আগন্তুক (১৯৯১) দেখে সমালোচকদের কেউ লেভি স্ত্রস, ভিক্টর টার্নার ঘেঁটে তার নাড়ি ধরতে চেয়েছেন, কারও কাছে আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে রায়দান নীতিখুড়োর প্রলাপ মনে হয়েছে। অস্বস্তি লুকোতে পারেননি কেউই, ঢিলটা লেগেছে তাকমাফিক। জংলিদের সঙ্গে তুলনা করে তাঁদেরই সভ্য বলা, বিয়ের পবিত্র বন্ধন নিয়ে বিদ্রুপ— প্রাইজ় পেয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? এ সবই সত্যজিতের আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া, কিন্তু তিনি বিদ্যাসাগরের মতো স্পষ্ট বলবেন, তোমাদের মতন ভদ্দরলোকদের চেয়ে আমার ‘অসভ্য’ সাঁওতাল ভাল।
মনোমোহন মিত্র ভিলেন নন। যে মানুষ সন্তানকে শেখায় প্রশ্ন না তোলাই সমীচীন, তার চোখে তিনি অসামাজিক। একে পাগল ঠাহরে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু বিপদ, সত্যজিৎ নিজেকে মনোমোহনের মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন। অ্যালান পো ভাল লাগে তাঁর, উৎপল দত্তের মেকআপও ও রকম। তাঁর থুতনির ডান দিকের তিল মনোমোহনের ডান গালে। বিএ পাশের পর সত্যজিৎ ভেবেছিলেন আর্ট কলেজে যাবেন, মনোমোহনও তাই। এক জন অজন্তা দেখে শান্তিনিকেতন ছাড়েন, আলতামিরার বাইসন দেখে অন্য পথ বেছে নেন আর এক জন।
অতিথি গল্পের পুলিন রায় আগন্তুক-এ (ছবিতে একটি দৃশ্য) মনোমোহন মিত্র। সুহাসিনী আর সুরেশ অনিলা-সুধীন্দ্র, পুত্রের নামটি পাল্টায় না। পরিচয়টা পাল্টায়, অর্জুনের সারথি সাত্যকি নয়, সে কৃষ্ণের শিষ্য সাত্যকি। কৃষ্ণের উল্লেখমাত্র খেয়াল হবে, বাড়ি ঢোকার পরেই কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম থেকে দু’কলি গেয়ে শোনান মনোমোহন। চোখের সামনে উৎপল দত্ত, আড়ালে সত্যজিৎ রায়, কৃষ্ণবেশে মোহ বিস্তার করছেন। সত্যজিতের নজর ছেলেপিলেদের উপর, তাদের শিষ্য করবেন বলেই এ যাত্রায় তাঁর নাম মনোমোহন। তিনি ‘মিত্র’ও। বন্ধু। বন্ধুত্বের উপহার— সাত্যকির জন্য ইনকা সভ্যতার প্রতীক এক পুতুল, আর বিস্ময়বোধ। গড়ের মাঠে গাছতলায় বসে সেই বিস্ময়ের কথাই বলেন মনোমোহন। মনোমোহন যখন গপ্পো শোনাচ্ছেন, এক প্যারাশুট যাত্রী ধীরে ধীরে নেমে আসে বিকেলের গড়ের মাঠে। ক্যামেরা তখন উৎপল দত্তকে ধরে, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ক্যামেরা প্যারাশুট যাত্রীকে ধরল কেন? মনোমোহনের চোখই বা জ্বলে ওঠে কেন?
মনোমোহন দেশ ছাড়েন ১৯৫৫-তে, যে বছর পথের পাঁচালী-র মুক্তি। মাঝেমধ্যে একটি করে পোস্টকার্ড তাঁর পিতৃব্য শেতলবাবু পেয়েছেন, বিদেশের নানা শহর থেকে। কারান্ডিকারকে মনে আছে? যাযাবরের জীবন বেছে নেওয়া ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ’ বীরেন বাবাকে শেষ চিঠি দেয় ’৬৭-তে। ’৬৮-র পর মনোমোহনের চিঠি শেতলবাবু আর পাননি। চিঠি না লেখার কারণ ছিল— ’৬৮-র পরেই সত্যজিতের অজ্ঞাতবাস, ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়া, নিজ শ্রেণির রক্ত বিশ্লেষণে ডুবে যাওয়া, ’৬৯-এ অরণ্যের দিনরাত্রি তোলা। কারান্ডিকার আছেন কোথাও। আছেন বলেই শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষও জনঅরণ্য দেখে বেরিয়ে আসেন মাথা নিচু করে, সত্যজিৎ এ বার আমাদের দেখে ফেলেছেন পুরোপুরি!
কিন্তু ওই সালটা যদি বাংলার ১৩৬৮ হয়? সে বছরেই শেষ বারের মতো উড়ে গিয়েছিল অ্যাং। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার বঙ্কুবিহারী, ছাত্ররা যাঁর পিছনে লাগে, আড্ডায় যিনি রগড়ের বস্তু, তাঁর চোখে কাচ-লাগানো নল ঠেকিয়ে দেশবিদেশ দেখানোর পর, ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং বলে যায়: “তোমার দোষ তুমি অতিরিক্ত নিরীহ, তাই জীবনে উন্নতি করোনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা বা নীরবে অপমান সহ্য করা এসব শুধু মানুষ কেন, কোনও প্রাণীরই শোভা পায় না।” এর পরেই আড্ডায় ঢুকে ঝাড়া এক মিনিট অট্টহাসি বঙ্কুবাবুর, তাঁর কথা শুনে রামকানাইয়ের হাত থেকে চা-ভর্তি পেয়ালা পড়ে গিয়ে সবার কাপড়ে-চোপড়ে গরম চা ছিটিয়ে চুরমার হয়ে যায়।
তথাকথিত ভদ্রসমাজকে আয়না দেখিয়ে সেটা আছড়ে ভাঙার কাজ, মনোমোহন আড্ডায় বসেই সারেন। দুর্নীতির আশ্রয় যাকে নিতে হয় না, মুদ্রাদোষ নেই যার, সে কি এই গ্রহের জীব? বিলিতি ফার্মের চাকরি ছেড়ে, শেষ কপর্দক বাজি রেখে যে লোক বাঘের মুখে মাথা ঢোকায় আর বার করে আনে, সে এই দুনিয়ার রিংমাস্টার? কলকাতার রাস্তায় ফ্যান চেয়ে না-পাওয়া লাশ টপকে যিনি হেঁটে গেছেন, তিনি কি অন্য এক কালপর্বের প্রতিনিধি নন? সায়েন্স ফিকশন শুধু গ্রহান্তরের ব্যাপার, কালান্তরের নয়?
আগন্তুক সত্যজিতের সেই আরব্ধ এলিয়েন, ১৯৯১-এই লিখেছিলেন গাস্তঁ রোবের্জ। বঙ্কুবাবুর বন্ধু রচনার প্রায় কুড়ি বছর পর, ’৮১-র জুলাইতে সত্যজিৎ গল্পের খোলস বদলে ‘অতিথি’ হিসেবে যাকে ফিরিয়ে এনেছেন, তিনিই অ্যাং। পত্রিকায় না ছাপিয়ে, সরাসরি আরো বারো বইতে নিয়েছেন। পরের বছর এক সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে বলেছেন এলিয়েন ছবি সম্পর্কে, অতিথি-র ব্যাপারে চুপ। মনোমোহন মিত্র বা সত্যজিৎ রায়— নামে কী-ই বা আসে যায়— হলেন ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং।
রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, আইআইএম লখনউ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy