E-Paper

কবিতা যে নিজেই রাজনীতি

লিটল ম্যাগাজ়িন আন্দোলনের প্রথম যুগের সীমানা চিহ্নিত করেছে এই পত্রিকা। তার গোষ্ঠীবদ্ধতায়, প্রকাশের ব্যাপারে তার অনিয়মিততায়, খামখেয়ালিপনায়, তার স্পর্ধায়।

যশোধরা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:২৬
Share
Save

আমরা চেয়েছিলাম এস্টাবলিশমেন্টের দখল নিতে। আমরা দখল করব, করে আমরা আমাদের নিজের লেখাই লিখব।” ‘কৃত্তিবাসের আড্ডা’য় বলেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (ছবি)। কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্মলগ্ন, অর্থাৎ ১৯৫৩-তে কী ভাবে আপতিক ঘটনাক্রম, বিশের কোঠার দুই যুবক সুনীল ও দীপকের হাতে তুলে দিয়েছিল কবিতার যুগ-বদলের বা সীমানা চিহ্নিত করার আয়ুধ, সে গল্পও আজ উপকথা।

কৃত্তিবাস-এর সূচনার ইতিহাস বিচিত্র। তার জন্মলগ্নে কোনও আয়োজন বা পরিকল্পনার চিহ্ন ছিল না। অর্বাচীন কবিযশোপ্রার্থী দুই যুবক এসেছিলেন সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্তের কাছে তাঁদের লেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে। তিনি তাঁদের উচ্চাশা ও স্বপ্ন ভেঙে দেননি। বরং পরামর্শ দিয়েছিলেন, শুধু দু’জনের কবিতার বই কেন, বরং একটি পত্রিকা প্রকাশিত হোক, যেখানে সমকালের বাংলা কবিতার ছবি ফুটে উঠবে।

রাজনৈতিক কবিতা লেখার পথে না গিয়েও একটি পত্রিকা যে নিজের কব্জির জোরে নিজেই রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ কৃত্তিবাস। ইতিহাসের সঙ্গে সে অভিসারে বেরিয়েছিল। জওহরলাল নেহরুর বিখ্যাত ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’র সামান্য পরে। যার আগে আর পরের বাংলা কবিতাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে চিনে নেওয়া যাবে।

লিটল ম্যাগাজ়িন আন্দোলনের প্রথম যুগের সীমানা চিহ্নিত করেছে এই পত্রিকা। তার গোষ্ঠীবদ্ধতায়, প্রকাশের ব্যাপারে তার অনিয়মিততায়, খামখেয়ালিপনায়, তার স্পর্ধায়। তার আত্মবিশ্বাস আর কবিতার প্রতি ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’-এও, যেমন বলেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। “আসলে যে কাণ্ড ঘটেছিল সব কবির বুকের মধ্যে তা হল প্রচণ্ড বিরক্তি থেকে উদ্ভূত ধ্বংস করার ইচ্ছে— সৃষ্টির নামান্তর— যা কিছু পুরনো পচা, ভালমন্দ, সোনারুপোর খনি, এমনকী নিজেদের শরীর ও অস্তিত্ব— সর্বস্বের সর্বনাশ।” শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন এ কাগজ নিয়ে। এক বছর পূর্তির সংখ্যায় সম্পাদক সুনীল লিখেছিলেন, “এক হিসেবে কৃত্তিবাসের মূল্য ঐতিহাসিক। কারণ, এখানে ভবিষ্যৎ বাংলা কবিতার গতিপথের চিহ্ন রইল।... বাংলাদেশের তরুণ কবিরা প্রত্যেকেই তিনমাসের মধ্যে যেটি শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখবেন, সেটি কৃত্তিবাসে পাঠাবেন। কারণ এই কৃত্তিবাসের পাতাতেই তাঁদের ভবিষ্যতের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।” নবীন লেখকদের দাপুটে নোটিস দিয়েছিল এই কাগজ, “আধুনিক কবিতা যাঁরা লিখবেন তাঁদের আধুনিক কবিতার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সজাগ থাকা প্রয়োজন।” একে বলা চলে নির্দেশিকা। একই সঙ্গে অশ্লীলতা বা স্বীকারোক্তি-মূলক লেখার দায়ে কৃত্তিবাস-এর বিতর্কিত হয়ে ওঠার প্রবণতাও আইকনিক।

কৃত্তিবাস কিন্তু ঘোষিত ভাবেই ছিল যে কোনও ‘সমাজমনস্ক’ ও ‘রাজনৈতিক’ কবিতার থেকে শত হস্ত দূরে। যে বামপন্থী রাজনীতি তখন জোরালো হয়ে উঠছে, তা আঁকড়ে ইস্তাহার লেখার বিরোধী সুনীল-শক্তি-তারাপদ-শরৎ-বেলাল-দীপক-সন্দীপনরা। চিৎকৃত প্রতিবাদের কবিতাকে বর্জন করেও, কৃত্তিবাসী কবিরা পঞ্চাশের দশকের যথার্থ প্রতিভূ: গজদন্তমিনার থেকে নেমে এল কবিতা, কলোনির জীবনে। পঞ্চাশ উদ্বাস্তুর দশক: স্বাধীনতার, স্বপ্নভঙ্গেরও। খাদ্যসঙ্কট, রেশনব্যবস্থার ব্যর্থতা, বন্যাস্রোতের মতো শরণার্থীর ঢল, ’৫২-র প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নিজ স্বার্থরক্ষার দাবিতে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির নিজের আন্দোলন। ট্রামের এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যাপক আন্দোলন, যার নেতৃত্বে শহরের যুবা।

পাশাপাশি পুব বাংলা বা মফস্‌সল থেকে আসা তরুণ কবিদের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নয়, ভাষাবদলের দায়বদ্ধতা। বস্তুত আত্মজৈবনিক কবিতা লেখার ভাবনা আর বিক্ষুব্ধ যুবচেতনার ইন্ধনে সলতে দেওয়া। নানা স্বর, নানা সুর কৃত্তিবাস-এর পাতায় পাতায় ফলে উঠেছিল। শান্ত স্বরের আগুন নিয়ে শঙ্খ ঘোষ, পাশে কবিতা সিংহ ঝলসে উঠেছেন স্পর্ধিত নারীস্বর নিয়ে। আবার উৎপলকুমার বসু বা কেতকী কুশারীর প্রজ্ঞাবান মেধাচর্চাও।

পরে কৃত্তিবাসীরা তাঁদের নানা ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর জন্য স্মরণীয় হবেন। তাঁদের জীবনের গল্প অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসের পাতা থেকে সত্যজিতের ছবিতে অমরত্ব পাবে। এই বহু-আলোচিত যৌথযাপনের মধ্যমণি হিসাবে সুনীলের ভূমিকা যেমন অবিসংবাদিত, তেমনই সমালোচনাবিদ্ধ তাঁদের সবার বোহেমিয়ান জীবনযাপনও। তরুণমন জানতে চায়, কেন ড্রয়িংরুম থেকে কবিতাকে খালাসিটোলা অবধি আনতে, যৌনতা বিষয়ে ট্যাবু ভাঙতে, মাঝে মাঝে নারীদেরও বিষয় বা ভোগ্য করে তুলতে হয় পুরুষচিহ্নিত আত্মকেন্দ্রিক অশ্বারোহীদের? কেন প্রান্তিক সমাজের নারীদের ‘ব্যবহার’ করার ‘অ্যানেকডোট’ লেখা হয়? পুরুষকেন্দ্রিক বিশ্বধারণায় নারীসম্পর্ক কেন ‘ট্রফি’ হিসাবে উদ্‌যাপিত? নিজেদের যৌথতার স্পর্ধা নিয়ে এক রকমের মিথ রচনা করে নেশা ও যথেচ্ছাচারের সঙ্গে সাহিত্যিকের জীবন-মেলানো, বিট-কবি গিন্সবার্গের এই বন্ধুরা।

তবু, অর্ধশতাব্দী বা শতাব্দী পার করেও আলোচিত হতে থাকা বাংলা সাহিত্যের এই চরিত্রেরা বিস্ময়কর। আজ আতশকাচের তলায় দুনিয়ার সব বড় সাহিত্যিকই। প্রয়াণের বারো বছর পরেও তুমুল বিতর্কের কেন্দ্রে আজও থেকে যান সুনীল। তাঁর অগণিত কাজের বিশালতার পাশাপাশি, সত্তর পেরোনো কৃত্তিবাস-কে ফিরে দেখতেই হয়। একমাত্র সময়ের হাত ধরতে পারলেই যে কবিতা তার তাৎপর্য খুঁজে পায়! বড় বাণী বা আদর্শের ব্যবহারের জন্য কবিতা নয়, কবিতা যে নিজেই রাজনীতি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sunil Gangopadhyay

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।