Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
WB Panchayat Election 2023

সক্ষমতার আর এক চিত্রনাট্য

বিরহী গ্রাম থেকেও গণ-ডেপুটেশন দিতে এসেছেন মেয়েরা। তাঁদের চিঠিতে লেখা, ন’শো টাকার বাথরুম চাই না, টাকা ফেরত চাই।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩ ০৫:০২
Share: Save:

চিঠিতে ছিল: “শ্রীচরণেষু জেলাশাসক, বর্ষা আসছে। এ বারও কি সাঁতার কেটে ভোট দিতে যেতে হবে? একটা সেতু চাই।” মাত্র তিন লাইনের চিঠি, বয়ে এনেছেন প্রায় তিনশো জন। এমনই ভার ওই ক’টা শব্দের। অফিসের তিনতলা থেকে একতলা অবধি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছে মেয়েদের লাইন। শ্রাবণ মাস এলেই বেলতাড়া আর চকবাকৈড়ের মাঝের খাঁড়ি ভরে ওঠে আত্রেয়ীর জলে। কোনও কোনও দিনে ন’-দশ বারও ডুবে ডুবে এ পার-ও পার করেন এই মেয়েরা। ও পারে শুকনো শাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করেন কেউ।

এতগুলো মেয়েকে লাইন দিতে দেখে বিরক্ত হয়ে অনেকে বলেছেন, ‘নাটক’। নাটকই তো! এক অন্ধকার রঙ্গমঞ্চ, সেখানে দেখা যায় না শ্রমিক-পিতাদের, শোনা যায় কেবল ফোনে ভেসে-আসা সংলাপ— দিল্লি বা কেরল থেকে। মাসে দু’বার ভিডিয়ো কল আর অ্যাপ-মারফত পাঠানো পাঁচ হাজার টাকা, ‌এই হল বেলতাড়া গ্রামের জীবননাট্যে পুরুষের পার্ট। ভোটে বাড়ি ফিরবে বলেও পুরুষেরা কথা রাখে না। বার বার এমন দেখে অভিমানে নাকি শিবের মাথায় জল ঢালা বয়কট করেছেন গ্রামের মেয়েরা। যে সব বুথে পুরুষ ভোটার বিরল, সেগুলো ‘পিসফুল’ বলে পরিচিত। চিঠির শেষে কাঁপা হাতে গ্রামের মানচিত্র আঁকা।

বিরহী গ্রাম থেকেও গণ-ডেপুটেশন দিতে এসেছেন মেয়েরা। তাঁদের চিঠিতে লেখা, ন’শো টাকার বাথরুম চাই না, টাকা ফেরত চাই। চিঠির কাগজের সঙ্গে সেফটিপিনে গাঁথা ধসে-পড়া টয়লেটের ছবি— এক রাতের প্রবল বৃষ্টিতেই ভূমিশয্যা নিয়েছে ‘পাকা পায়খানা’। সিমেন্ট আর বালির ভাগে কতটা অনাচার, বুঝতে বুঝতেই পরবর্তী ভোট চলে আসে। ফোনের সুইচ অফ করে শৌচাগার তৈরির ‘এজেন্ট’ অন্য কোথাও একবর্ষজীবী শৌচাগার নির্মাণে পালিয়ে যান। রাজ্যের দুর্নীতি-চিত্রে ন’শো টাকা তুচ্ছ সংখ্যা। আর মেয়েদের লজ্জামুক্তি? সে কাহিনি ধুলোয়-ঘাসে মিশে হারিয়ে যায়, চিঠি ডকেট হয়। ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’-এর অজুহাতে অফিস বলে, “ভোট মিটলে আসবেন।”

মুনিয়া মুর্মু, গ্রাম তালমন্দিরা। টেট পাশ করেও শিক্ষক হতে না পেরে শেষে মেম্বার হতে এসেছেন। ছাতা মাথায় নমিনেশন জমা করতে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন। পতাকা নেই, দলবল নেই। বিধবা মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে তাঁর ‘ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টি’। তিন জনের সংসার ছিল, এ বার তিন জনের দল গড়তে চান। গ্রামের কেউ খবরটা জানলেই বিপদ। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে গণতান্ত্রিক উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন একবিংশের তরুণী। ভয়, নমিনেশন যেন বাতিল না হয়।

প্রতি বার ভোট এলেই কতকগুলো উৎকণ্ঠার ওঠা-পড়া ধরা পড়ে সরকারি অফিসের ডকেট খাতায়। হয়তো টেন্ডারের পর ঠোঙা হয়ে যায় চিঠিগুলো। হয়তো নিজের লেখা চিঠিতেই চাল, ডাল কিনে ঘরে ফেরেন সুখী বাস্কেরা। এটাই পঞ্চায়েত-সংস্কৃতি। দুর্দশার কথা শব্দের মালায় গেঁথে শহরে পৌঁছন মেয়েরা। তাঁদের জীবনের দৈনন্দিন বিপর্যয়কে প্রাসঙ্গিক করে তুলতেই ভোটকালের অপেক্ষা করে থাকেন তাঁরা। কিন্তু দাবিগুলো অধিকার হয়ে উঠতে পারল কই? প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধের বাইরেও যে মেয়েদের চাওয়াপাওয়া বলে কিছু আছে, তা প্রমাণ করে মেয়েদের সরকারি দফতরে জমা-দেওয়া চিঠিগুলো। দুঃখ-ভয়-সঙ্কটে, সংশয়ক্লিষ্ট জীবনকে অ্যাকাউন্টে অর্থপ্রাপ্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। সামাজিক সম্মান, আত্মমর্যাদার মতো বিষয়গুলো প্রকল্প-সর্বস্ব রাজনীতিতে কতটুকু মর্যাদা পায়? বরং সমাজ শিখছে অনুদান দিয়ে মেয়েদের পরিচয় তৈরি করতে। তাই বিয়ের পাকাদেখার দিন মেয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার পর ফুটনোটের মতো পরিবার উল্লেখ করে, মেয়ে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এরও প্রাপক। এ-ও এখন এক যোগ‍্যতা। বলা হয়, ‘রূপশ্রী’র টাকা ক্যাশ হলেই পাত্রের সোনার চেনের বায়না দেবে পরিবার। দিকে-দিকে কন্যাশ্রীর অর্থটাই যৌতুকের মঞ্চে ‘প্রেস্টিজ ফাইট’ করে যায় মেয়ের হয়ে।

জীবনের অযুত-নিযুত অপূর্ণতা থেকে একটা-দুটোকে বাধ‍্য হয়ে সামনে আনেন মেয়েরা। অনুদানের চাপে যে সব কথা চাপা পড়ে যায়, ভোটের মরসুমে তারা সামনে আসে। ভাতা হারানোর ভয়, প্রধান হয়েও পুতুলের মতো স্বামীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলা যে নারী-স্বাধীনতার অন্তরায়, তা গ্রামের মেয়েরাও বোঝেন। কিন্তু দেখে, মেয়েদের প্রত্যাশাকে কিছুতেই রাজনৈতিক দাবির স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তাঁদের ‘মা-বোন’এর খোপে রেখে দেওয়া হয়। মেয়েদের মতামতের সম্মান নেই, স্বতন্ত্র নাগরিক হিসাবে তাঁদের স্বীকৃতি নেই তাঁর নিজের গ্রামের পঞ্চায়েতে, ব্লক অফিসের দফতরে। সর্বত্র তাঁদের কন্যাশ্রী-রূপশ্রীর গ্রাহক করেই রেখে দেওয়া হচ্ছে।

অগত্যা মেয়েরাও অনেকে অন্য আয়ের সংস্থান না দেখে ভর্তুকির টাকার জন্য পঞ্চায়েতে নাম লেখান। মেয়েদের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে পঞ্চায়েত, শিক্ষা দফতর বা শ্রম দফতর, যাতে মেয়েরা সাবালিকা হয়েই বিয়ের পথ না ধরেন— এ চিত্র গ্রামে কোথায়? মেয়েদের ‘সরকারি সুবিধাভোগী’ করে রাখা বস্তুত পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের বিস্তার, তা মেয়েদের সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার অন্তরায়। অথচ, মেয়েদের নিজস্ব বিচার-বিবেচনা, নিজস্ব সংবেদন কিন্তু পুরুষের ক্ষমতা-সর্বস্ব রাজনৈতিক পরিসরে যোগ করতে পারত নতুন নতুন মাত্রা।

ফাইলবন্দি চিঠিগুলো সেই সম্ভাবনারই নীরব সাক্ষ্য দিয়ে যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Atrayee overflood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy