রাজাধিরাজ: তাড়োবার অন্দরে বিশালাকার ‘ছোটা দাড়িয়েল’। নীলাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়।
সাফারির জিপে চড়ে জঙ্গলে বাঘ খোঁজার রোমাঞ্চ আর জঙ্গলের কাছের মনুষ্যবসতিতে হঠাৎ বাঘের গতিবিধি টের পাওয়ার আতঙ্কের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। এক বার সেই আদিগন্ত ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম। রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্ক থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে বিশাল প্রান্তরে ঝাঁক বেঁধে রয়েছে কয়েকটি হোটেল-রিসর্ট। তার সামনের পতিত জমিটা আগাছায় মোড়া। ভরসন্ধেতেই ঘুটঘুটে সেই মাঠের ধারে ব্রেক কষলেন জিপসি-চালক। আমরাও নাকে বিকট পচা গন্ধটা পেলাম। মড়ি রয়েছে কাছেই। বাতাসে মৃত্যুর তাজা ঘ্রাণ।
লোকবসতি, পর্যটক-আবাস থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে সেই শিকার বাঘের না লেপার্ডের— দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন স্থানীয়েরা। তবে, সাবধান থাকতে বলছিলেন। জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় সন্ধে নামলে বাঘ হানা দেয়। গরু-মোষের তল্লাশে।
তাড়োবা-অন্ধারী টাইগার রিজ়ার্ভে গিয়ে আবার সেই বিপদকে হাতেনাতে ধরলাম। থিকথিকে বনের ভিতর সরু পথ। সে রাস্তার এক দিকে ঘোরে তাগড়াই পুরুষ বাঘ ওয়াই-মার্ক। অন্য পাশে ওয়াঘদোহ্-র ছেলে শম্ভুর রাজত্ব। যে রাস্তায় জিপসি সামান্য গতি কমালেই বুক কাঁপে, সেই তল্লাটেই মাটিতে দাঁড়িয়ে তেন্দুপাতা তুলছিলেন দুই গ্রামবাসী!
দু’ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার খবর পেয়েছি পরে। রণথম্ভোরের ওই স্পটের কাছেই বাইক-আরোহীকে থাবা মেরে রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল বাঘ। আর তাড়োবার রামদেগি এলাকায় তেন্দু-সংগ্রাহকদের তেড়ে গিয়েছিল ঝরনি বাঘিনির মাথা-গরম ছানা।
প্রশ্ন হল, বাঘেরা ইদানীং মানুষের এত কাছাকাছি আসছে কেন? উত্তর মিলবে কাল বিশ্ব বাঘ দিবসের (২৯ জুলাই) অনুষ্ঠানগুলিতে, প্রোজেক্ট টাইগারের সাফল্যের চোখধাঁধানো খতিয়ানে। সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের তির-বল্লম, দোনলা, রাইফেলের তাণ্ডবে ধরিত্রী ব্যাঘ্রশূন্য হতে বসেছিল, তাই ১৯৭৩ সালে ভারত সরকার ‘প্রোজেক্ট টাইগার’-এর আওতায় বাঘ সংরক্ষণ শুরু করে। তারই সুফলে, স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির গণনা মোতাবেক, গত দশ বছরে দেশের বনে বাঘ বেড়েছে ৭৫%, বিশ্বের বাঘসংখ্যার ৭৫%-ই ভারতে। ২০২৩-এর হিসাবে, ব্যাঘ্রকুলের সদস্য সর্বাধিক ৩৯২৫ পর্যন্ত হতে পারে। এই সুখবরেই অশুভের সঙ্কেত দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, এত বাঘের থাকার জায়গা দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নেই। তাই, তারা বন থেকে বেরিয়ে পড়ছে। মানুষ মারছে এবং মানুষের কারণে মারাও পড়ছে।
প্রোজেক্ট টাইগার-এর কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণেই বাঘ আর মানুষ আজ এমন সম্মুখসমরে। সরকারি হিসাবেই ১০-১২টি বনের বাঘসংখ্যা তার ধারণক্ষমতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ২০১৯-এ এক সূত্র দাবি করেছিল, মোট বাঘের অন্তত ১৫% ঘুরছে রিজ়ার্ভড ফরেস্টের বাইরে, অন্য জঙ্গল বা বনাংশে!
আসলে বাঘ সাঙ্ঘাতিক ‘টেরিটোরিয়াল’ পশু। একটি পুরুষ বাঘ প্রায় ৬০-১৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকে। বাঘিনির প্রয়োজন ২০-৬০ বর্গকিমি। সেই এলাকায় নিজের পরিবারের বাঘকেও থাকতে দেয় না এরা। জ়ালিম, বজরং, ভীমা প্রভৃতি ভীতিপ্রদ বাঘ পর্যন্ত এলাকা দখলের মারপিটেই মারা গিয়েছে। নতুন এলাকার সন্ধানে এক-দেড় বছরের তরুণ বাঘেরা ভীষণ ‘স্ট্রেস’-এ থাকে, সেই সময় জঙ্গলে দু’পেয়েদের দেখলে ভাবে, তারাও প্রতিদ্বন্দ্বী! সেই রাগ থেকেই ঝরনির ছানা তেন্দু-সংগ্রাহকদের তাড়া করেছিল। এলাকা, খাবারের অভাবে বাঘ লোকালয়ে যাচ্ছে বা আরও দাপুটে বাঘ তাদের মেরে বন থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। স্থান-সঙ্কট মেটাতে বন দফতর সংরক্ষিত বনের এলাকা ও সংখ্যা বাড়াতে বনের অভ্যন্তরের গ্রামগুলির স্থানান্তর করছে।
তাড়োবার এক বাঘবিশারদ বললেন, স্থানান্তর প্রক্রিয়াতে বহু গলদ। কোর এরিয়ার (গভীর বন) গ্রামবাসীদের সরাতে হলে অর্থ, বাসস্থানের সঙ্গে বিকল্প পেশারও বন্দোবস্ত করতে হবে। কারণ, এঁরা বনসম্পদের ভরসায় জীবনধারণ করেন। বাঘ-পর্যটন শিল্পে বা নাগরিক পেশাগুলিতে তাঁদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগও আছে। কিন্তু, সেখানে তাঁদের নিয়োগের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তো দূর, বিকল্প জীবিকাগুলি সম্পর্কে বিশদে তথ্যও নাকি দেওয়া হয় না। পুনর্বাসনের মানও খারাপ। আবার, অরণ্যবাসীদের থেকে নেওয়া জমিগুলিকে সুপরিকল্পিত ভাবে পুনঃ-অরণ্যায়নও করা হয় না সব সময়। অভাব থেকে যায় ঘাসজমির। তৃণভোজীদের খাবারে ঘাটতি হয়। তারা তখন খেতের ফসল চুরি করতে গ্রামে ঢোকে। আর তাদের পিছু নিয়ে আসে বাঘ।
এখান থেকেই শুরু অন্য ঝামেলার। বাফার অর্থাৎ জঙ্গল যেখানে গ্রামাঞ্চলে মিশছে, সেখানকার বাসিন্দারা কৃষক অথবা বনজীবী। জ্বালানি, মহুয়া, তামাকশিল্পের তেন্দুপাতা সংগ্রহে বনে যান। অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার, বিকল্প কুটিরশিল্প ও জীবিকা সম্পর্কে সচেতনতা হয়তো এই ঝুঁকি কমাবে। কিন্তু, ঘরের পাশের খেতও যে বিভীষিকা। ‘বিভিন্ন কারণে হঠাৎ ভূমিহীন’দের অনেকেই করোনার পর দূরে কাজ করতে যাওয়ার বদলে আশপাশের জমিতে দিনমজুরি করছেন। দারিদ্রের ফলে শীর্ণকায়, অপুষ্ট তাঁরা। যখন ঝুঁকে চারা পোঁতেন বা উবু হয়ে বসে তুলো তোলেন, বাঘ ছোট পশু ভেবে আক্রমণ করে। মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুরের কিছু স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন, ফি-বছর এমন ‘ভুল’ হামলায় গড়ে ২০-৩০টি প্রাণ বলি যাচ্ছে। খেতে বুনো শূকর ঢুকছে বলে মাচানে বসে রাতপাহারা দিচ্ছিলেন এক চাষি। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে নীচে নামতেই ঝোপ থেকে লাফিয়ে বেরোল ডোরাকাটা যমদূত!
এই সংঘর্ষে শ্বাপদেরও সঙ্কট। বৈদ্যুতিক বেড়া বসিয়ে, মড়িতে বিষ মিশিয়ে, পিটিয়ে বাঘ মারার ঘটনা গত দশকেও শোনা গিয়েছে। এখনও বাঘের হামলার পরে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ দেখলেই অসন্তোষের মাত্রা বোঝা যায়। আপাত-সমাধানে বিশেষজ্ঞদের মত, যতই এআই ক্যামেরা বসুক, গ্রামে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎও প্রয়োজন। জোরালো আলো জ্বাললে বন্যরা হয়তো দূরে থাকবে। শৌচাগার থাকুক বাড়ির অন্দরমহলে। মাটির ঘরের উঠোন থেকে নেমে কয়েক পা গেলে শৌচালয়। সেখানে রাতে বাঘ এসে অপেক্ষা করছে, এই উদাহরণও আছে। তা ছাড়া, এক জঙ্গল থেকে বাঘ যাতে অন্য জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য চাই নিরাপদ বাঘ-করিডর।
আগে দেশের বনগুলি অরণ্যের আচ্ছাদন দিয়ে একে অপরের সঙ্গে জোড়া ছিল। সেই আড়াল দিয়ে সুন্দরবনের বাঘ কাজিরাঙা পর্যন্ত চলে যেত। ডিএনএ-র স্বাস্থ্যকর আদানপ্রদান হত। নগরায়নের আগ্রাসনে সেই পথগুলি বিচ্ছিন্ন, মানুষের আনাগোনায় সরগরম। এ সব পথে বাঘেরা তড়িদাহত হচ্ছে, ট্রাক-লরির ধাক্কায় আহত হচ্ছে। গত সপ্তাহেই মধ্যপ্রদেশে রেলে কাটা পড়েছে বাঘ। রণথম্ভোরের বিখ্যাত বাঘ ব্রোকেন টেল-কে জঙ্গল থেকে বার করে দিয়েছিল অন্য বাঘেরা। তার লাশ মিলেছিল ১০০ মাইল দূরের রেললাইনে। এই দুর্ঘটনার পরে পশু চলাচলের বনাংশগুলিতে সড়ক, রেলরাস্তাকে সেতুর মতো উপরে রেখে, নীচে অরণ্যপরিবৃত আন্ডারপাস তৈরিতে জোয়ার আসে, যাতে পশু সেই রাস্তায় যেতে পারে। তার পরেও বাঘ কেন হাইওয়েতে উঠছে— কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় ওই জঙ্গুলে আন্ডারপাসকে শর্টকাট হিসাবে ব্যবহার করছেন মানুষ! এই কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরেই স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে ভয়াল বাঘিনির সন্ধান মেলে মহারাষ্ট্রের ইয়বতমাল জেলার বনাংশে। অন্যায় ভাবে মানুষখেকো বলে দাগিয়ে পান্ধারকাওয়াড়ার অবনী বাঘিনিকে মেরে দেওয়া হলেও আজও অনেকের বিশ্বাস, অবনী একা ওই এলাকার হত্যাকারী ছিল না।
বাঘের জীবনধারায় ব্যাঘাত করছে বনকর্মীদের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ। পর্যটকদের প্রিয় বাঘ, বাঘিনিকে দীর্ঘায়ু করতে বনদফতর আধুনিক চিকিৎসা করায়। উস্তাদ যে রণথম্ভোরের ত্রাস হয়ে উঠেছিল তার মূলে ছিল বনকর্মীদের মারাত্মক ভুল। সামান্য পায়ের চোটের জন্য তিন বছর বয়সে উস্তাদকে ঘুম পাড়িয়ে ৪৮ ঘণ্টা ধরে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা চলে! রেডিয়ো কলার পরানোর সময় হঠাৎ সে জেগে উঠে বনে পালায়। পরে কলার বিকল হলে আবার তাকে ঘুম পাড়িয়ে ধরে আনা হয়। এর পরই মানুষ দেখলে সংহারমূর্তি ধরে বাঘটি। বয়স্ক বা আহত বাঘ শিকারে অক্ষম হলে গবাদি পশু জোগানোও ঠিক নয়। বাঘটি এর পর গরু-মোষের লোভে লোকালয়ে ঢুকবে। এরই পরের ধাপ মানুষকে আক্রমণ।
প্রতিকূলতা, আবহাওয়ার কারণে সুন্দরবনের বাঘেদের আচরণ নাকি বাকি দেশের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। তাই বাদাবনের দক্ষিণ রায়ের আলোচনা আলাদা রাখতে পরামর্শ দেন সংরক্ষণবিদেরা। তবুও, তাদের ধরেই বলা হয়, মানুষ বাঘের স্বাভাবিক আহার্য নয়। কারণ মা শৈশবে বাঘকে যা খাওয়ায় বা শিকার করতে শেখায়, সেই তালিকায় মানুষ নেই। বিনা কারণে, প্ররোচনা ছাড়া বাঘ মানুষকে আক্রমণও করে না। জিম করবেট বলেছিলেন, বাঘ এক বিশাল হৃদয়ের ভদ্রলোক। আক্ষেপের বিষয়, বাঘবন লাগোয়া কিছু জনপদের মানুষরা বলছেন, এই মহানুভব রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের স্বভাবই নাকি গত পাঁচ দশকে বদলে গিয়েছে। আগে বাঘ দেখা দিলে লোকজন একজোট হয়ে গর্জন করলে, লাঠি ঘোরালে পশু লুকিয়ে পড়ত। এখন নাকি দিনেমানেও ভারী দলের মধ্য থেকে মানুষকে তুলে নিতে ডরায় না। দু’পেয়েরা যে আসলে হরিণশাবকের চেয়েও ভীরু ও দুর্বল, বারে বারে কাছাকাছি আসার দরুন সেই খবর বনের পশু জেনে গেলেই যে বিপদ।
১০,০০০ বাঘের ম্যাজিক সংখ্যায় পৌঁছতে বেশি দেরি নেই। কিন্তু, সভ্যতা ও আদিম প্রকৃতি: দুই পরস্পরবিরোধী শক্তির মধ্যে সম্মানজনক সন্ধির শর্তগুলি কী ভাবে বণ্টিত হবে, তার উপর নির্ভর করবে প্রোজেক্ট টাইগারের সত্যিকারের সাফল্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy