কল্পনা করুন, আপনি একটি নতুন শহরে হাঁটছেন। সব কিছুই আছে— শপিং মল, পার্ক, ক্যাফে, সিনেমা হল। মানুষ কেনাকাটা করছেন, গান শুনছেন, বই কিনছেন। প্রথম দেখায় মনে হবে, এটি একটি সহজ সাধারণ বাজারব্যবস্থা। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, শহরের প্রতিটি দোকান, প্রতিটি অট্টালিকা আসলে মাত্র এক জন ব্যক্তির মালিকানাধীন। তার চেয়েও বড় কথা, আপনি যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, যে দোকানগুলোর সামনে দাঁড়াচ্ছেন— সবই নির্ধারিত হচ্ছে একটি অদৃশ্য অ্যালগরিদমের মাধ্যমে, যা সেই মালিকের নির্দেশেই চলছে। আপনি যে পণ্যগুলো দেখছেন, তা আসলে আপনার জন্যই সাজানো, অন্য কেউ হয়তো একেবারে ভিন্ন কিছু দেখছে।
এই দৃশ্যপট কিন্তু সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। বরং, এটাই আজকের ডিজিটাল অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। গ্রিসের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী এবং অর্থনীতিবিদ ইয়ানিস ভারুফাকিস তাঁর সাম্প্রতিক বই টেকনো-ফিউডালিজ়ম: হোয়াট কিলড ক্যাপিটালিজ়ম-এ দেখিয়েছেন, আজকের প্রথম বিশ্বের অর্থনীতিকে কেন আর সাধারণ পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থার মধ্যে রাখা চলছে না। এটি এমন এক অর্থনৈতিক কাঠামো, যেখানে বড় কর্পোরেশনগুলো নতুন পুঁজি তৈরির পিছনে তেমন জোর না দিয়ে শুধু বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে মুনাফা করছে। আর আমরা, ব্যবহারকারীরা, নিজেদের শ্রম ও সময় ব্যয় করে তাদের এই ব্যবস্থাকেই আরও শক্তিশালী করে তুলছি— নিজের অজানতেই।
প্রযুক্তি সংস্থাগুলি আমাদের শ্রমের ভিত্তিতে বিপুল সম্পদ তৈরি করছে। একেই ভারুফাকিস বলেছেন ‘টেকনো-ফিউডালিজ়ম’ বা ‘প্রাযুক্তিক সামন্ততন্ত্র’। ধনতন্ত্রের সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের অনেক ফারাক আছে। তার মধ্যে মৌলিকতমটি হল— ধনতান্ত্রিক বাজারব্যবস্থায় নিজের শ্রম, দক্ষতা আর মেধা দিয়ে বাড়ানো যায় ব্যক্তিগত আয়, কিন্তু একই সঙ্গে জারি রাখতে হয় বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইটাও; অন্য দিকে, সামন্ততন্ত্রে অর্থনৈতিক ভাবে উৎপাদনশীল সম্পদের মালিক হলেই খাজনাবাবদ আয় পাওয়া যায়, তার জন্য অন্য কোনও লড়াইয়ের প্রয়োজন হয় না।
মধ্যযুগের সামন্তদের হাতে অর্থনৈতিক সম্পদ হিসাবে থাকত জমি; আজকের বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর হাতে রয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। অ্যামাজ়ন, গুগল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম— এরা নিজেরা তেমন কিছু তৈরি করে না; বরং একটা প্ল্যাটফর্ম বানিয়েছে, অজস্র মানুষ প্রতিনিয়ত যা ব্যবহার করে চলেছেন। এবং, তার থেকেই সংস্থাগুলো খাজনা আদায় করছে। আপনার তৈরি ভাইরাল ইউটিউব ভিডিয়ো, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে ‘লাইক’-কাড়া পোস্ট, অথবা অ্যামাজ়নে বিক্রি করা ঘরে তৈরি চকলেট— সব কিছু থেকেই যা আয় হয়, এই ডিজিটাল সংস্থাগুলি সরাসরি বা ঘুরপথে তার একটি অংশ খাজনা বাবদ পায়।
আপনার ‘কনটেন্ট’ বা পণ্য যত লোকের কাছে পৌঁছবে, আপনার তত লাভ— প্ল্যাটফর্মগুলোরও ততই লাভ। কাজেই বলতে পারেন, এ তো দারুণ ব্যাপার— যে ব্যবস্থায় সবাই লাভবান হয়, সেই তো যথেষ্ট স্বর্গ। আসলে আমরা ভুলে যাই যে, আমরা যে-ই হই না কেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আমরা যতই নিজের কনটেন্ট বেচি না কেন, শেষ অবধি আমরা আসলে ক্রেতা। অথবা, আরও স্পষ্ট করে বললে, আমরা ক্রেতাও নই, আমরাই পণ্য। এত দিনে প্রায় সবাই জানেন, অতিবৃহৎ ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলি আমাদের অনেক তথ্যই বিজ্ঞাপনদাতা বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়মিত বেচে দিচ্ছে। আমাদের তথ্য তাদের হাতে থাকা অর্থনৈতিক সম্পদ— তার থেকে সংস্থাগুলি খাজনা আদায় করে নিয়মিত।
ভারুফাকিস বলছেন, আমরা আসলে ‘ডেটা-সার্ফ’ বা তথ্যভিত্তিক দাস হয়ে গিয়েছি। আমরা প্রতি দিন সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য দিচ্ছি, ছবি আপলোড করছি, মতামত দিচ্ছি। আর এই সমস্ত তথ্য ব্যবহার করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো আরও উন্নত যন্ত্রমেধা বা এআই তৈরি করছে, যা এক সময় আমাদেরই চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। অথবা, এখনই পারছে। যদি আমার প্রতিটি পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তা, কেনাকাটার ধরন, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার তথ্য কেউ জমা করে রাখে, তবে ভবিষ্যতে তারা আমার জন্য কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে? আমি কেমন পোশাক পরব, কী খাব, কী ধরনের খবর দেখব— সব কিছুই হয়তো এআই ঠিক করে দেবে, এবং আমি টেরও পাব না।
পুঁজিবাদীরা ধনী হলে নতুন কারখানা, প্রযুক্তি ও গবেষণায় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক ভাড়া গ্রহীতারা সম্পদ অর্জন করলে সেটি আরও বেশি সম্পত্তি কেনায় ব্যয় করেন, যাতে ভবিষ্যতে ভাড়া বসিয়ে মুনাফা বাড়ানো যায়। প্রযুক্তি সংস্থাগুলো সার্ভার, ডেটা লাইন ও ডিজিটাল পরিষেবার মতো ‘ক্লাউড ক্যাপিটাল’-এ বিনিয়োগ করে, যা ব্যবহার করতে হলে অন্য সবাইকে ভাড়া গুনতে হয়। অ্যামাজ়ন সম্পর্কে ভারুফাকিস তাঁর বইতে বলেছেন, এটি দেখতে একটি উন্মুক্ত বাজারের মতো মনে হলেও, বাস্তবে এটি একটি সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে সমস্ত বিক্রেতাই এক জন সামন্তপ্রভুর অধীন, যিনি প্রতিটি ডলারের ৫১ সেন্ট নিজের কাছে রেখে দেন এবং ঠিক করেন যে, কোন পণ্য বিক্রি করা যাবে এবং কী ভাবে তা বিজ্ঞাপিত হবে। অতএব এই নতুন উত্তর-পুঁজিবাদ বিশ্বে আসলে পুঁজিবাদীরাও, ভারুফাকিসের ভাষায় ‘ক্লাউডালিস্ট’ সামন্তপ্রভুদেরই অধীন। সাধারণ মানুষ সমাজমাধ্যমে যে কনটেন্ট তৈরি করেন, সেটিও শেষ পর্যন্ত এই প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সম্পদ হয়ে যায়। এবং, প্রযুক্তির সামন্তপ্রভুরা যে কোনও মুহূর্তে একটি বোতাম টিপেই যে কোনও ব্যবসাকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। গুগল যদি কোনও সংস্থাকে তার সার্চ ইন্ডেক্স থেকে বাদ দেয়, ফেসবুক যদি কোনও প্রকাশনাকে ব্লক করে, বা অ্যাপল যদি কোনও অ্যাপ সরিয়ে দেয়, তবে সেই ব্যবসা মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যেতে পারে শূন্যে।
এই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এজেন্টিক এআই-এর সাম্প্রতিক অগ্রগতি। এজেন্টিক এআই এমন এক বুদ্ধিমান প্রযুক্তি, যা নিজে থেকেই পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একটা স্বয়ংক্রিয় গাড়ির কথা ধরুন— সেটার কোনও চালক নেই, কিন্তু তাও সে নিজে নিজে রাস্তা চেনে, সামনে কী আছে দেখে নেয়, কখন বাঁ দিকে যাবে, কখন থামবে— সব কিছু ঠিকঠাক বুঝে নেয়। এই এআই নিজেই চার পাশ পর্যবেক্ষণ করে, সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের কাজটি পাল্টে নিতে পারে, ঠিক যেমন আমরা বৃষ্টি দেখলে ছাতা খুলে ফেলি, বা গরম লাগলে ফ্যান চালিয়ে নিই। আজকের দিনে এজেন্টিক এআই তথ্য বিশ্লেষণের জগতে আনছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন, যা তথ্যকে আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি ব্যবহারযোগ্য এবং স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক করে তুলছে।
জলবায়ু, জনসংখ্যা, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় জর্জরিত এই ২০২৫-এর পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে অনেকেই ভাবছেন, হয়তো এআই-ই আমাদের একমাত্র আশা। কিন্তু যদি মানুষের মধ্যেই সহযোগিতাকে টেক্কা দিয়ে যায় প্রতিযোগিতার বোধ, তবে কি মানবিক অনুভূতিবর্জিত এআই এজেন্টরা এসে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে? গুগল, মেটা, মাইক্রোসফট, অ্যাপল, আলিবাবা, টেনসেন্ট— এই সমস্ত বিশাল মুনাফাভোগী প্রযুক্তি সংস্থাই আজকের এআই-এর আসল মালিক। যদি এরা এক দিন পৃথিবী শাসনের ক্ষমতা পায়, এরা কি সত্যিই মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভাববে?
টেকনো-সামন্তবাদ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় সচেতনতা, বিকল্প তৈরি ও স্বনির্ভরতা। যত দিন আমাদের তথ্য, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতে ছেড়ে দেব, তত দিন আমরা তাদের ‘ডেটা-সার্ফ’ হয়েই থাকব। কিন্তু যদি আমরা সচেতন ভাবে বিকল্প তৈরি করি, বিকেন্দ্রিত প্রযুক্তি গ্রহণ করি এবং নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলি, তা হলে প্রযুক্তির শাসন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ, বিকল্প সার্চ এঞ্জিন এবং ব্যক্তিগত ক্লাউড স্টোরেজ ব্যবহার করাটা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ ও অনলাইন পরিষেবায় স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করলে বড় প্রযুক্তি সংস্থার শাসন থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। স্থানীয় কমিউনিটি-চালিত সার্ভার ও নেটওয়ার্ক তৈরি করা বাড়িয়ে তুলবে আমাদের স্বনির্ভরতা, যাতে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণকরতে না পারে, বরং আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারি।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)