বারদির লোকনাথ ব্রহ্মচারী অপ্রকট হওয়ার আগে প্রায়ই বলতেন, তিনি ঈশ্বরের গায়ে মল এবং মূত্র ত্যাগ করেন। তাঁর ভক্তমণ্ডলী (জ্যোতি বসুর পিতা থেকে নিরন্ন খেতমজুর) হতবাক হয়ে যেতেন। এক দিন সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি এই সব বলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন কেন? লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তরে বলেন, তাঁর ঈশ্বর তো সর্বময়, প্রতিটি ধূলিকণায় উপস্থিত, তা হলে তিনি কী ভাবে আর কোথায় মলমূত্র ত্যাগ করবেন যাতে ঈশ্বরের গায়ে না লাগে?
বহু যুগ ধরে বহু জনের বলা এবং শোনা এই কথা আর এক বার মনে করার কারণ— ঈশ্বরের, অস্তিত্ব থেকে থাকলে, অবমাননা সম্ভব নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ে কৃষ্ণ অর্জুনের কাছে পরিষ্কার করে দেন যে, তাঁর এক অংশের দ্বারাই তিনি পৃথিবীতে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। অতএব যিনি বিশ্বাসী তাঁর দৃষ্টিতে, ঢেউ যেমন সমুদ্রের অবমাননা করতে পারে না, মানুষের দ্বারা ঐশ্বরিক কিছুর অবমাননা সম্ভব নয়। তাই যে কোনও উপাসনালয়ে তাণ্ডব চালানোটা সামাজিক আতঙ্কের একটা বিষয়, কিন্তু এতে ঈশ্বরের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ যেখানেই থাক তা পবিত্র। ও দিকে যা সাকার তা-ই যদি নিরাকার, তবে ভাঙা প্রতিমার সামনে বসে পুজো করলেও ডুকরে কাঁদার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে সেই মনাস্টারির কথা উল্লেখ করতে সাধ হয়, যেখানকার প্রবীণ লামা আগত সব দর্শনার্থীকে উঁচু বেদিতে স্থিত বুদ্ধমূর্তি দেখিয়ে বলতেন, “ওই যে ওখানে আপনি বসে আছেন। এ বার আপনি, আপনাকে প্রণাম করুন।”
নিজেকে প্রণাম করার অভ্যাস চলে গেলেই, অন্যের প্রণম্যকে ধূলিসাৎ করার বাসনা জাগে। আর তখন ‘অবমাননা’ ছল হিসাবে ভীষণ কাজে লাগে। বর্তমানে সমাজমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে এই ছল লিলিপুট থেকে গালিভার হয়ে উঠেছে। আলোর চেয়েও তীব্র বেগে সে ছুটিয়ে দিচ্ছে গুজব যাতে আগে যে সময়ে বাইশটা গ্রামে আগুন লাগত এখন সেই একই সময়ে বাইশটা জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে ইনফার্নো। খুন-ধর্ষণ-লুটপাট-অগ্নিসংযোগের নারকীয়তা ধারাবাহিকতা পেয়ে যাচ্ছে আর পুরো ব্যাপারটার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছে ওই একটিই শব্দ ‘অবমাননা’।
কারা করছে? অন্তত দু’টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিয়োয় যে উন্মত্ত ‘মব’কে দেখা যাচ্ছে, তার অনেকেই বারো থেকে ষোলোর ভিতরে। আরও কমবয়সি বাচ্চাও থেকে থাকতে পারে। এই পদাতিক তাণ্ডবীরা অনেক ক্ষেত্রেই ‘ধর্মান্ধ’ নয়, ‘লোভান্ধ’। পঞ্চাশ-একশো-দু’শো টাকার বিনিময়ে ‘বলে দেওয়া’ কাজ করানোর জন্য এদের দিনমজুরের মতো জড়ো করা হয়নি তো? নইলে, ভিডিয়ো লাইভ হওয়ার মুহূর্তের মধ্যে অগণিত জায়গায় হামলা শুরু হয়ে যায় কী করে? এদের পিছনের রইসরা হিসাব রেখে চলে, কতখানি গোলমাল পাকালে কত জন সরে যায় আর তার ফলে দখল করার মতো কতটা জায়গা খালি হয়।
কী যোগ এর সঙ্গে ধর্মের? ধর্ম মানলে তো স্বীকার করতে হয় যে প্রায় চারশো বছর ধরে যে ইহুদিরা ‘খ্রিস্টের হত্যাকারী’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছিল, ইসলামের আগমনে তারা সমানাধিকার না পেলেও নিশ্বাস নেওয়ার পরিসরটুকু পেয়েছিল। দেড় হাজার বছর আগে মরুভূমিতে অন্য ধর্মের মানুষদের যে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়েছিল (হলই বা জিজিয়া বা জালিয়ার বিনিময়ে), কোনও আধুনিক রাষ্ট্র যদি সেই নিরাপত্তা সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ইহুদিকে দিতে না পারে, তা হলে তা ইসলামি রাষ্ট্র হিসাবেই বা স্বীকৃতি অর্জন করবে কী করে? ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ফেরত যাওয়ার চেষ্টা যদি রক্তপদ্মা বইয়ে দেয় (যেমন হুমকি শোনা যাচ্ছে) তা হলে ধর্মানুযায়ী কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, সেই বার্তা আগে দেওয়া জরুরি। করাচির রামকৃষ্ণ মিশন বন্ধ করে দেওয়া গেলেও ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন বন্ধ হতে পারে না, কারণ পদ্মা-মেঘনার কোলে মা সারদা ‘ভারতীয়’ পরিচয়ে আবদ্ধ নন, তিনি ‘বঙ্গজননী’; শরৎ আর আমজাদ যাঁর একই রকম ছেলে।
একই কথা চৌমুহনীর রামঠাকুর সম্বন্ধে খাটে। রোজা রাখা কয়েক জন ভক্তের কষ্ট হবে বলে, আশি পেরোনো রামচন্দ্র চক্রবর্তী টিউবকল টিপে বালতি বালতি জল ভরে রেখেছেন, এই কাহিনি যে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, সেখানে তাঁর সমাধি আশ্রম ভাঙচুর করতে লোক জড়ো করানোর মূল চক্রী কারা? কারা কাশ্মীরে, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ ওগরানোর পন্থা হিসাবে, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’ পোড়ানোর কথা বলে?
খেলাটা আসলে খুব জটিল নয়। উত্তরাধিকার কিংবা সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য, ধর্ম অপমানিত হচ্ছে এই ধুয়ো তোলা। যারা তোলে তাদের ধর্ম নিয়ে বোধ তো দূরস্থান, প্যাশনও নেই। যদি প্যাশন থাকত তা হলে তো রাতের অন্ধকারে কে গদা সরিয়ে পবিত্র গ্রন্থ রেখেছে সেটা ভিডিয়ো ফুটেজে ধরা পড়ার পর তাকে নিয়েই তুলকালাম হয়ে যেত। হয়নি যখন তার মানে খুব হিসাব কষে আগুন সেই সব জায়গাতেই লাগানো হচ্ছে যেখানকার লোকরা ‘আবার আগুন লাগতে পারে’ ভয়ে ভিটে-মাটি-দেশ ছেড়ে পালাবে।
কয়েক বছর আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে পৃথিবীর অনেক দেশের লেখকদের তরফ থেকে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সেই স্মারকলিপির বিষয়টি ছিল রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে, নিজের-নিজের বাড়িতে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারার অধিকার সুনিশ্চিত করা। কক্সবাজার এবং অন্যত্র ক্যাম্পে-ক্যাম্পে যে বাস্তুচ্যুত বারো-পনেরো লাখ রোহিঙ্গা আছেন, তাঁরা যত দিন না নিজেদের ভিটেয় ফিরে যেতে পারছেন, তত দিন পাকিস্তান তাঁদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে অশান্তি পাকিয়ে তোলার চেষ্টা করবেই। এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হলেই অনেক সময় ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটা উঠে আসে, কারণ গরিব যে-কোনও জাতিকে একটি ব্রাশে দাগিয়ে দেওয়া সহজ।
হাতে তত টাকা ছিল না বলেই কি, ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ভারতে ঠাঁই নেওয়া লাহৌরের শিখ ‘সর্দার’ এবং তামিল হিন্দু ‘টাইগার’, ফরিদপুরিয়া আর বরিশাইল্যারা ‘রিফিউজি’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল?
সাম্প্রতিক হিংসার প্রেক্ষিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা কুমিল্লায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অজস্র মানুষ যে প্রতিরোধ খাড়া করেছেন, তাকে কুর্নিশ। কিন্তু চাটগাঁইয়া আর নোয়াখ্যাইল্যাদের নতুন করে ‘নতুন ইহুদি’ তখনই হতে হবে না, যখন যা অবমাননার আওতার বাইরে, তাকে ব্যবহার করে অসহায় মানুষ-মানুষীকে বিপন্ন করা বন্ধ হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy