Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
পঁচিশ বছর আগেকার ‘লজ্জা’ এই বিজেপির সহ্য করা মুশকিল
Web Series

যদি ধরে নেয় ভূতে

১৯৯৯ থেকে ২০২৪। অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা দিয়ে। তবু বিক্রমাদিত্যের ঘাড়ে চেপে বসা বেতাল যে নামেনি এখনও, দেখিয়ে দিল একটা ওয়েব সিরিজ়।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:১৬
Share: Save:

অতঃপর ভারত সরকারকে নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া জানাইল, আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণের উপরে নির্মিত ওয়েব সিরিজ়টির শুরুতে আমরা ইহার পর হইতে ডিসক্লেমার-এ জঙ্গিদের আসল নামগুলি লিখিয়া দিব। শুধু তাহাই নহে, এখন হইতে ভারতীয় কনটেন্ট যাহাই বানাইব, লক্ষ্য রাখিব, তাহাতে যেন ভারতীয়দের আবেগ, ভারতের সংস্কৃতি মান্যতা ও মর্যাদা পায়। মোট কথা, আমরা শিক্ষা পাইলাম, নাকখত দিলাম, আর অন্যথা করিব না: সত্য সুকঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলেও সিনেমা-সিরিজ় ইত্যাদিতে সরকারি সহজ কথাটি সহজ করিয়া বলিব।

রাজা ডেকে পাঠিয়েছিলেন বণিককে। এ খুব ভাল কথা নয়। ক্ষমতা আর অর্থ পরস্পরকে সমঝে চলবে, রাজবাড়ির বাইরে এখানে-ওখানে দেখাসাক্ষাৎ হবে, যুগলে পান-ভোজন আর কাজের কথাও— এমনটাই দস্তুর। দরবারে তলব মানে ব্যাপার গুরুতর। কী ব্যাপার? বণিক তার কুমোরশালে তৈরি এমন সব পুতুল বেচছে, যারা মনে করিয়ে দিচ্ছে এই রাজার পূর্বসূরি আর এক রাজার কথা। সেই রাজার আমলে হওয়া এমন এক ‘দুর্ঘটনা’র কথা, আজকের রাজার জন্যও যা তুমুল অস্বস্তির। লজ্জার। যন্ত্রণার তো বটেই। হোক পঁচিশ বছর আগের রাজা, রাজবংশটা তো একই। কেন তুমি, হে বণিক, সেই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তুলবে, আবার বেচবেও ‘ভিন্টেজ’ বলে? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?

১৯৯৯ থেকে ২০২৪। অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা দিয়ে। তবু বিক্রমাদিত্যের ঘাড়ে চেপে বসা বেতাল যে নামেনি এখনও, দেখিয়ে দিল একটা ওয়েব সিরিজ়। অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিজেপি আর নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি এক— এ কথা বললে হয়তো ঈশ্বরও আকাশবাণী করে গলা কাঁপিয়ে হাসবেন। এমনকি বিজেপি ভক্ত-সমর্থকেরাও। যেমন আলোচনা হয় চায়ের কাপে: তখন কারগিল হয়েছিল, এখান-ওখান দিয়ে ঢুকে পড়ছিল জঙ্গি, হামলা চালাচ্ছিল কাশ্মীর থেকে শুরু করে পার্লামেন্টেও, এখন কোথায় পাকিস্তান? সোজা কথা: শত্রুর সঙ্গে আবার আলোচনা কী? এমন এক প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি যিনি একেবারে জনসভায় রাখঢাক না করে বলতে পারেন ‘ঘর মে ঘুসকে মারেঙ্গে’। পুলওয়ামা দেখাচ্ছ? এই নাও বালাকোট। কূটনীতি থেকে ক্রিকেট, সমস্ত সৌজন্য-সম্পর্ক বাদ। জনতা যে রকম রাগ করে, গাঁকগাঁক করে কথা বলে, রাষ্ট্রও সেই ভাবে বলবে। কলার তুলে ঘুরে বেড়াবে সর্বদা। তবে না ইমেজ!

এই ইমেজে কে রে চুনকালি মাখাতে এলি? দিনের শেষে যতই হোক বিনোদন, লোকে তো ছায়াকেই কায়া ভাবে। যতই হোক পঁচিশ বছর আগেকার বিজেপি-জমানার ঘটনা, ‘বিজেপি’ তো বটে। কাঠমান্ডু থেকে দিল্লিগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর প্লেন হাইজ্যাক করল পাঁচ পাক জঙ্গি, ক্যাপ্টেনের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে অমৃতসর লাহোর দুবাই হয়ে বিমান নিয়ে গেল তালিবানি জমানার কন্দহরে, অপহরণকারীরা কতটা নিষ্ঠুর তা বোঝাতে মধুচন্দ্রিমা-ফেরত এক তরুণ যাত্রীর বুক পেট মুখে ছুরি হেনে মেরেই ফেলল উড়ানে, এবং অবশেষে দাবি করল মুক্তিপণ: ভারতের কারাগারে বন্দি শতাধিক জঙ্গির মুক্তি— বাজপেয়ী সরকারের এই চরম অপমানের পর্বটি নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি-ও বরাবর ভুলে থাকতে চেয়েছে। ভুলতে চেয়েছে জঙ্গিদের হাতে বন্দি ভারতীয়দের পরিবারের সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী-সকাশে আর্তনাদ, কংগ্রেস আর ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর প্রবল হইচই, এবং প্রচারমাধ্যমের পাহাড়প্রমাণ চাপ। ভুলতে চেয়েছে এই স্তম্ভিত করে দেওয়া সত্য: শেষে মাসুদ আজ়হার-সহ তিন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গিকে কিনা ছেড়ে দিতে হবে দেড়শোরও বেশি (আগে দুবাইতে ২৭ জনকে মুক্তি দিয়েছিল জঙ্গিরা) প্রাণের রক্ষার শর্তে! ভুলতে চেয়েছে, খোদ তৎকালীন বিদেশমন্ত্রীকে নিজে গিয়ে সেই তিন জঙ্গিকে তুলে দিতে হয়েছিল অপহরণকারীদের হাতে! লজ্জা, লজ্জা!

আর তোরা ওয়েব সিরিজ়ে কী দেখালি? পাঁচ অপহরণকারী একে অন্যকে ডাকছে ভোলা, শঙ্কর, চিফ, ডক্টর আর বার্গার নামে। হরকত-উল-মুজাহিদিন জঙ্গির নাম ভোলা আর শঙ্কর, এ কি স্বপ্নেও সম্ভব? এ তো সত্যের অপলাপ! জঙ্গিদের ধর্ম আর গোষ্ঠী-পরিচয়কে এ-হেন ‘হিন্দু’ নামের মোড়কে পরিবেশন করা মানে তোমার বাপু অন্য অভিসন্ধি আছে। আজকের দর্শক কি দেখে ভাববে না, ও হরি, এরা হিন্দু ছিল তবে? সিরিজ়ে অপহরণকারীদের মাঝেসাঝে একটু ‘নরম’ও দেখানো হয়েছে। জঙ্গি, আবার মানবিকও— সম্ভব? এই গোটা কাণ্ডে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর যে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় হাত, তা তেমন ভাবে ফুটে ওঠেনি পর্দার ঘটনাক্রমে। ঘটনা যে ভাবে গড়াচ্ছিল তাতে না-হয় মানা গেল যে এ ছিল ভারতেরই দায়— এই ব্যর্থতা, এই লজ্জা, চাপের মুখে এই নতিস্বীকার। তা বলে কি তা-ই দেখাতে হবে পর্দাতেও? কেন, কারগিলের আশপাশে গুচ্ছের হিন্দি ছবি হয়নি ভারতে?

কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের তলবে শাস্ত্রী ভবনে মিটিংয়ে সিরিজ় প্রযোজনা সংস্থার প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তাঁরা পর্দায় তা-ই দেখিয়েছেন যা লেখা আছে বইয়ে, এবং সরকারি নানা নথিতেই। ভোলা, শঙ্কর— মনগড়া নাম নয়। এগুলো ‘কোড নেম’, জঙ্গি বা অপরাধীরা এ সব ব্যবহার করেই থাকে। ১৯৯৯-এ অপহৃতদের অনেকেরই বয়ান থেকে পরে জানা যায়, প্লেনের মধ্যে পাঁচ অপহরণকারী পরস্পরকে ওই পাঁচ সাঙ্কেতিক নামেই ডাকছিল। ওঁদের কথা না-হয় বাদ গেল, খোদ ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইটও বলছে, “টু দ্য প্যাসেঞ্জারস অব দ্য হাইজ্যাকড প্লেস (প্লেন?) দিজ় হাইজ্যাকারস কেম টু বি নোন রেস্পেক্টিভলি অ্যাজ় (১) চিফ, (২) ডক্টর, (৩) বার্গার, (৪) ভোলা অ্যান্ড (৫) শঙ্কর, দ্য নেমস বাই হুইচ দ্য হাইজ্যাকারস ইনভেরিয়েবলি অ্যাড্রেসড ওয়ান অ্যানাদার” (৬ জানুয়ারি ২০০০ তারিখের ‘ইউনিয়ন হোম মিনিস্টার’স স্টেটমেন্ট [ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট আইসি-৮১৪]’ শিরোনামের এন্ট্রি দেখে নিতে পারেন যে কেউ)।

তাতে কী, মন মানে না যে! নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি তো আর সেই বিজেপি নয়। পি ভি নরসিংহ রাও-জমানাতেও সংসদে বিরোধী আসনে বিজেপি সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় তেড়েফুঁড়ে যুদ্ধ আর সহবত শেখানোর নিদান হাঁকত। কিন্তু মসনদে বসার পর আইসি-৮১৪ কাণ্ডে অটলবিহারী বাজপেয়ীর দল ও সরকারের মুখটা ঘরে-বাইরে হয়ে উঠল একেবারে করুণ, লজ্জায় গুটিয়ে থাকা। ‘পোখরান-টু’এর পর থেকে উন্নত বিশ্বের অসহযোগিতা, তদুপরি কারগিল যুদ্ধের ধকল এবং শেষে আইসি-৮১৪ কাণ্ড— এই সবই অটলবিহারীর বিজেপি-দল, জোট, সরকার ও সর্বোপরি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। সেই বিজেপিকে তো ভুলতেই চাইবে আজকের বিজেপি— ২০১৪ ইস্তক আগাগোড়া যে নিজেকে গড়েছে বিনয়, নম্রতা, সৌজন্যবোধ ইত্যাদির বিপ্রতীপে: বেপরোয়া শক্তিমত্তা, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির পৌরুষতন্ত্র আর যে কোনও ‘শত্রু’র প্রতি রাখঢাকহীন উগ্রতা দিয়ে।

শুধু নিজেকেই গড়েনি। রাষ্ট্রের বয়ানকেও গড়ে তুলেছে একই ভাবে ও ভাষায়। সমাজের বয়ানকেও। ‘পুরনো’ বিজেপির ‘জঙ্গিমাত্রেই সংখ্যালঘু’কে আজকের বিজেপি সফল ভাবে করে তুলতে পেরেছে ‘সংখ্যালঘুমাত্রেই জঙ্গি’— সমাজের একটা বড় অংশ শুধু বিশ্বাসই করে না তা, প্রচারও করে, বন্ধুবৃত্ত থেকে সমাজমাধ্যমে। আইসি-৮১৪ কাণ্ড নিয়ে তৈরি ওয়েব সিরিজ় তাই স্রেফ একটা ‘ফিকশনালাইজ়ড অ্যাকাউন্ট’, একটা বিনোদনবস্তু বলে মেনে নেওয়া এই ‘নতুন’ বিজেপি ও তার সরকারের, এমনকি সমর্থকদেরও— খুবই অস্বস্তির। এই ধর্ম বনাম ওই ধর্ম, এই জাত বনাম ওই জাত, এই সংখ্যাগুরু বনাম ওই সংখ্যালঘু এ-হেন মেরুকরণ কত ভাবে আর কত দূর করা গেল তার উপরেই যার শাসনতন্ত্র দাঁড়িয়ে, তার মাথা গরম করতে ওই ‘ভোলা-শঙ্কর’ই যথেষ্ট।

কিংবা— পঁচিশ বছর আগের, মরমে মরে যাওয়া কঙ্কালটাকে দেরাজ থেকে টেনে বার করাটাও।

অন্য বিষয়গুলি:

Web Series Emotions
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy