শহিদ মিনারের ছায়ায় বৃক্ষতলে, বাঁধানো বেদির উপর কথকতার আসর। এক জন সচিত্র রামচরিতমানস বার করেন, পাঠ শুরু হয়। শেষে অন্তত একশো লোক। বেশির ভাগই বিহার ইউপি ঝাড়খণ্ড মধ্যপ্রদেশের মানুষ। বাপ-ঠাকুরদা হয়তো বহু আগে এই শহরে এসেছিলেন, বসে গিয়েছিলেন। পুঁজির টানে, রুজির টানে। তাঁদের নাতিপুতি কলকাতার কসমসে মিশে গিয়েছেন। বড়বাজারের শ্রমিক বা ক্যাবের সারথি— হালে এসেছেন ভাই-বেরাদরদের শুনে।
আজকে যিনি পাঠক, ধরা যাক শ্রীকান্ত পান্ডে, ঠাকুরদার হাত ধরে আসরে আসতেন, মনে করতে পারেন। আবার ত্রিপাঠিজির মতো কেউ প্রয়াগের আশেপাশের গ্রাম থেকে কথকতা করতেই চলে এসেছিলেন ‘বঙ্গাল’। এমন আসর আছে নৈহাটিতে, রিষড়ায়। তাঁদের গায়ন-বাদন-কথাবাচনে এই বিদেশেও যেন একটি দেশ নির্মিত হয়ে ওঠে। গজেন্দ্র সিংহ আমায় বলেছিলেন, “দেস্ মে আনা-যানা নেহি হো পাতা, এঁহি চলে আতে হ্যায়। হো গয়া দেস্!”
এক দেশের মধ্যে কত রকমের দেশ! বড় দেশ— যার মোটামুটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ভূখণ্ড আছে, ভূখণ্ড রক্ষার প্রতিরক্ষা ও সিস্টেম আছে। আর ছোট ছোট দেশ— একেবারেই অনির্দিষ্ট ও ব্যক্তিগত। তার কোনও প্রতিরক্ষা নেই অনুভূতি ছাড়া। বরিশালের সুপারিবনের সারি কিংবা লাহৌরের মহল্লা— দেশান্তরি মানুষের বুকের ভিতর সেই দেশের সৈন্যসামন্তবিহীন অবস্থান। বড় দেশের বড় ভাগাভাগির বৃত্তান্ত এই ব্যক্তিগত ছোট দেশকে পরদেশ করে এক রাতে। সতীনাথ ভাদুড়ির নতুন চরিতমানসে, ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রজা ঢোঁড়াই তাৎমা যেমন পাক্কী মানে পিচ-বাঁধানো রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবে: স্বরাজিরা যে দেশ স্বাধীনের চেষ্টা করছেন, সে দেশ কতটা বড়! কিন্তু তার সাধ্যে কুলোয় না যে, এত বড় দেশকে নেবে মাথার ভিতরে!
নর্মদার মতো বড় বাঁধ বা খনিজ কারখানার জন্য জঙ্গল, গ্রাম ছেড়ে মূলনিবাসী মানুষকে দেশের স্বার্থে জায়গা করে দিতে হয়। তাঁদের বুঝে নিতে হয়, এ এমন দেশ যার উন্নতিতে দেশ-গাঁ ফেলে চলে যেতে হয়। মেট্রো সিটির বস্তির দিকে। বা চা-বাগিচায়। আড়কাঠিরা মানুষ ধরে এনেছে মানভূম থেকে চা-বাগানে, সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখিয়ে— “দেশে বড়ো দুখ রে, আসাম দেশে যাব মিনি, চা বাগান হরিয়ার।” মানে হরিয়ালি, সবুজ স্বপ্নের দেশ। আর উত্তরবঙ্গে ইংরেজদের বাগিচা-ব্যবসায় বাকি রাষ্ট্রের আইন খাটত না। কিছু দিনেই মোহভঙ্গ। “সর্দার বলে কামে কাম, বাবু বলে বেন্ধে আন, সাহাব বলে লিব পিঠের চাম। হায় যদুরাম, ফাঁকি দিয়ে চলাইলি আসাম।”
ফেরার আর পথ থাকে না। টিকে থাকা, সাংস্কৃতিক মিশ্রণ, আগ্রাসন, টানাপড়েন কত রকম। নাগপুরির সঙ্গে মেশে কুরুখ-সাঁওতালি শব্দ, হিন্দি-নেপালি-বাংলা; লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার মতো সাদরি ভাষায় চিরপ্রবাসীর প্রশ্ন, “কহেনা হামর পরিচিতি কা হেকে?” কোথায় আমার দেশ? এই তরাই-ডুয়ার্স? না কি প্রজন্মান্তরে শুনে চলা ইতিহাসের ফেলে আসা শাল-জঙ্গল? রমোধ টপ্পোয়ারের কবিতা, রসিকতা করতে করতেই অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। “...কী আমার আত্মপরিচয়?/ কেউ কেউ বলে কুলি ধাঙড়/ কেউ বলে মদেশিয়া/ সন্দেহ হয় আমরা কি নই ছোটনাগপুরিয়া?/... আমরা কি নই ভারতবাসী?”
আজকের নির্মাণশ্রমিক, জরির কারিগর, ফুটপাতের দোকানি— কত পেশার মানুষের দেশ জুড়ে এই আনাগোনা। কোত্থেকে কোথায় যায় মানুষ রুটির খোঁজে, একটু সচ্ছলতার খোঁজে। এই চলে যাওয়ার মধ্যে, কামারের লেবার বনে যাওয়ার মধ্যে, তারাশঙ্কর গ্রামপতনের শব্দ শুনেছিলেন। পতন তো বটেই, তবে গ্রামগুলি থেকেই যায়। পাল্টে যায় অর্থনীতি, সামাজিক সংস্কৃতি। বিহার-উত্তরপ্রদেশের একটি নৃত্যগীতময় নাট্য-আঙ্গিকের নামই বিদেশিয়া। পতির উদ্দেশে প্রোষিতভর্তৃকা নায়িকার বিরহের আকুলতা, কখনও খুবই শারীরিক। প্রবাসী দয়িতও ট্রাক-বাসের পিছনে উজ্জ্বল রাঙিয়ে নেয় কল্পনার গ্রাম, ঘোমটা দেওয়া বধূ।
বাঘ এক্সপ্রেসের সাধারণ কামরার যাত্রীরা ছটে দেশে ফিরছেন। আনন্দের ফেরা; ব্যাগে ঘরওয়ালির জন্য সস্তার সওদা। এই পরিযায়ীরা অন্য ভাবেও ফিরবেন। পোঁটলা-পুঁটলি মাথায়, কোলে-কাঁখে বাচ্চা নিয়ে হাজার কিলোমিটার হেঁটে দেশে ফেরার চেষ্টা করবে নিরুপায় শ্রমিক পরিবার। দেশের মধ্যেই বিভিন্ন বর্ডার তৈরি হবে তাঁদের ফেরা আটকাতে।
মরিচঝাঁপিতে তাড়া-খাওয়া, দণ্ডকারণ্যে ঠাঁই-নেওয়া মানুষদের আস্তানায় হরিকীর্তন, কবিগানের আসর। পাগল গোসাঁই গান ধরেছেন, “পরবাসী হইয়া রে, রব আর কতকাল পরের জ্বালা সইয়া রে।” ধুয়ো দিচ্ছে নারী-পুরুষ, পরস্পরের চরণ ধরে লুটিয়ে পড়া। সেই অশ্রুজলে মরমি প্রশ্নের সঙ্গে ফেলে-আসা দেশের জন্য ব্যথার কাজলও কি লেগে ছিল?
ব্যক্তিগত দেশের প্রতি দেশোয়ালি মানুষের সংযোগের এ সব নিবিড় অনুভূতিকে কি যথেষ্ট দেশাত্মবোধক মনে হবে আমাদের? “দেশে আর থাকা চলে না”— কাজ নেই। সুতরাং ব্যক্তিগত ছোট দেশ ছেড়ে চলে যাবেন এঁরা বড় দেশের শহরের দিকে। তার পর যদি কাজ হারান অথবা বহিরাগত তকমা চাপানো হয় এক দিন, তবে এই বড় দেশটা ছেড়েও এই মানুষদের চলে যেতে বলা হবে। কোন দেশে যাবেন তাঁরা? কোন পাক্কী ধরে?
তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy