Advertisement
০২ অক্টোবর ২০২৪
West Bengal Flood

কোন পথে সম্ভব বন্যা রোধ

বিপরীত ভাষ্যে দামোদর এবং তার শাখানদীগুলির জলধারণ ক্ষমতা পলি জমার কারণে উত্তরোত্তর কমছে। ফলে বাঁধের ছাড়া জল পরিমাণে বেশি হলেই সেই নদী-খালের দু’কূল ভাসিয়ে তৈরি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি।

পার্থ প্রতিম বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:২৬
Share: Save:

বন্যায় প্রত্যেক বছর এ রাজ্যে পরিচিত শব্দবন্ধ হয়ে উঠেছে ‘ম্যান মেড ডিজ়াস্টার’। এখানে বন্যায়, বৃষ্টির চেয়েও বেশি চর্চিত বিষয় হয়ে ওঠে ডিভিসি-র ছাড়া জল। রাজ্যকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে ডিভিসি-র বাঁধ থেকে ছাড়া জলের ধাক্কায় দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয় বলে সরকারের অভিযোগ। এ বারও তেমনটাই ঘটেছে।

বিপরীত ভাষ্যে দামোদর এবং তার শাখানদীগুলির জলধারণ ক্ষমতা পলি জমার কারণে উত্তরোত্তর কমছে। ফলে বাঁধের ছাড়া জল পরিমাণে বেশি হলেই সেই নদী-খালের দু’কূল ভাসিয়ে তৈরি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি। ডিভিসি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সংস্থা হওয়ায় ডিভিসি-র ছাড়া জলে বানভাসি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই কেন্দ্র বনাম রাজ্য সরকারের চাপানউতোর উচ্চগ্রামে পৌঁছয়। বছর তিনেক আগে এমনই তরজায় রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ঘোষণা করেছিলেন ডিভিসি-র ছাড়া জলে বন্যার কারণে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা। শেষ পর্যন্ত তা আদালত অবধি গড়ায়নি। কিন্তু এ বার মুখ্যমন্ত্রী ডিভিসি-র সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছেদের কথা ঘোষণা করেছেন। শুধু ঘোষণা নয়, দামোদর ভ্যালি উপত্যকা নদী নিয়ন্ত্রক কমিটি (ডিভিআরআরসি) থেকে রাজ্যের দুই প্রতিনিধি পদত্যাগ করেছেন। উল্টো দিকে দেশের জলশক্তি মন্ত্রক বলেছে, বাঁধের নিরাপত্তার কারণেই জল ছাড়ার আগে যাবতীয় নিয়ম মেনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের এমন দাবি নাকচ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

নদী নিয়ন্ত্রক কমিটিতে যে সদস্যরা রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁদের প্রাথমিক কাজ— রাজ্যের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা। প্রবল বৃষ্টিতে উচ্চ দামোদর এলাকায় কত বৃষ্টি হলে কত জল ছাড়া হবে বিভিন্ন জলাধার থেকে, তার নিরাপদ পরিমাণ নির্ভর করে বাঁধে জমা জল এবং দামোদরের নিম্ন উপত্যকার বিভিন্ন নদীনালায় জমা জলের পরিমাণের উপরে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নদী নিয়ন্ত্রক কমিটির আলোচ্য সূচিতে না থাকছে বাঁধগুলির ধারণক্ষমতার মূল্যায়ন, না হচ্ছে আলোচনা মজে আসা দামোদর, শিলাই, কংসাবতীর ধারণক্ষমতা নিয়ে। অথচ, জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে ঘটছে অত্যধিক বৃষ্টি। ফলে বাঁধের বিপদসীমায় দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে বৃষ্টির জল, উপচে পড়ছে নদী। কমিটির কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব হল বন্যা নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়ে ডিভিসি-র জলাধারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির রূপরেখা স্থির করা। আর রাজ্যের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব ছিল ফি বছর বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলগুলি সংলগ্ন নদীর ধারণক্ষমতার মূল্যায়ন করা, রূপরেখা কার্যকর করা। দরকার ছিল বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে নদীবাঁধের উচ্চতা এবং শক্তি বৃদ্ধি, যাতে জলের তোড়ে তা ভেঙে না যায়। আর, পলি তুলে নদীখাতের গভীরতা বৃদ্ধি।

এ সব সংস্কার যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। এবং এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করলেও বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা বাড়তে পারে মাত্র ১৪%। ফলে পলি সংস্কার হলেও অতিবৃষ্টির কারণে জমা জলের ধাক্কা সে পথে সামলানো কার্যত অসম্ভব। বিকল্প হিসাবে ভাবা যেতে পারে ডিভিসি প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের নদীবাঁধ নির্মাণের কাজ। কারণ, ডিভিসি-র মূল প্রস্তাবের সাতটি বাঁধের চারটির নির্মাণ সম্পন্ন হলেও বাকি আরও তিনটি। বাঁধগুলির সম্মিলিত ধারণক্ষমতার মাত্র ৩৬% এখন কার্যকর। এই কাজ সম্পন্ন করা গেলে এখনকার তুলনায় দেড়গুণ বেশি জলধারণ সম্ভব।

লক্ষণীয়, অল্প সময়ের মধ্যে বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ার কারণে বাঁধগুলি কিংবা নদীপথের আশেপাশের ‘ক্যাচমেন্ট এরিয়া’ থেকে যতটা দ্রুত জল ছুটে এসে বাঁধে জমা হত চার দশক আগে, এখন নগরায়ণ ও নির্মাণের প্রভাবে তার চেয়েও দ্রুত হচ্ছে। ফলে বাঁধ থেকে জল ছাড়ার পরিমাণও দ্রুত বাড়াতে হচ্ছে। পাশাপাশি নদীর বুকে যত্রতত্র গড়ে ওঠা বালি খাদান বহু জায়গায় পাল্টে দিচ্ছে নদীর গতিপথ, ফলে বাড়ছে প্লাবনের বিপদ। মজে যাওয়া নদীর চরে গজিয়ে উঠেছে বসতি, অবরুদ্ধ হয়েছে জল যাওয়ার রাস্তা। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে তৈরি দামোদর নদী নিয়ন্ত্রক কমিটির অন্যতম কাজ ছিল কার্যকর মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরিকাঠামো সংস্কার।

প্রতি বছর এখন যে সংখ্যায় বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে, তাতে উপকূলবর্তী রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বিপদ বাড়ছে। নিম্নচাপের দাপটে বৃষ্টি হচ্ছে ঝাড়খণ্ডে, জল জমছে ডিভিসি-র বাঁধে আর জল ছাড়লেই বন্যা হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গে। প্রশ্ন হল, এই প্রযুক্তিনির্ভর যুগে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস সাত দিন আগে পেলে সেই জল বাঁধ থেকে পর্যায়ক্রমে নিরাপদে ছাড়ার পরিকল্পনা কি সত্যি অসম্ভব? এই বাস্তব সমস্যাই আলোচিত হওয়া উচিত সেই যৌথ কমিটির সভায়। মনে রাখা উচিত, কোনও প্রতীকী পদত্যাগের মাধ্যমে ডিভিসি-র সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করা রাজ্য সরকারের আর্থিক কারণেই সম্ভব নয়। জলবিদ্যুৎ, তাপবিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ মিলিয়ে মোট আটটি সংস্থায় ডিভিসি-র উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ৪৫৯৬ মেগাওয়াট, যার উপর নির্ভর করে গোটা রাজ্য।

আজ ভাঙা বাঁধের নদীর জলে কিংবা ডিভিসি-র ছাড়া জলে বিপন্ন মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার উপক্রম। এটা বুঝতে হবে কেন্দ্র রাজ্য সব পক্ষকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE