Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Novelist

পুরুষ মনে করে, সে হল দাতা

ধর্মকেও তিনি মেলালেন সংস্কৃতির সঙ্গে। বললেন, “আমি মুসলিম, তাই মূর্তিপূজা পাপ।

ইসমত চুগতাই।

ইসমত চুগতাই।

বিতস্তা ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২২ ০৬:৫২
Share: Save:

সাহিত্যিক কৃষণ চন্দর তাঁকে বলেছিলেন পুরুষের সৌন্দর্য নিয়ে একটি লেখা লিখতে। তিনি জানালেন, প্রথম সুযোগেই লেখায় হাত দেবেন। তার পরেই মন্তব্য, “মেয়েদের ব্লাউজ় নিয়ে কয়েক হাজার কবিতা লেখা হয়েছে, আমি লিখব ছেলেদের জাঙিয়া নিয়ে।” এমনই ছিলেন উর্দু সাহিত্যের আলোচিত ও সমালোচিত লেখক ইসমত চুগতাই (ছবি)। মা-বাবার নবম সন্তান তিনি, এবং মেয়ে। আয়ার কাছে মানুষ, মায়ের আদর জানা হয়নি। তাঁর মনে হত, “মা বোধ হয় আমাকে ঘৃণা করত।” সঙ্গে ছিল সমবেদনাও: “আমরা এত জন সন্তান ছিলাম যে আমাদের দেখলেই মা বিরক্ত হত।” তাঁর মনে হয়েছিল, গর্ভধারণ মায়ের কাছে ছিল শাস্তির মতো। এ থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন মেয়েদের নানা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা। বুঝেছিলেন, কেমন করে সমাজ নারীকে বোরখায় ঢাকে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে চায়, বিয়ে ও সন্তানধারণকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে দেয়।

গত রবিবার ছিল তাঁর জন্মবার্ষিকী। জন্ম ১৯১১ সালে উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে সাদা ঘোড়ায় চড়ে ‌তাঁর প্রথম প্রতিবাদ, নিজস্ব জয়ের অনুভব। দাদাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিখলেন বন্দুকের নিশানা ঠিক করা। তাদের সঙ্গেই গুলি-ডান্ডা, ফুটবল, ঘুড়ি ওড়ানো। মা সেলাই, রান্না শেখাতে চাইলে জানিয়ে দেন, “সব ভাইয়েরা পড়ছে, আমিও পড়ব।” স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। সেই বয়সেই তাঁর মনে হয়েছিল তিনি স্বাধীন থাকতে চান, কিন্তু শিক্ষা ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। মূর্খ মেয়েরা ঘরে বসে স্বামীর থেকে ‘বোকা মূর্খ’ খেতাব পাবে, আবার স্বামী বাইরে গেলেই অধীর আগ্রহে তার ফেরার অপেক্ষা করবে। নিজের এই পরিণতি মানতে চাননি বলে পড়াশোনায় মন দিলেন। নবম শ্রেণিতে বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করলে বুদ্ধি করে নিজের বিয়ে আটকালেন, বোরখা ছাড়াই বাইরে যেতে শুরু করলেন। তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্য: “আমি সব সময় প্রথমে নিজেকে এক জন মানুষ হিসেবে, তার পরে এক জন নারী হিসেবে ভেবেছি। আমি মনে করি না পুরুষ ও মহিলা ভিন্ন।”

ধর্মকেও তিনি মেলালেন সংস্কৃতির সঙ্গে। বললেন, “আমি মুসলিম, তাই মূর্তিপূজা পাপ। কিন্তু পুরাণ আমার জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ, যেখানে সুদীর্ঘ এক সময়কালের সংস্কৃতি ও দর্শন মিশে গিয়েছে।” ধর্ম ও সংস্কৃতি তাঁর কাছে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা দুই বিষয়। ভারতের সব কিছুকেই তিনি মুক্তচিত্তে গ্রহণ করেছেন, বিরোধিতা করেছেন মেয়েদের ধর্মের নামে ঘরে শিকল পরিয়ে আটকে রাখার বিরুদ্ধে। তাঁর কলম গর্জে উঠেছে বশীকরণ, টোটকা, তাবিজ-সহ সমাজের একাধিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ ‘লিহাফ’ গল্পটি, যা তাঁকে অশ্লীলতার দায়ে আদালত অবধি টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি কোনও ভাবেই লেখার জন্য ক্ষমা চাইতে রাজি ছিলেন না।

লাহোরের আদালতে যাওয়ার সময় তাঁকে দেখতে রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। তখন তাঁর পরিচয় শুধু এক সাধারণ লেখক নন, ‘নীল’ সাহিত্যের লেখক। কিন্তু মেকআপ-হীন, সাদা শাড়ি পরা এক কালো মহিলাকে দেখে অচিরেই সবাই হতাশ হয়ে পড়ে। সুন্দরী ছিলেন, তবু চার পাশের মানুষ যে তাঁকে যৌন কামনার দৃষ্টিতে দেখতে জড়ো হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। অথচ আজীবন তিনি চেয়েছেন ভালবাসা মাখা, স্নেহময় এক পৃথিবী। তাই বার বার শৃঙ্খল ভেঙেছেন, বিরোধীরা হইচই করেছে তাঁকে নিয়ে। শেষ অবধি জয় হয়েছে তাঁরই।

ইসমত চুগতাই মানেই এক স্বতন্ত্র নারীর কণ্ঠস্বর। নিজের মায়ের সঙ্গে কখনও সখ্য গড়ে ওঠেনি তাঁর, অথচ মা ও দিদিদের দেখেই অনুভব করেছিলেন মেয়েদের যন্ত্রণা। তাঁর লেখায় তাই মেয়েদের অপমান, বেদনার কথা। মানবসন্তান বেড়ে ওঠে মেয়েদের জঠরে, কিন্তু পুরুষ মনে করে সে দাতা, নারীকে স্থান দেয় পিছনের সারিতে— ইসমতের কলম তা থেকে উত্তরণের জন্য উন্মুখ, প্রতিবাদী। মোল্লা, পণ্ডিত, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ— সবাই তাঁর লেখার চরিত্র; সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, দর্শনও স্থান পেয়েছে তাঁর লেখায়। লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, নাটক, রিপোর্টাজ়, ভ্রমণকাহিনি, সিনেমার চিত্রনাট্য। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “পুরুষ নারীকে পুজো করে দেবী বানাতে প্রস্তুত... কিন্তু সমান সমান হওয়ার মর্যাদা দিতে পারে না। পুরুষ ভাবে, অশিক্ষিত মেয়েদের সঙ্গে দোস্তির কী আছে? কিন্তু দোস্তির জন্য ভালবাসার প্রয়োজন, জ্ঞানের নয়।”

চেয়েছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁকে সমুদ্রের ধারে দাহ করা হোক। এক জন ‘মানুষ’ হিসেবেই তাঁর এই ইচ্ছে। মৌলবিদের সব বাধা উপেক্ষা করে মুম্বইয়ের চন্দনবাড়িতে আগুনেই দাহ করা হয় তাঁকে। তিনি একাই যে কাজ করেছিলেন, তার সামান্যও যদি করে ওঠা যেত, তা হলে হয়তো বৈষম্যহীন এক সমাজের পথে এগোতে পারতাম আমরা।

অন্য বিষয়গুলি:

Novelist Ismat Chughtai
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy