জীববিজ্ঞানীরা গত কয়েক দশক মেতে রয়েছেন আশ্চর্য এক রসের নেশায়। করোনাভাইরাসের সঙ্গে এই ‘রস’-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই বিশেষ রসের পুরো পরিচয় ‘রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস’। অক্সিজেন থেকে উদ্ভূত ফ্রি-র্যাডিক্যাল বা নন-র্যাডিক্যাল, যারা স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম এবং যাদের সর্ববহিস্থ কক্ষে জোড়বিহীন ইলেকট্রন থাকে, তাদের একত্রে রস বলে। এগুলি কম আণবিক ওজনের অণু যা অন্তঃকোষীয় সঙ্কেত বহনে কার্যকর। অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হলে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস উৎপন্ন করে। রস-গোত্রের নতুন নতুন সদস্য নিয়মিত আবিষ্কৃত হলেও জীবের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াতে প্রধানত সিঙ্গলেট অক্সিজেন, সুপারঅক্সাইড, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এবং হাইড্রক্সিল র্যাডিক্যালকে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায়। প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রায় প্রতিটি কোষে রস উৎপাদনের সুগঠিত পরিকাঠামো উপস্থিত।
জীবের প্রাণধারণের জন্য অত্যাবশ্যক হলেও একটি নির্দিষ্ট সীমার উপরে অক্সিজেন কোষের ক্ষতিসাধনে সক্ষম। একে অক্সিজেন বিষক্রিয়া বলে। এটি আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফুসফুসকে আঘাত করে, কাশি-শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করে, মৃত্যুও ঘটাতে পারে। যে রসের কথা বলা হচ্ছে, তারা তাদের রাসায়নিক চরিত্রের বলে অক্সিজেনের চেয়েও প্রতিক্রিয়াশীল। রস, মুখ্যত হাইড্রক্সিল র্যাডিক্যাল, কোষের গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত যৌগকে (যেমন ডিএনএ, আরএনএ, প্রোটিন, লিপিড) ভেঙে ফেলতে পারে। ফলে, কোষের মৃত্যু অনিবার্য হয়। এই ধরনের রস-প্ররোচিত অক্সিডেটিভ স্ট্রেস প্রাণিদেহে বার্ধক্য, কার্ডিয়োভাসকুলার রোগ, দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগ, ক্যানসার ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। উদ্ভিদের দেহে সালোকসংশ্লেষের বাধা, ইলেকট্রোলাইটের অনিয়ন্ত্রিত নিষ্ক্রমণ বা কোষের মূল কাঠামোর ক্ষতিসাধন ইত্যাদিও রসদ্বারা সৃষ্ট হয়। কিন্তু কয়েক দশকের গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, জীবদেহে রসের কিছু উপকারী ভূমিকাও রয়েছে। নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় উৎপন্ন হলে রস বিপাকক্রিয়া বা অনাক্রম্যতা, অন্তঃকোষীয় প্রায় সমস্ত কাজেই সাহায্য করে। ফলে জীবের বৃদ্ধি এবং বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবেও রস স্বীকৃত। কিন্তু এ-হেন বহুরূপী রসের সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের সম্পর্কটা ঠিক কোথায়?
করোনাভাইরাস যেমন রসের মাধ্যমে মানবকোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তেমনই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে নিজেকে বাঁচাতে রসকে নষ্টও করে ফেলতে পারে। এই দু’টি প্রক্রিয়াকে যথাক্রমে ‘রস অ্যাটাক’ এবং ‘রস এসকেপ’ বলে। করোনা এবং ফুসফুসের ক্যানসার— দুই রোগের সঙ্গেই রস ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। করোনা সংক্রমণের ফলে দেহে অত্যধিক রস উৎপাদন এবং ফলত অক্সিডেটিভ স্ট্রেস রোগীর ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া ইত্যাদির পথ প্রশস্ত করে। কোভিড-এর প্রাথমিক উপসর্গগুলির মধ্যে হালকা জ্বর, শুকনো কাশি, গলা ব্যথা, ক্লান্তি এবং মৃদু শ্বাসকষ্ট প্রধান। গভীর সংক্রমণে দেখা যায় প্রবল শ্বাসকষ্ট এবং হাইপক্সিয়া, যেখানে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৫%-এরও নীচে নেমে যাচ্ছে। বোঝা গিয়েছে, রসের মাধ্যমেই তীব্র উপসর্গযুক্ত রোগীর দেহে সাইটোকাইন ঝড় শুরু হয়। করোনাভাইরাস প্রধানত চার ধরনের প্রোটিন দ্বারা গঠিত। এদের মধ্যে ই-প্রোটিন বিভিন্ন রস তৈরিতে সক্ষম। হাইপক্সিয়ার সময় মানবকোষের মাইটোকন্ড্রিয়াও বেশি পরিমাণে রস তৈরি শুরু করে। এই সদ্যপ্রস্তুত রস আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতায় অপরিহার্য এন কে কোষ, টি কোষ, বি কোষ ইত্যাদিকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে, মানবদেহের সম্পূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। এক দিকে হাইড্রক্সিল র্যাডিক্যাল সরাসরি লিপিড, প্রোটিন, ডিএনএ-কে ভাঙতে থাকে, অন্য দিকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এমন কিছু জিনের ট্রান্সক্রিপশনকে বাড়িয়ে দেয় যারা প্রদাহ সৃষ্টিকারী সাইটোকাইনগুলি তৈরি করে। রস ও সাইটোকাইনের মিথস্ক্রিয়ার ফলে মাইটোকন্ড্রিয়া ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়লেও মাইটোকন্ড্রিয়া কার্যক্ষম থাকে না। এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে কোভিড-১৯ রোগীকে মাল্টি অর্গ্যান ফেলিয়র ও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। এটিই ‘রস-অ্যাটাক’ বা রসকে বর্শা হিসেবে ব্যবহার করার পদ্ধতি।
করোনাভাইরাস নিজের প্রয়োজনে রসকে নিষ্ক্রিয়ও করতে পারে। আমাদের দেহের ফ্যাগোসাইটিক কোষগুলি ভাইরাসটিকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে রস উৎপন্ন করে। মানবদেহজাত এই রসের হাত থেকে ভাইরাসকে বাঁচায় সেই ই-প্রোটিনের কেরামতি। ই-প্রোটিন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে ভেঙে দিয়ে নিজেকে বাঁচায়, তার সঙ্গে সঙ্গেই রোগীকে ঠেলে দেয় ‘হ্যাপি’ বা ‘নীরব’ হাইপক্সিয়ার দিকে। তখন রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ অত্যন্ত কমে গেলেও শরীরে বাহ্যিক লক্ষণ (শ্বাসকষ্ট, কাশি) থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি চিহ্নিতই করা যায় না। গুরুতর লক্ষণ প্রকাশের পরে, হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখা যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। অর্থাৎ, করোনাভাইরাস ‘রস অ্যাটাক’-এর মাধ্যমে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করছে, আবার ‘রস এসকেপ’ প্রক্রিয়ায় নিজেকে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে আড়াল করছে।
সারা পৃথিবীর মতো ভারতেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রস বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। প্রায় প্রতি দিন নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। দেখা যাক, মারণ ভাইরাসকে চিরতরে প্রতিহত করার মতো কোনও স্থায়ী সমাধানের দিশা আমরা দর্শাতে পারি কি না।
উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy