গত শতকের ষাটের দশকের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ় স্টার ট্রেক-এর এক চরিত্র ছিল ‘ডেটা’। আত্ম-সচেতন, সপ্রতিভ, সংবেদনশীল। কিন্তু মানুষ নয়, সে ছিল এক ‘রোবট’। আক্ষরিক অর্থে ‘ডেটা’ হল তথ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ-শ্রেণিবদ্ধ তথ্য। আজকের দুনিয়ায় এই তথ্যই হয়ে উঠেছে চালিকাশক্তি— একুশ শতকের পেট্রোলিয়াম। তথ্যের সাগরে প্লাবন এসেছে কয়েক দশক ধরেই। ক্রমেই তা আরও ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। ইন্টারনেট এবং সমাজমাধ্যমের বাড়বাড়ন্তই তার প্রধান কারণ। এই তথ্যের পরিমাণ কী ভাবে বাড়ছে, একটা হিসাব দিলে তা স্পষ্ট হবে। ২০২০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে মোট যত তথ্য সঞ্চিত ছিল, পরের দু’বছরেই তৈরি হচ্ছে ততখানি তথ্য। তার পরের দু’বছরে তার দ্বিগুণ, পরের দু’বছরে চার গুণ— এ ভাবেই বাড়তে থাকবে তথ্যের পরিমাণ।
আমাদের প্রতিটা অভ্যাস, দিন-যাপনের রোজনামচা আন্তর্জালের সর্পিল প্রবাহে এই তথ্যভান্ডারের অংশ হয়ে চলেছে। কোন ভাঁড়ারে আমাদের কোন তথ্য কী ভাবে জমা হচ্ছে, মেঘের আড়ালে থেকে কোন তথ্যের দখল নিচ্ছে কোন মেঘনাদ, সেটাই আজকের দুনিয়ার হর্তাকর্তাদের প্রধান মাথাব্যথা। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে গোপনীয়তা, নিরাপত্তা থেকে নির্বাচন, সব কিছুরই চাবিকাঠি হয়ে উঠছে এই বিপুল তথ্য এবং তার অপব্যবহার। ডেটা-কে নিয়ন্ত্রণের হরেক চেষ্টায় তাই ব্যগ্র দুনিয়া। তথ্যকে কী ভাবে মানবিক করে তোলা সম্ভব, তার বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, আর আইন প্রণয়ন চলেছে দুনিয়া জুড়ে, দেশে দেশে, নিজেদের মতো করে।
২০১৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চালু করেছে জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন। তুরস্ক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মরিশাস, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া— দুনিয়ার অনেক দেশই নিজেদের তথ্য নিরাপত্তা আইন তৈরি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনের কাঠামো অনুসরণ করে। এমনকি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়েও আইনটি বজায় রেখেছে ব্রিটেন। চিন সম্প্রতি চালু করেছে ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপত্তা আইন— কী ভাবে তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার ও সংরক্ষণ করা হবে, তার রূপরেখা।
ভারতেও তথ্য সংরক্ষণের জন্য আইন আনার চেষ্টা চলছে কয়েক বছর ধরেই। বিলটির খসড়া নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটি আলোচনা চালিয়েছে দীর্ঘ দিন। সংশোধনী জমা পড়েছে সম্প্রতি— সংসদের শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন। আগামী দিনগুলিতে এই বিল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলবে বিস্তর। শুধুমাত্র সংসদে নয়, সংবাদমাধ্যমে, সামাজিক পরিসরে। দেশের তথ্য যাতে দেশের সার্ভারে জমা থাকে, বিদেশি বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলি যাতে ভারতের তথ্য নিয়ে নয়-ছয় করার সুযোগ না পায়, সেটাই হয়তো আইনের প্রধান উদ্দেশ্য। টানাপড়েনও চলবে। তথ্যের দখল নিয়ে কেউ ‘বিগ ব্রাদার’ হয়ে উঠতে পারে কি না, সে বিষয়ে প্রচুর যুক্তি-প্রতিযুক্তির জাল বোনা হবে আগামী দিনে। চুলচেরা বিশ্লেষণ চলবে গোপনীয়তার মৌলিক অধিকারের মানদণ্ডে। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৭’র পুত্তস্বামী রায়ের কথাও এই আলোচনায় উঠতে বাধ্য।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১১ সালের একটি রিপোর্ট তথ্যকে সম্পদের শ্রেণিভুক্ত করেছিল। বলেছিল, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টির সুযোগের এক নতুন তরঙ্গ তৈরি করতে পারে তথ্য। এক দিকে তথ্যই যেমন হয়ে উঠেছে একুশ শতকের সর্বপ্রধান অস্ত্র, সেই সঙ্গে দুনিয়া আজ বিশ্বাস করে যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হতে পারে তথ্যবলে সমৃদ্ধ হয়েই। তাই মহামূল্যবান এই তথ্যভান্ডারের শুধুমাত্র সংরক্ষণই নয়, অন্যান্য সম্পদের মতো এর ব্যবহারের চেষ্টাও শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের আমেরিকান তথ্যচিত্র দ্য সোশ্যাল ডাইলেমা-তে এক প্রাক্তন গুগ্ল কর্মীকে বলতে দেখা যায়, যে ভাবে জলের খরচের পরিমাণ দেখে জলকর নেওয়া হয়, তথ্যের জন্যও ট্যাক্স নেওয়া উচিত সে ভাবেই। বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির কাছ থেকে ‘ডেটা ট্যাক্স’ নেওয়ার এই চিন্তাভাবনা ক্রমশ সাড়া পাচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। জার্মানিতে, আমেরিকায়; সম্প্রতি চিনেও। চিন আবার সরকারি ভাবেই ডেটা-কে ঘোষণা করেছে ‘প্রোডাকশন ফ্যাক্টর’। জমি, শ্রম, মূলধন, এবং প্রযুক্তির মতো ‘তথ্য’ও এক নতুন উৎপাদক। তাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, ‘তথ্য’ বাড়িয়ে দিতে পারে উৎপাদনশীলতা। এমনকি তথ্য বিপণনের ব্যবস্থাও করছে চিন। নভেম্বরে শুরু হয়েছে শাংহাই ডেটা এক্সচেঞ্জ, একেবারে স্টক এক্সচেঞ্জের ধাঁচে। সরকারি ভাবে নিয়ম মেনে যেখানে হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের বেচাকেনা।
তথ্য তো জমা হয়ে চলেছে আরও। প্রতিনিয়ত। ডেটা হয়ে উঠেছে ‘বিগ ডেটা’। ফেসবুক, গুগ্ল, অ্যামাজ়ন, নেটফ্লিক্সের মতো সংস্থার ঘরে এখনই এত তথ্য রয়েছে, যা সামলে উঠতেই তারা হিমশিম। কিন্তু, বিপুল তথ্যের হৃদয় মন্থন করে ‘জ্ঞান’ ছিনিয়ে আনতে না পারলে, এই তথ্যসমুদ্র দিয়ে হবেটা কী? অ-শ্রেণিবদ্ধ তথ্য তো অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের মতো। তাকে পরিস্রুত করে অন্য কিছুতে পরিণত না করলে তার ব্যবহার কোথায়? সে প্রচেষ্টাও তাই চলেছে পুরোদস্তুর। কয়েক দশক ধরেই। এক নতুন পেশা তৈরি হয়ে গেল— ‘ডেটা সায়েন্টিস্ট’। রাশিবিজ্ঞান, গণিত, কম্পিউটার, ইঞ্জিনিয়রিং, ম্যানেজমেন্ট— সব কিছুর খিচুড়ি পাকিয়ে এক নতুন ধরনের বিশেষজ্ঞ। ‘হার্ভার্ড বিজ়নেস রিভিউ’ ২০১২ সালে বলেছিল, এটাই একুশ শতকের সব চাইতে আকর্ষণীয় চাকরি।
কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তিতে ভর করে সমষ্টিগত ভাবে কোটি কোটি মানুষের এই বিপুল তথ্যকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা কি আদৌ আছে ডেটা সায়েন্টিস্টদের? ১৯৯১-এর অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী রোনাল্ড কোয়াস বলেছিলেন, “ডেটা-কে অত্যাচার করে তাকে দিয়ে যা খুশি স্বীকার করিয়ে নেওয়া যায়।” তাই ‘ডেটা’ যা বলছে, সেটাই তার সর্বোত্তম বিশ্লেষণ-ভিত্তিক ফল কি না, তা কে বলবে! রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণের মতো সংবেদনশীল বিষয় জড়িয়ে থাকলে অ-শ্রেণিবদ্ধ তথ্যের যথাযথ বিশ্লেষণের গুরুত্ব অপরিসীম। তার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সঠিক প্রযুক্তি, আর উপযুক্ত বিশেষজ্ঞের সুনিপুণ সাধনা।
স্টার ট্রেক-এর চরিত্র ডেটা ক্রমশ মানুষের মতো হয়ে উঠতে থাকে। শেষে তার মধ্যে যোগ করা হয় ‘ইমোশন চিপ’। হয়তো ডেটা-র ‘মানুষ’ হওয়াটা প্রায় পূর্ণতা পায় এ ভাবেই। তার প্রতিটা দিনই নতুন আবিষ্কারের সম্ভাবনায় ভরা। তথ্যের দুনিয়া এই রকমই। গোপনীয়তা আর নিরাপত্তা যদি মুদ্রার এক পিঠ হয়, তার অন্য পিঠ তাই অজ্ঞাত, অনির্ণেয়, কিন্তু অমিত সম্ভাবনায় ভরা এক জাদু-দুনিয়া। চিচিং ফাঁক মন্ত্রটা কেবল ঠিকঠাক বলা চাই।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy