Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Tuberculosis

যক্ষ্মা নির্মূল করার খরচ

যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য ছিল চিকিৎসার খরচ কমানো। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে রোগ শনাক্ত হতে দেরি হয়, চিকিৎসা শুরু হতে এবং রোগ নিরাময় পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ জোগাতে দেরি হয়।

জয়ন্ত ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৪ ০৮:০৫
Share: Save:

যক্ষ্মামুক্ত ভারত দেখা যাবে ২০২৫ সালে, এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পূর্বঘোষিত লক্ষ্য ছিল ২০৩০। কিন্তু ২০১৮ সালে দিল্লিতে ‘যক্ষ্মার বিনাশ’ (‘এন্ড টিবি’) সম্মেলনে মোদী ঘোষণা করেছিলেন, পাঁচ বছর আগেই ভারত লক্ষ্যপূরণ করবে। কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এই অঙ্গীকার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশ্বের ২৭ শতাংশ যক্ষ্মা রোগীর বাস ভারতে। প্রচলিত ওষুধ-প্রতিরোধী (মাল্টি-ড্রাগ রেজ়িস্ট্যান্ট) যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যাতেও ভারত বিশ্বের শীর্ষে। ভারতে অন্তত সাড়ে বাইশ লক্ষ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত— প্রতি তিন মিনিটে দু’জন প্রাণ হারান এই রোগে। এই বিপর্যয় থেকে যক্ষ্মাশূন্য ভারতে উত্তরণের মোদী-ঘোষিত সময়সীমায় পৌঁছতে বাকি আর কয়েকটি মাস। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি কী রকম?

যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য ছিল চিকিৎসার খরচ কমানো। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে রোগ শনাক্ত হতে দেরি হয়, চিকিৎসা শুরু হতে এবং রোগ নিরাময় পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ জোগাতে দেরি হয়। যক্ষ্মা রোগীদের কত খরচ বহন করতে হয়, সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সমীক্ষা করে। তার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় নেচার পত্রিকায় (১১ জানুয়ারি, ২০২২)। তাতে বলা হয়, যক্ষ্মার চিকিৎসার জন্য রোগীর পরিবারের খরচ যদি তার বাৎসরিক আয়ের কুড়ি শতাংশের বেশি হয়, তা হলে তাকে ক্যাটাস্ট্রফিক এক্সপেন্ডিচার বা বিপর্যয়কর খরচ বলা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য, ‘যক্ষ্মার বিনাশ’ প্রকল্পের মাধ্যমে বিপর্যয়কর খরচকে শূন্য-তে নামিয়ে নিয়ে আসা। নেচার-এর রিপোর্টে বলা হয়, জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা রোগীদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার তদারকি করবে, এবং চিকিৎসার খরচ যাতে কমানো যায়, তার জন্য হস্তক্ষেপও করবে।

‘সকলের জন্য চিকিৎসা’ নীতি অনুসারে যক্ষ্মা রোগীকে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব; এবং, যক্ষ্মার জন্য পরিবারের খরচের খুঁটিনাটি জানতে হবে সরকারকে। ভারতের চারটি রাজ্যের (অসম, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গ) টিবির চিকিৎসায় ওষুধে সাড়া দিচ্ছেন, এ রকম ১৪৮২ জন রোগীকে নিয়ে সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগে পরিবারগুলির গড় আয় ছিল ২০,৩৮১ টাকা। শহরের বস্তিবাসীদের ক্ষেত্রে ১৬,৯৮৪ টাকা, এবং চা বাগানের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৯,৫০৬ টাকা। চিকিৎসা শুরু হওয়ার পরে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আয় কমেছে। যক্ষ্মা রোগীদের খরচের মধ্যে ডাক্তারের ফি, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ ছাড়াও রয়েছে চিকিৎসা এবং ওষুধ নেওয়ার জন্য যাতায়াতের খরচ, রোগীর সঙ্গীদের খাওয়াদাওয়ার খরচ, ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রেই যে সবের মিলিত অঙ্ক পরিবারের রোজগারের ষাট শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

অতীতে (কেমোথেরাপির আগে) স্যানাটোরিয়াম-নির্ভর চিকিৎসার যে মডেলটি ছিল, সেটি এখন ডটস প্রোগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে। আগের নিয়মে রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্য, নিয়মিত চিকিৎসা জোগানো হত হাসপাতাল থেকেই। ডটস চিকিৎসা রোগীকে ঘরে রেখে চিকিৎসার সুবিধা দিতে পারছে, কিন্তু রোগের মোকাবিলার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে টাকার জোগান। সে ক্ষেত্রে বিকল্পটি কি? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মোটের উপর একমত যে, যেখানে রোগী, সেখান থেকেই চিকিৎসা শুরু হবে। সরকার যদি রোগীর বাড়িতে গিয়ে পুষ্টিকর খাবার, পরিবারের যত্নে থাকা এবং যথাযথ ওষুধের ব্যবস্থা করে চিকিৎসার উদ্যোগ করতে পারে, তা হলে হয়তো খরচের বিভীষিকা থেকে রোগীর পরিবারকে মুক্তি দেওয়া যায়। চেন্নাইয়ের একটি সংগঠন তার পথ দেখিয়েছে। ওই সংগঠনের সদস্যরা রোগীদের আসার জন্য অপেক্ষা না করে বিভিন্ন এলাকায় শিবির বানিয়ে রোগীদের পরীক্ষা ও চিকিৎসা করছে।

সরকারি নীতিতেও এর একটা দিশা যে ছিল না, তা নয়। ২৪ মার্চ, ২০২৩-এ বেনারসে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড টিবি সামিট’-এর পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, ভারতকে যক্ষ্মামুক্ত করার জন্য এর চিকিৎসার সঙ্গে পঞ্চায়েতকে যুক্ত করা হবে। জনস্বাস্থ্যের নিরিখে পঞ্চায়েতকে যুক্ত করা যেতেই পারে, কিন্তু যক্ষ্মা নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য সর্বাধিক প্রয়োজন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। কোভিড-উত্তর ভারতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো খুঁড়িয়ে চলছে। সেগুলির সক্ষমতা বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া বেশি দরকার ছিল।

একটি গালভরা নীতির প্রণয়ন করা সহজ, কিন্তু সেই নীতিকে কার্যকর করার জন্য খুঁটিনাটি বিষয়গুলিকে হিসাবের মধ্যে রাখা কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়া। তবে ভোটের আবহে কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে স্বাস্থ্যই যেখানে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি, সেখানে যক্ষ্মা রোগীর সাধ্যাতিরিক্ত খরচের কথা আর কে মনে রাখে? দারিদ্র, অপুষ্টি এবং সামাজিক চেতনার অন্তরালে-থাকা রোগ যক্ষ্মার মোকাবিলা করার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সরকার, দু’টিরই নিবিড় যোগদান প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

Tuberculosis medical treatment expensive
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy