Advertisement
E-Paper

বিজ্ঞানশিক্ষার করুণ হাল

বাস্তবিক, পাহাড় থেকে সাগরে, শহর থেকে গ্রামে, অসংখ্য ছোট-বড়-মাঝারি স্কুলে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হয় শিক্ষার এমন কিছু অধিকার, যা অধিকাংশ মানুষের কাছে অজানাই থেকে যায়।

পুলক রায় চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:৫১
Share
Save

সবে জানা গেল, বিজ্ঞান গবেষণায় বিশ্বে কলকাতা কতখানি উল্লেখযোগ্য, অগ্রগণ্য। এ দিকে এই রাজ্যে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ থেকে কত ছাত্রছাত্রী বঞ্চিত, তার হিসাব নেই। বাস্তবিক, পাহাড় থেকে সাগরে, শহর থেকে গ্রামে, অসংখ্য ছোট-বড়-মাঝারি স্কুলে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হয় শিক্ষার এমন কিছু অধিকার, যা অধিকাংশ মানুষের কাছে অজানাই থেকে যায়। শিশুর প্রাপ্য অধরা থাকে। স্কুলের শ্রেণিকক্ষ থেকে শুধু কমে যেতে থাকে পড়ুয়ারা। ট্যাবের টাকা কোথায় গেল, অথবা মিড-ডে মিলে কোথায়, কত কারচুপি হল, এই সব বহুচর্চিত প্রশ্নের বাইরে থেকে যায় এগুলি, আরও বড় প্রশ্ন।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ডানায় ভর করে অন্যান্য দেশের শিশু-কিশোররা যখন যুক্তি-তর্কের সিঁড়ি বেয়ে বিজ্ঞানের আশ্চর্য নানা কক্ষ আবিষ্কার করে চলেছে, তখন আমাদের শিশু-কিশোররা নড়বড়ে বেঞ্চে বসে, সাদাটে ব্ল্যাকবোর্ডে একঘেয়ে সূত্র-সমীকরণ-সংজ্ঞা দেখতে দেখতে ক্লান্ত, ম্লান হয়ে থাকছে। শিশু-কিশোর মননে কতটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হল, যা প্রতিফলিত হতে পারত জাতির জীবনে— তা কে ভাবছে? বিজ্ঞান-শিক্ষার সুফল পেল কি তারা, না কি অন্ধ উপভোক্তার মতো ইন্টারনেট আসক্তিতেই মগ্ন রইল?

সেই অন্যমনস্কতা, উপেক্ষার সুযোগে বিজ্ঞান-শিক্ষার পরিসর সঙ্কুচিত হচ্ছে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলে বিজ্ঞান শাখায় পড়ুয়ার সংখ্যা যেখানে তিন লক্ষ, ২০২৪ সালে সেই পড়ুয়ার সংখ্যা কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে এক লক্ষে (১,০৫,৮১০)। রাজ্যের কলেজগুলোতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যার মতো বিষয়ে ‘সিট’ ফাঁকাই পড়ে থাকছে। গোটা দেশের ছবিটাও আশাজনক নয়— দশম শ্রেণির পর মোট পড়ুয়ার মাত্র ১৫-১৭ শতাংশ ভর্তি হচ্ছে বিজ্ঞান শাখায়। ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে বিজ্ঞান-শিক্ষায় পড়ুয়াদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ রাজ্যের স্কুলগুলির প্রধানদের চিঠি পাঠিয়ে আবেদন করে, ক্লাসে বিজ্ঞান-শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো হোক। তাতে কাজ হয়নি। ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্রছাত্রী কলাবিভাগ থেকেই বেশি।

২০২১ সালে মাধ্যমিক-উত্তীর্ণদের মাত্র ১০ শতাংশ (৮০ হাজার) বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে আবার গণিত-সহ বিজ্ঞান পড়তে চায় মাত্র ২০ হাজার ছাত্রছাত্রী। গণিতে অনীহার কারণগুলি খুঁজে বার করার দায়িত্ব কি রাজ্য শিক্ষা দফতরের নয়? সামাজিক অসাম্যের প্রশ্নও ওঠে। গণিত-সহ বিজ্ঞানে ভাল নম্বর পাচ্ছে যারা, তাদের কত শতাংশ গ্রামের ছেলেমেয়ে? গ্রামাঞ্চলের কতগুলো সরকারি স্কুলে নতুন করে বিজ্ঞান-শাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে? বিজ্ঞান-শিক্ষকের অভাবে কতগুলো স্কুলের বিজ্ঞান শাখার অনুমোদন বাতিল হয়েছে? কতগুলো স্কুলে নতুন করে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি তৈরি হয়েছে?

উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ, পড়াশোনার খরচ। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইলে আগে চাই ভাল প্রাইভেট টিউটর। কিন্তু কেন? আর যদি বা বিজ্ঞান-শিক্ষার খরচ বেশি হয়, স্কলারশিপের ব্যবস্থা কি করা যায় না?

চারটি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে শিক্ষাব্যবস্থা, সিলেবাস, পাঠ্যবই, শ্রেণিকক্ষের অনুশীলন, মূল্যায়ন ব্যবস্থা। বিজ্ঞান-শিক্ষকদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস সর্বভারতীয় সিলেবাসকে অনুসরণ করে তৈরি হলেও, রাজ্যের নবম-দশম শ্রেণির সিলেবাসের সঙ্গে একাদশ-দ্বাদশের সিলেবাসের বিস্তর দূরত্ব। সিবিএসই বা আইসিএসই বোর্ড তাদের সেকেন্ডারি সিলেবাস, শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি যতটা উচ্চ মাধ্যমিক সিলেবাসের মূল্যায়ন পদ্ধতির কাছাকাছি আনতে পেরেছে, এ রাজ্যে সে দিকে অনেকটাই ফারাক থেকে গিয়েছে, বিশেষত বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে। অনেকে মনে করছেন, মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক নম্বর বাড়ানোর দিকেই জোর থাকছে বেশি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত শিখন-দক্ষতা (লার্নিং আউটকাম) কতটা তৈরি হচ্ছে, সে দিকে নজর থাকছে না। যার ফলে দেখা যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাসের অভাব, উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার অনীহা।

আইনি জটিলতায় রাজ্যের স্কুলগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ স্থগিত রয়েছে দীর্ঘ দিন। এর সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে বিজ্ঞানের পঠনপাঠনে। প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান-শিক্ষকের ঘাটতি বেশি। পার্ট টাইম শিক্ষক দিয়ে স্কুলগুলি কোনও রকমে চলছে। রাজ্য শিক্ষা দফতর কয়েকটি স্কুলকে আট-দশ বছর অন্তর বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরির সামান্য অনুদান দেয়, অধিকাংশ স্কুলের ল্যাবরেটরির অনুদান বন্ধ। চার্ট, মডেল, শিখন-সহায়ক সামগ্রী কেনার জন্য সমগ্র শিক্ষা প্রকল্প থেকে পাওয়া ‘স্কুল কম্পোজ়িট গ্রান্ট’-ও এক বছর হল বন্ধ রয়েছে। সায়েন্স কংগ্রেসে অংশগ্রহণ কমছে স্কুলগুলির। শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) ছাত্র-শিক্ষকের যে অনুপাত নির্দিষ্ট করেছিল, অধিকাংশ সরকারি স্কুলে তা নেই। শিক্ষকের অভাবে বহু স্কুলে বিজ্ঞানের পঠনপাঠন বন্ধের মুখে। এ রাজ্যে নব্বই শতাংশ স্কুলে ইন্টারনেট, মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার নেই, বিদ্যুৎ-ও সব সময়ে থাকে না।

গবেষকদের সংখ্যার অনুপাতের নিরিখে ভারতের অবস্থান বিশ্বে ৮১তম স্থানে। প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানীদের সংখ্যা গড়ে চার হাজার, এ দেশে মাত্র ২৬০ জন! এই অচলায়তন ভাঙবে কী ভাবে?

প্রধান শিক্ষক, হিঙ্গলগঞ্জ, সুন্দরবন

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Laboratory Science school Education system Students

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy