গত শতকের শেষ প্রান্তে, যখন গৃহশিক্ষকতার দুনিয়া এমন ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট হয়ে ওঠেনি— পড়ানো বলতে ছিল একটি বসার ঘরে এক জন বা দু’তিন জন ছাত্রছাত্রী, কলেজফেরতা হা-ক্লান্ত এক তরুণ মাস্টার, আর অভিভাবকদের তরফে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাইয়ে দেওয়ার এক অনন্ত তাগিদ, শেখানোর থেকেও যেটা অনেক বেশি জরুরি— তখন আশাভঙ্গ হয়েছিল সেই তরুণ মাস্টারের। ছেলেটি টের পেয়েছিল, প্রাইভেট পড়ানোর এই দুনিয়ায় কোথাও নেই সেই আলেকজ়ান্ডারের ছোটবেলার গৃহশিক্ষক অ্যারিস্টট্ল-এর পাঠদানের শিহরন। নেই কোনও ইউক্লিড— রাজার পক্ষে আমজনতার চেয়ে সহজে জ্যামিতি শেখা সম্ভব কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে যিনি মিশরের শাসক টলেমিকে মুখের উপরেই বলেছিলেন: “আপনি রাজা হতে পারেন, কিন্তু জ্যামিতি শেখার কোনও রাজকীয় রাস্তা হয় না।”
সে বোঝে, এই জগতেও রয়েছে সেই ছোট মাছ আর বড় মাছের চিরায়ত ভক্ষ্য-ভক্ষক সম্পর্ক, রয়েছে প্রভাবশালী বড় টিউটরের ছাত্রপিছু কমিশনের ভিত্তিতে অন্যান্য টিউটরের কাছে বিভিন্ন সাবজেক্টের জন্য ‘রেফার’ করার রীতি। আর আছে অপমান— কখনও ছাত্রের বাড়িতে এক কাপ চা-ও না-জোটার অপমান, কখনও তারই শেখানো সঠিক ও সংক্ষিপ্ত রীতিতে করা অঙ্কগুলোকে স্কুলের স্যরের বড় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কেটে দেওয়ার অপমান। সম্ভবত বয়স কম বলেই সে বোঝে না, সেই স্যরেরও রয়েছে অতিরিক্ত উপার্জনের তাগিদ আর নিজের সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের নির্মূল করার বাধ্যবাধকতা।
তবু ছেলেটি চেষ্টা করে যায়— মাঝামাঝি একটা পথ করে নেয়, ভাল নম্বর পাওয়ার প্রকৌশল রপ্ত করানো আর গভীরে গিয়ে শেখানোর মধ্যে। ক্রমে তার কাছে পড়েও জয়েন্ট আর উচ্চ মাধ্যমিকে বেশ ভাল রেজ়াল্ট করে ফেলে কিছু ছেলেমেয়ে। লোভনীয় চাকরির অফার ছেড়ে ছেলেটি থেকে যায় গৃহশিক্ষকতার পেশায়। তার চাইতে না-পারার অক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মাসের পর মাস বেতন না দিয়ে, শেষ পরীক্ষাটির সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে গিয়েছে কত ছাত্র ও অভিভাবক। ছাত্রদের ভালবেসে পড়ানোর স্বীকৃতি মেলেনি গুরুজনস্থানীয় কারও কাছ থেকে। সে বোঝে, গৃহশিক্ষকতা সমাজের স্বীকৃত, প্রথাসিদ্ধ রাস্তায় কোনও দিনই দাঁড়াতে পারেনি, যেমন দাঁড়িয়েছেন প্রতিষ্ঠিত স্কুলশিক্ষকরা। আর সে জন্যই শিক্ষাক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় অসংগঠিত শ্রমক্ষেত্রটি অনেকের কাছেই নিপাট ব্যর্থতা, অথবা শর্টকাটে জীবন কাটানোর উদাহরণমাত্র।
এই ছেলেটি কম-বেশি আমাদের সবারই চেনা। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রাইভেট টিউটরদের যথাযথ মর্যাদা দেয় না— তবু সরকারি নিয়মে, খাতায়-কলমে সেই ব্যবস্থাটিতে যতই পরিবর্তন আসুক, এঁরা থেকে গিয়েছেন অপরিহার্য। তাই আজকের দিনেও গ্রামের স্কুল হোক বা শহরের, প্রতি বছর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা হাই মাদ্রাসার পরীক্ষায় সেরা ছাত্রছাত্রীরা সংবাদমাধ্যমের সামনে স্বীকার করে গৃহশিক্ষকদের ঋণ। ক্লাসরুম শিক্ষার সীমাবদ্ধতা, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের ভারসাম্যহীনতা, অভিভাবকদের সময়ের অভাব বা প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাব, যে কারণেই হোক না কেন, প্রাইভেট টিউটররা এই ফাঁক পূরণ করে পড়ুয়াদের জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই পেশার মূল চালিকাশক্তি কারা? নিঃসন্দেহে সেই সব তরুণ-তরুণী, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যথেষ্ট এবং যাঁদের রয়েছে শিক্ষকতার প্রতি এক সহজাত আকর্ষণ ও অভিজ্ঞতাও। তাঁরা এক দিকে চাকরির প্রতিযোগিতায়, বা চাকরির দাবিতে আন্দোলনে ব্যস্ত, অন্য দিকে পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে অক্লান্ত ভাবে টিউশনি করছেন। আছেন অনেক পিএইচ ডি স্তরের গবেষকও, যাঁরা সরকারি বদান্যতায় পাওয়া মাসিক আট বা দশ হাজার টাকার যৎকিঞ্চিৎ ভাতার উপরে কিছুটা বাড়তি রোজগারের আশায় অবসর সময়ে প্রাইভেটে পড়িয়ে থাকেন।
যে পেশায় রয়েছেন এত মানুষ, উপভোক্তার সংখ্যাও এত বেশি, লকডাউনের সময় কিন্তু সেটির কথা ভাবেনি কোনও সরকার। বছরে অন্তত ন’মাস যাঁরা ঠিকঠাক মাইনে পেতেন অভিভাবকদের কাছ থেকে, অনলাইন ক্লাসের প্রযুক্তিগত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে গ্রাম বা জেলার সেই সব প্রাইভেট টিউটর কী ভাবে নাজেহাল হচ্ছিলেন, সে খবর দেখায়নি মূলধারার সংবাদমাধ্যম। কত জন টিকে থাকতে পারলেন, আর কত জন ছিটকে গেলেন অনটনের পূর্ণগ্রাসে, খোঁজ রাখেনি কেউ।
জাতীয় শিক্ষানীতি স্কুলগুলোকে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ করতে বলেছে। এর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে শিক্ষার মান উন্নয়ন, যাতে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ের প্রয়োজন ছাড়াই যথেষ্ট শিক্ষা পায়, এবং স্কুলেই অতিরিক্ত ক্লাস ও সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ ছাড়া, পরীক্ষাব্যবস্থাকে এমন ভাবে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকেই ভাল ভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে এবং কেরিয়ার কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সঠিক দিকনির্দেশ পায়। মজার কথা হল, সেই একই শিক্ষানীতিকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতর প্রণয়ন করেছে ক্রমশ কর্পোরেট আকার ধারণ করা কোচিং সেন্টারগুলোর সরকারি নথিভুক্তিকরণের বেশ কিছু নিয়মাবলি। নথিভুক্ত নয়, এমন কোচিং বা টিউটরদের বেআইনি ঘোষণা করার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। সেই নিয়মাবলির যথাযথ এবং সাড়ম্বর পালন কোনও কর্পোরেট কোচিং সেন্টারের পক্ষেই সম্ভব— টিউশনের বাজারে নবাগত কোনও তরুণের পক্ষে নয়।
তা হলে ব্যাপারখানা ঠিক কী দাঁড়াল? এক দিকে শিক্ষক ও পরিকাঠামোর অভাবে সরকারি স্কুলগুলো ভেঙে পড়ল। অন্য দিকে, সরকারেরই পরোক্ষ মদতে ছাত্র-শিকারে নেমে পড়লেন কোচিং সেন্টারের কর্পোরেট প্রভুরা। আর ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুলের পাশাপাশি হারিয়ে ফেলতে বসল তাদের বিকেল-সন্ধ্যায় পড়াতে আসা সেই দাদা বা দিদিদের, যাঁরা মাথায় একটা আলতো চাঁটি মেরে নিমেষে বুঝিয়ে দিতেন না-মেলা জ্যামিতির এক্সট্রা বা পরিমিতির অঙ্ক, খুঁটিয়ে দেখে দিতেন হোমওয়ার্কের খাতা।
আসুন, অন্তত একটা শিক্ষক দিবস উৎসর্গ করি মানুষ গড়ার সেই অস্বীকৃত কারিগরদের জন্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy