ইলাহাবাদের নৈনি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন জওহরলাল নেহরু একগুচ্ছ চিঠি লেখেন বালিকা ইন্দিরাকে। ১৯২৯, ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির দাবি জানানোর অপরাধে নেহরু তখন বন্দি। তিনি গল্পচ্ছলে লিখছেন আধুনিক মানুষের সভ্যতা কী ভাবে শ্রমবণ্টন ব্যবস্থা চালু করে ‘লিডার’ তৈরি করে, যে পরে ভৌগোলিক সীমা নির্দিষ্ট করে শাসক হয় এবং সেই সঙ্গে তৈরি হয় তার কিছু অনুচর ও স্তাবক। এই স্তাবকেরা একে অন্যের থেকে এবং শ্রমিকদের থেকে কিছু বেশি সুবিধে পেতে শাসককে ঘুষ দিতে শুরু করে, দুর্নীতির যাবতীয় সূত্রপাত সেখান থেকেই। হোমারের মহাকাব্যে সাধারণ মানুষ থেকে দেবতাদের পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার কথা আছে। ছল-চাতুরি-কপটতার বর্ণনা রামায়ণ ও মহাভারত-এও প্রচুর। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে অপরাধীকে হত্যার সময় যাতে কষ্ট কম দেওয়া হয়, সে কারণে জল্লাদকে ঘুষ দেওয়ার চল ছিল। হাজার হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীতে শাসককে সন্তুষ্ট রাখতে এবং অন্যের থেকে কিছু বেশি সুবিধে পেতে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি।
আমাদের কর ব্যবস্থায় দু’রকমের কর আছে, প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ করের হিসাব সরাসরি, আয় থেকে মুষ্টিমেয় লোক দেয়; কিন্তু পরোক্ষ করের আওতায় দেশের প্রত্যেকটি মানুষ আসে, জিনিস কিনলেই তার জন্য কর দিতে হয়। করের মতোই দুর্নীতিও দু’রকমের, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। দুর্নীতির মধ্যে দুটো ক্ষেত্র খুব সংবেদনশীল— ঘুষ বা চুরি, এবং যৌনতা সংক্রান্ত ব্যাপারস্যাপার যেমন পরকীয়া, ধর্ষণ ইত্যাদি, বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা ‘সেলেব্রিটি’ যদি জড়িয়ে থাকে। ছোটখাটো দুর্নীতির ঘটনায় জনগণের আদালতে আগে বিচার ও শাস্তি হয়, পরে আইনরক্ষকের হাতে সমর্পণ— যদি সে জীবিত থাকে। রাজনীতিক ও সেলেব্রিটিদের দুর্নীতির ঘটনার অনুসন্ধান দুর্নীতি-সন্ধান এজেন্সি দ্বারা শুরু হলেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-ও শুরু হয়ে যায়, জনগণ প্রভাবিত হয়। প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ভাবে বেকায়দায় ফেলতে এবং বিশেষত জনরোষ তৈরি করতে আমাদের দেশে চুরির অপবাদ দাগিয়ে দেওয়া একটা মস্ত সহায়। সত্যি-মিথ্যে যাচাইয়ের আগেই অভিযুক্ত ‘প্রায় দোষী’ সাব্যস্ত হয়ে যায়।
কখনও বফর্স কেলেঙ্কারিতে রাজীব গান্ধী, টু-জি’তে মনমোহন সিংহ, আর এখন তো সনিয়া-রাহুল থেকে প্রধানত বিজেপি-বিরোধী দলের সব নেতার নামেই রাজ্যে রাজ্যে চলছে চুরির হাঙ্গামা। আমাদের রাজ্যে কয়েক দশক ধরে একাধিক চিট ফান্ড নানা সময়ে মিডিয়া থেকে চায়ের দোকানে তুফান তুলেছে। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, প্রায় কোনও চুরির অভিযোগই কখনও প্রমাণিত হয় না। এ থেকেই চলে আসে নিম্নরুচির রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও প্রতিশোধের ভাবনা। গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রের প্রশাসক তাদের নানা এজেন্সি দ্বারা বিরোধী রাজ্যের মন্ত্রী-নেতাদের বিরুদ্ধে ‘টার্গেটেড’ দুর্নীতির অভিযান চালাচ্ছে এবং সফলও হচ্ছে। একাধিক নেতা-মন্ত্রীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হচ্ছে, জেলেও যাচ্ছেন তাঁরা। স্বাভাবিক ভাবেই জনগণ খুশি, অথচ একই সঙ্গে আরও নানা ধরনের দুর্নীতি কেন্দ্রের সরকারও করে যাচ্ছে, যার সঙ্গে কোটি কোটি টাকা জড়িয়ে আছে বলে অনুমান করা হয়। যেমন— অ-বিজেপি রাজ্যে বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকারের পতন, রাজনৈতিক ও আরও নানা হিসাব-বহির্ভূত ফান্ড ইত্যাদি। টাকা চুরির ব্যাপারটাই কী রকম গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।
কত কোটি টাকা চুরি হলে সেটাকে চুরি বলে সাব্যস্ত করা যাবে? প্রত্যক্ষ চুরির মধ্যে রয়েছে ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, লুট, সরাসরি ঘুষ নেওয়া ইত্যাদি। পরোক্ষ চুরির রূপ হরেক, টাকা ছাড়াও কাজ, জল, সময়, আরও কত কী। এ সবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অধিকাংশ। গত প্রায় ছয় দশক ধরে দেখে আসছি— হয়তো তার আগেও ছিল— কত রকমের চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে প্রচুর মানুষ যুক্ত, অথচ সেগুলো এতই স্বাভাবিক যে, তাকে চুরি বলে মনেই হয় না। কারণ এখানে সরাসরি টাকা চুরি হচ্ছে না, কিন্তু ঘুরপথে নানা সুবিধা নেওয়া হচ্ছে যার হিসাব হয় টাকায়। যেমন, যারা নিয়মিত দেরিতে অফিস যায় বা আগে বেরিয়ে আসে, কাজে ফাঁকি মারে, ছুটির দরখাস্ত ছাড়াই গরহাজির, টুরে না গিয়ে বা গিয়েও কম সময় থেকে বিল জমা দেয়, বিভাগের স্টোরে জিনিস কেনার সময় অর্থ বা দ্রব্যের বিনিময়ে কমিশন নেয়, বন্ধ পালন করে ইত্যাদি। তারাও আসলে টাকা-ই চুরি করছে। এ ভাবে একটা লোক সারা জীবনের চাকরিতে কত লক্ষ টাকা চুরি করল, তার হিসাব কে জানবে।
বামপন্থী জমানায় ‘আসি-যাই মাইনে পাই’ স্লোগান এই চুরিকেই স্বীকৃতি দেয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই সরকারি বা বেসরকারি কাজে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্যে ঘুষের প্রচলন ছিল, যা পরে ডাক বিভাগের প্রচলকথা তুলে এনে প্রচলিত হল ‘কুইক-সার্ভিস মানি’ এবং ‘স্পিড মানি’ নামে, বাম আমলেই। সাধারণ মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হতেন, নইলে কাজ হবে না। যাঁরা দিতেন না তাঁরা ভুগতেন। সরকারি চাকরিতে মেডিক্যাল পরীক্ষায় প্রার্থী যাতে না আটকায় সে জন্য স্বাস্থ্যকর্মীকে সিগারেটের প্যাকেটে বা মিষ্টির প্যাকেটে টাকা দেওয়ার এক প্রকার অঘোষিত বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই টাকা ডাক্তারবাবুদের হাতে পৌঁছত কি না, জানা যেত না। চাকরির ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থা ছিল বলে শোনা যেত। ভোগ না চড়ালে পুজো হয় না, এটাই ছিল কথা— সে মহাকরণ বা পুরসভা হোক বা হাসপাতাল, কিংবা অন্য সরকারি অফিস। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হল দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিশাল অঙ্কের টাকা ডোনেশন দিয়ে স্কুল বা ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পড়ার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা। সেই প্রমাণহীন ‘ডোনেশন’-এর কোনও হিসাব থাকত না। তা-ও মানুষ মেনে নিয়েছে। শহর থেকে অনেক দূরে বিশাল জমির উপর ঝাঁ-চকচকে বাহারি ইমারত বানিয়ে কত হাজার কোটি টাকা তখন লুট হয়েছে তার হিসাব পাওয়া যায় না। আমাদের রাজ্য থেকেও ছাত্রেরা গিয়েছে, মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা মানিয়ে নিতে না পেরে ক্ষতি সয়ে ফিরে এসেছে। বাংলায় এ ধরনের স্কুল-কলেজের ‘ব্যবসা’ অনেক পরে হলেও শুরু হয় ধুমধাম করেই, কিন্তু নিম্নমানের শিক্ষকতার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে যায়। বাম আমলে নেতা গোছের শিক্ষকের ভাই-বেরাদর আত্মীয়দের অনেকেই শিক্ষক হয়ে স্কুলের চাকরিতে ঢুকেছিলেন, সেও কি সত্য নয়? যোগ্যতার মাপকাঠি কী ছিল কে জানে, তবে মাইনের একটা ভাল অংশ পার্টি ফান্ডে দিতে হত বলে শোনা যেত। তাঁদের হাতে শিক্ষিত হয়েছে পরের প্রজন্ম। সেই শিক্ষার ফল বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রাইভেট কলেজগুলো।
মানুষের রিপুগুলো খুব শক্তিশালী ও সক্রিয়। অন্য দিকে আছে সংযম ও শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তোলা মন। এই দুই বিপরীত স্বভাবের মধ্যে চলে অবিরাম যুদ্ধ। অশুভ শক্তিকে দমিয়ে রাখাটাই সভ্যতার মাপকাঠি। যে ব্যক্তি, সমাজ, শাসক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যত বেশি সংযমের পরিচয় বহন করে, সে বা তারা তত সভ্য। দুঃখের কথা, আজ সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে জনগণকে দুর্নীতির খবর পাতে বেড়ে দেওয়ার এক রকম প্রতিযোগিতা চলছে। শিশু-কিশোর মনে সমাজ সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা হচ্ছে। এও এক ধরনের পরোক্ষ দুর্নীতি। অথচ এই সমাজেই কত সংস্কৃত, রুচিশীল মানুষের বাস, যাঁরা প্রায় অনালোচিত। আলোহীন পৃথিবীতে নির্বংশ হয়েছিল বিরাটকায় ডাইনোসররাও, সভ্য জগৎকে অন্ধকারে ঢেকে রাখলে পুরো মানবসভ্যতাই সেই ধ্বংসের অভিমুখে এগিয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy