একবার আমরা জেগে উঠলাম বেহেশ্তে/ দেবদূতের দল আমাদের অবাক করলেন/ ঝাড়ু আর ঘরমোছার ন্যাতা হাতে:
‘তোদের গায়ে মদ আর পৃথিবীর গন্ধ/ তোদের পকেটভর্তি/ কবিতা আর হরেক কিসিমের ধর্মদ্রোহ’/ হে আল্লার বান্দাগণ, আমরা বললাম,/ এতো কঠোর নাই বা হলেন আমাদের উপর/ আমাদের অনন্ত প্রতীক্ষা শুধু হাইফা শহরে একটি ভোরের/ স্বপ্ন এখানে হাজির করেছে আমাদের/ স্রেফ ভুল করে।” (বেহেশ্তে)।
এই কবিতার সামনে বছর দুয়েক আগে আমাকে হাজির করেছিলেন পাকিস্তানের অসামান্য উর্দু কবি আফজ়াল আহমেদ সৈয়দ। তিনি মুগ্ধ। জেরুসালেমবাসী কবি নজোয়ান দরবিশের জন্ম ১৯৭৮-এ (ছবি)। আরব্য সাহিত্য তোলপাড় তাঁর কবিতায়। তর্জমা হয়েছে কুড়িটি ভাষায়।
কিন্তু আমি ধাক্কা খেলাম। পার্শ্বগামী জনৈক পথচারীর ক্ষণিক কৌতূহলেই তাঁকে বিভোর করার কবিতা এ একেবারেই নয়। একবিংশ শতকের এই ভয়ঙ্কর দ্বন্দ্বক্লিষ্ট দুনিয়ায় বসে স্মৃতিমেদুরতা মেঘাশ্লিষ্ট মনে আলগোছে পড়ে বিরহ মধুরতর করার কবিতা এ নয়। এ কবিতা পাঠকের সক্রিয় অংশগ্রহণ দাবি করে। নজোয়ানের কবিতা দারুণ সমৃদ্ধ আরবি কবিতার দীর্ঘ পরম্পরা, এমনকি অব্যবহিত পূর্বজ কবি মহমুদ দরবিশের মগ্ন মন্দ্র স্বরের থেকেও একেবারে পৃথক।
নজোয়ান তাঁর প্রথম কবিতা সঙ্কলনেই উচ্চারণ করেন: আমি ইতিহাসকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলি। তাঁর কবিতা ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা’ পথে লবনাঁ, প্যালেস্টাইনের রক্তস্নাত ইতিহাসের সঙ্গে পাঠককেও যেন হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলতে থাকে— কিন্তু কেবলমাত্র অংশগ্রহণকারী পাঠককেই। এ কবিতা ‘পার্টিসিপেটরি’।
বিশদে বলার পরিসর এ নয়। শুধু ইঙ্গিত দিতে পারি— হাইফা শহরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দ্বিচারিতা, দয়ির ইয়াসিন গণহত্যা, ইজ়রায়েল দখল, যদি আপনি এ সব বিষয়ে কিছুই না জানেন, এমনকি জেনেও যদি নির্বিরোধী নিরপেক্ষ অবস্থানকেই শ্রেয় মনে করেন তবে একেবারে গোড়ায় উল্লিখিত ‘বেহেশ্তে’ কবিতা বৃথা। আবার, সত্যিই কবিতা ভালবাসলে এ কবিতা আপনাকে কলার ধরে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে সেই ইতিহাসে।
অবিমিশ্র আরব্য স্বর নজোয়ান। পশ্চিম এশিয়ায়, প্যালেস্টাইনে, লবনাঁয় শ্বেতাঙ্গ পশ্চিমি দুনিয়ার সক্রিয় আশকারায় ইজ়রায়েলের ভয়াবহ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক যোদ্ধা তিনি। পূর্বজদের অনেক চিরায়ত স্বরে পেনসিল বুলিয়ে চিরায়ত উচ্চারণের কোনও লোভ, এমনকি সর্বজনের গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠারও কোনও চেষ্টা তাঁর নেই। নজোয়ানের কবিতা গভীরে পক্ষপাতী— তাতে ‘আম্মো ভাল আর তুম্মো ভাল’-র কোনও জায়গা নেই।
গভীরে পক্ষপাতী প্রাচ্য এই কবির স্বর, যা শ্বেতাঙ্গ দ্বিচারী ঔপনিবেশিক মানসের ‘লিবার্তে’ বা স্বাধীনতার ধারণাটাকেই প্রত্যাখ্যান করে— “মানুষকে পথ দেখাচ্ছেন মুক্তি/ দুই স্তন খোলা/ ডান হাতে তাঁর ফরাসি পতাকা/ বাঁ হাতে বেয়নেট দেওয়া রাইফল/ কিন্তু এও তো নজর করুন, খালি পায়ে মুক্তি/ কী ভাবে চলেছেন, মানুষকে মাড়িয়ে পিষে ফেলে।” (মুক্তি)।
এ কবিতা দাবি করে দ্যলাক্রোয়া-র ‘লা লিব্যর্তে গিদঁ ল্য প্যপ্ল’ ছবিটি আপনি খুঁটিয়ে নজর করুন, তার ইতিহাস নজর করুন এবং অন্য কোনও ‘মুক্তি’-র খোঁজে যুযুধান শিবিরে যোগ দিন— যে ‘মুক্তি’ আপাদমস্তক ঔপনিবেশিক দ্বিচারিতা ও ‘মুক্তি’-র ইউরোপীয় সংজ্ঞার প্রতিস্পর্ধী।
খুঁটিয়ে পড়লেই দেখা যাবে বিবিধ রঙের ঔপনিবেশিক ও স্বৈরাচারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান কবি, আরমানি, কুর্দ, ইরানি, মিশরীয়, ল্যাটিন আমেরিকান, জিপসি, এমনকি আলজিরীয় ফরাসি স্বরের ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেন এক আন্তর্জাতিক গেরিলা ব্রিগেড গড়তে চায় তাঁর কবিতা। তথাপি, নজোয়ানের কবিতা নির্ভেজাল আরবি ও ফিলিস্তিনি। পঁচাত্তর বছর ধরে সমস্ত তথাকথিত আন্তর্জাতিক আইন তাচ্ছিল্যে উপেক্ষা করে ইজ়রায়েল যে মর্মান্তিক অত্যাচার চালিয়ে চলেছে ফিলিস্তিন, লবনাঁর মানুষের উপর, এবং বুড়ো আঙুল চুষে চলেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত ইত্যাদি ও বস্তুত সারাটা দুনিয়াই— বিশেষ করে বিংশ শতকের শেষ থেকে, তাতে তিনি ক্রুদ্ধ। কখনও বা ক্লান্ত প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অবিরাম যুদ্ধরত ফিলিস্তিনি নবীনদের নিরন্তর রক্তস্রোতে: “ঝুলন্ত যারা/ বড়ো ক্লান্ত/ তাই নামিয়ে আনো আমাদের/একটু বিশ্রাম দাও” (ক্রুশে ক্লান্ত)। তবু কখনও, কোনও মূল্যে, কোনও আত্মবিস্মৃতিবিলাসে, স্বপ্নেও শতবার পরাজিত তাঁর পতাকা ছেড়ে, এই দুনিয়া ছেড়ে কোনওখানে যেতে চান না নজোয়ান। কোনও জন্নত, বেহেশ্ত তাঁর নেই, এই পৃথিবী আর সেই পতাকাটা ছাড়া: “জন্নতে ডানা চাইনা আমি/...আমি তোমাকে চাই—/পৃথিবী/ আমার পরাজিত পতাকা।” (আমার পরাজিত পতাকা)।
তাঁর কবিতায় যোগ দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আমি ভাবতে থাকি— পৃথিবীটাই কবির পতাকা না কি ‘পরাজিত পতাকা’-টাই কবির পৃথিবী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy