Advertisement
E-Paper

মেয়েরা কি সত্যি স্বাধীন

সমাজ নারীর পোশাক গণ্ডিতে বেঁধে দেবে। ভয় ও শাসন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে।

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২১ ০৫:৩০
Share
Save

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, অনেকগুলো বছর কেটে গেল। তেরঙা উড়িয়ে, মাইক বাজিয়ে ঘটা করে ১৫ অগস্ট উদ্‌যাপিত হয়। তবে আমার মন কেবল কুডাক গায়। বলে, যত উৎসবের ঘনঘটা, তত আঁধার নামে জনজীবনে। যত ভিড় তত নির্জনতা।

সিমোন দ্য বোভোয়া-র দ্য সেকেন্ড সেক্স বুড়বুড়ি কাটে মাথায়। মেয়েরা যে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক! যদি আজ ভাবতে বসি, আমরা মানে মেয়েরা কি সত্যি স্বাধীন— রামমোহন, বিদ্যাসাগরের নাম ঝিলিক মারে। তাঁরা স্ত্রীস্বাধীনতার পথপ্রদর্শক। মন এঁড়ে তর্ক জোড়ে। স্ত্রীস্বাধীনতা থাকলে, ‘পুংস্বাধীনতা’ শব্দটি নেই কেন? বা রে! সে কেমনে হবে? স্বাধীনতা পুরুষের জন্মগত কবচকুণ্ডল। আর, নারীর ক্ষেত্রে সবাই চেষ্টা করেন স্বাধীনতা দিতে। জন্ম-অসহায় মেয়েদের হাতে ধরে কিছু না তুলে দিলে তাঁরা পাবেন কী করে! তাঁদের জন্য, স্বাধীনতা নিজে অর্জনের বস্তু নয়! ক’দিন আগে দেখছিলাম, পাশের বাড়ির ভদ্রলোক তুমুল চেঁচামেচি করছেন স্ত্রীটির প্রতি। “যতই স্বাধীনতা দিই, তুমি মিসইউজ় করো। বাড়িতে ছেলে কাঁদছে, গড়িয়াহাট যেতে চাইলে বললাম যাও, তা বলে সন্ধে পার করে ফিরবে!” অনেক নারীও গদগদ চিত্তে বলেন, “বাড়িতে আমাকে প্রচুর স্বাধীনতা দেয়!” বলতে তাঁদের কান গরম হয় না, কিংবা অসম্মানিত লাগে না নিজেকে? স্বাধীনতা নিশ্বাস নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ তা চামচে করে মুখে তুলে দেওয়ার মতো পাইয়ে দিলে, সেই দেওয়ারও সীমাবদ্ধতা থাকে। ভার্জিনিয়া উল্‌ফ লিখেছিলেন, “চাইলে গ্রন্থাগারে তালা ঝোলাতে পারেন। কিন্তু স্বাধীনতার উপর কোনও দরজা, তালা বা খিল আঁটতে পারবেন না।”

তবু মেয়েরা আজও স্বাধীন নন। মতামতের, জীবনযাপনের, কাজের, শিল্পচর্চার, ভালবাসার, যৌনতার স্বাধীনতা— নারীর ক্ষেত্রে সবটাই পিতৃতন্ত্রের অনুমোদনসাপেক্ষ।

বিয়ের পর একটি মেয়ের যাপন ‘কেয়ার অব’ হয়ে যায় পুরুষের বাড়ির ঠিকানায়। জীবনযাপনে আসে নিয়ন্ত্রণ। অবিবাহিতারও পদে পদে নিয়ন্ত্রণ। খেলাধুলো সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরতে হবে সূর্যাস্তের আগেই। তাঁর স্বাধীনতা কেউ জোর করে হরণ করার আগেই নিজে বুঝে নেন যে, তিনি পরাধীন। কারণ পথঘাট শ্বাপদসঙ্কুল। শরীরের দিকে লোলুপ তাকাবে পাশের বাড়ির কাকু অথবা পাড়ার দাদা। ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ প্রবাদটি এমন ধরেবেঁধে মেয়েটির কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়ে রাখা হয়, নিজেই চার পাশে পরাধীনতার পাঁচিল গড়ে তোলেন।

সমাজ নারীর পোশাক গণ্ডিতে বেঁধে দেবে। তিনি রাত পর্যন্ত একা রাস্তায় ঘুরেফিরে কিংবা পার্কে হেঁটে-চলে একাকিত্ব উপভোগ করতে পারবেন না। ভয় ও শাসন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। মানুন আর না-ই মানুন, সমাজনির্দিষ্ট ‘ভাল মেয়ে’র আদিকল্প তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবে। চৈতন্যকে কুরে কুরে খাবে।

নারী অর্ধেক আকাশ— কবির কল্পনাপ্রসূত চমৎকার বচন। বাস্তব একদম অন্য। খুব উঁচু পদে চাকরিরতাও গোপনে মনে লালন করেন অপরাধবোধ। যেন, কেরিয়ারমুখী হওয়ার স্বাধীনতা তাঁর নেই। রোজগারের পাশাপাশি, সন্তানকে পুরো যত্ন দিয়ে মানুষ করতে পারছেন না— এই বোধ সমাজ তাঁর মধ্যে ঢোকায়। ফলে, বহির্জগৎ থেকে ঘরে ফিরে, আরামভোগের স্বাধীনতাটুকু থেকেও তিনি বঞ্চিত। ঘরের কাজে লাগতে হয়।

গড়পড়তা পরিবার চায়, মেয়ে বা বাড়ির বৌ, দশটা-পাঁচটার নির্ঝঞ্ঝাট চাকরি করুক, বাড়ি ফিরেও যেন সে কাজের রেশ তাকে বইতে না হয়। গৃহকর্মে ব্যাঘাত না ঘটে। এবং, ভদ্রসভ্য কাজ করুক, যেখানে পুরুষের গা-ঘেঁষাঘেঁষি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ, আবার একটি মেয়ের খুশিমতো পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা হরণের বিষয়টি এসে পড়ছে। যে মেয়ে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি— তাঁরও সত্যি বলার স্বাধীনতা নেই। হাত খুলে কিছু লিখলেই সবাই ভাবেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বুঝি খুব ময়লা! পুরুষ রঙিন, নেশালু জীবনযাপন লিখবেন, টুপি ভরবে পালকে। নারীলেখককে কলমে পুরে নিতে হবে সেন্সরশিপের কালি।

জীবনসঙ্গিনী কখনও কি স্বামীকে মুখ ফুটে বলেন, যৌনজীবনে তিনি অসুখী? বললেই বিপত্তি। সিনেমায় দেখছিলাম, স্ত্রী সাহসে ভর করে স্বামীটিকে বিছানার অতৃপ্তির কথা জানালে সেই পুরুষ তেরিয়া জানতে চান, “আগে কত জনের সঙ্গে শুয়েবসে সুখ যাচাই করেছ?” স্ত্রী বলতে পারেন না বলেই শয্যাতেও তাঁকে ঘেরে পরাধীনতার হিমশীতল গণ্ডি। মনে পড়ে, এরিকা জং-এর অমোঘ উক্তি— “যেমন প্রতিটি পরিবারে রঙিন টিভি, তেমনই এক দিন, প্রতিটি নারী যৌনতৃপ্তি লাভ করবেন।”

স্বাধীনতার মাসে মেয়েদের পরাধীনতার কথা বলছি আর ভাবছি, সব হয়তো কেটে যাবে কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ বছরের মধ্যে। আশঙ্কা মুছে আমরা আনন্দে পৌঁছব। সেই আনন্দ, যখন মেয়েরা প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা নিয়ে মহিমান্বিত হবেন। অন্যের থেকে প্রতিফলিত আলোয় তাঁকে আর আলোকিত হতে হবে না।

Women Empowerment 75th Independence Day

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।