্য দিকে, মাটির উপরে জল সংরক্ষিত থাকার জায়গা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার ফলে সাধারণ ভাবেই ঝরে পড়া প্রচুর বৃষ্টিজল সাময়িক অস্বাভাবিক বন্যার বিপর্যয় ঘটিয়ে বয়ে চলে যাচ্ছে, কোথাও জমা থাকছে না।
ভারতের ১৮৯টি জেলা নিয়ে এক শ্রমসাধ্য গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ জলের সেচ শতকরা ৫৫ ভাগ, যখন কিনা মাটির উপরের জল দিয়ে সেচের পরিমাণ ৩০ ভাগ মাত্র। অথচ, সকলেই জানেন এই দেশে বৃষ্টিজলকে ব্যবহার করে সেচের কত বিচিত্র পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। ‘সবুজ বিপ্লব’-পরবর্তী সময়ে এই জলসঙ্কট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে অথচ তার নিরসনের জন্য বাস্তবে কোনও উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়নি বললেই হয়। এক সময়ে দেশের প্রধান নদীগুলোর উপরে বড় বাঁধ তৈরির অন্যতম প্রধান কারণ বলা হয়েছিল— সেচ। গত প্রায় পাঁচ দশকে সেচের প্রধান উপায় দাঁড়িয়েছে পাম্পে জল তুলে জমিতে ঢালা।
আইআইটি গান্ধীনগরের এক সাম্প্রতিক গবেষণার রিপোর্টে প্রকাশ, দেশের পাম্প সেচের জমি ১৯৭০-৭১’এর ১১.৮৯ মিলিয়ন হেক্টর থেকে ২০১৮-১৯’এ হয়েছে ৪৫.৭৫ মিলিয়ন হেক্টর। ওই সমীক্ষায় আরও দেখা যাচ্ছে, উত্তর-পশ্চিম ভারত ২০০২ থেকে ২০২২-এর মধ্যে হারিয়েছে ৪৭২ ঘন কিমি ভূগর্ভস্থ জল। এগুলি কোনও উন্মাদের দুঃস্বপ্ন নয়, বাস্তব ঘটনা। এ ছাড়া আছে প্রতিটি কল কারখানা, যারা অপচয় ও দূষণ একই সঙ্গে ঘটায়।
তৃষ্ণার জল? ভারতে ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’ বিজ্ঞাপিত পানীয়ের চেয়েও বড় বাজার এখন পানীয় জলের। এখানে লাইসেন্স প্রাপ্ত পানীয় জলের কোম্পানির সংখ্যা ৭৫০০-র বেশি। অবৈধ নানা স্থানীয় কোম্পানির পাশাপাশি। সে জলে দূষণের প্রশ্নটি দিনে দিনে স্পষ্ট।
অসংখ্য কুয়ো পুকুর দিঘি ঝিল হ্রদ ঝর্নার দেশের সামনে সত্যিই তবে শুষ্কতালু নির্জলা ভবিষ্যৎ?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)