প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ।
মিখাইল গর্বাচভ, প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৯১ সালে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র অবসানের যিনি মূল স্থপতি বলে কথিত, ৩০ অগস্ট মস্কোর এক হাসপাতালে যখন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন ৯১ বছর বয়সের জীবনের উজ্জ্বলতম মুহূর্তগুলি থেকে তিনি চলে গেছেন অনেক অনেক দূর— তিন দশকেরও বেশি। ব্যাপারটা অবশ্যই সোভিয়েট রীতিবিরুদ্ধ। নেতারা সচরাচর ক্ষমতাসীন থাকতেন বার্ধক্য (ও অপদার্থতার) উপান্ত পর্যন্ত। না হলে প্রাণ হারাতেন রাজনৈতিক আততায়ীর বুলেটে। গর্বাচভ সেই অর্থে ভাগ্যবান। ১৯৯১ সালের ক্রিসমাসের রাত্রে, যখন তিনি সোভিয়েট ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করলেন, এবং নবজাতক রাশিয়ার নেতৃত্ব অর্পিত হল তাঁর যুগপৎ সমর্থক ও সমালোচক বরিস ইয়েলতসিনের উপর, তখন রাতারাতিই তিনি হয়ে গেলেন সাধারণ মানুষ। আজ যাঁদের ত্রিশের কাছাকাছি বয়স, তাঁদের অনেকেই গর্বাচভ-কে চিনবেন বড়জোর মার্কিন পিৎজা-বিক্রেতার অথবা হ্যান্ডব্যাগ নির্মাতার বিজ্ঞাপনে। তাঁরা জানবেনও না যে, আশির দশকে এই মানুষটি ক্রেমলিন-এ না থাকলে ঠান্ডা যুদ্ধ যে কোনও মুহূর্তে গরম হয়ে উঠতে পারত। এবং তা ঘটলে হয়তো এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন পড়ত অনেকগুলি প্রজন্মের অস্তিত্বের উপর।
কোনটি গর্বাচভের উজ্জ্বলতম সময়? মোটেই স্ট্যালিন বা ব্রেজনেভের মতো দীর্ঘস্থায়ী নয় সে সময়। তার মেয়াদ মাত্র ছয় বছর, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১। তারই মধ্যে তিনি যুদ্ধোত্তর বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, তা অবিস্মরণীয়। ‘রিফর্মার’ তো তিনি বটেই, কিন্তু তিনি পুঁজিবাদের মাপে কাটা রিফর্মার ছিলেন না। না তিনি চেয়েছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের অবসান, না সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির গণেশ ওলটান। তিনি শুধু চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের একটি মানবিক মুখ। মানুষটি একান্ত ভাবে বিশ্বাস করতেন যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ঘোচাবার জন্য সমাজতন্ত্রই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। এবং আন্তর্জাতিক আবহাওয়া শান্তিপূর্ণ না হলে তাঁর নিজের দেশেও করের অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হবে অস্ত্র সংগ্রহে। লঙ্ঘিত হবে নাগরিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিষেবা খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজন। ক্রেমলিনের আসনে বসবার আগেই তিনি যে বিষয়ে শিউরে ওঠেন তা হল আশির দশকের সুচনায় সোভিয়েটের মোট জাতীয় উৎপাদনের যে অংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছিল তার বহর দেখে— ২৬ শতাংশ। দক্ষিণ রাশিয়ার বিস্তীর্ণ স্টেপের এক কৃষক পরিবারের সন্তান গর্বাচভ তাঁর বাল্য কাটিয়েছেন বাবার সঙ্গে কখনও দিনের বিশ ঘণ্টা মাঠে কাজ করে। আগাম থিয়োরি খাড়া করে কাজে নামার লোক তিনি নন। ১৯৮৫ সালে দল ও সরকারের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর তিনি কর্মপন্থা স্থির করেছিলেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে।
তিনি বুঝেছিলেন, রাষ্ট্রের অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে কিছু প্রভাবশালী লোকের মুখের কথায়। এবং তার জন্য মানুষ যে কোনও প্রতিবাদ করছে না, তার কারণ সরকার পরিচালনায় কোনও স্বচ্ছতা নেই। এর জন্য তাঁর দুই দাওয়াই— ‘পেরেস্ত্রৈকা’ অর্থাৎ পুনর্গঠন, এবং ‘গ্লাসনস্ত’ অর্থাৎ স্বচ্ছতা। অর্থনীতির পুনর্বিন্যাসে তিনি সুবিধা করতে পারেননি কারণ কায়েমি স্বার্থের প্রবল বাধা (আশ্চর্য ব্যাপার, এর বছর পাঁচেকের মধ্যে ভারতের কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও ও তাঁর অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কিন্তু আর্থিক সংস্কারের পথে স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পেরেছিলেন অনেক দূর)। কিন্তু সর্বত্র সাড়া পড়ে যায় সোভিয়েট ইউনিয়নে সদ্যোজাত ‘গ্লাসনস্ত’-এর বহর দেখে। ১৯৮৯ সালে তাঁর প্রচেষ্টাতেই সুপ্রিম সোভিয়েটের নির্বাচন হয় টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে। সেই সঙ্গে ওই সংসদের আলোচনা ও ভোটাভুটি দেখা যেতে শুরু হল টিভিতে। তাঁর উৎসাহে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘নোভায়া গ্যাজেটা’ গর্বাচভের প্রয়াণে কাল প্রকাশিত শোকবার্তায় লিখেছেন, ‘দ্য পলিটিক্যাল মোনোপলি অব দ্য কমিউনিস্ট পার্টি ওয়াজ় ব্রোকেন, অ্যালং উইথ দ্য মিস্টরি অফ ইটস পাওয়ার’।
গান্ধী বা টলস্টয়ের আদলেই গর্বাচভ ছিলেন শান্তির উপাসক। তিনি শুরুতেই বুঝেছিলেন, রাশিয়ার আয়ত্তে পারমাণবিক মিসাইলের পাহাড় জমে থাকলে আমেরিকা কখনওই কমাবে না তার নিজের ‘স্টকপাইল’, না কমবে অন্যান্য মাঝারি পারমাণবিক শক্তির অস্ত্রবৃদ্ধির আগ্রহ। তখন থেকেই তিনি ‘নন প্রলিফারেশান ট্রিটি’র প্রবল সমর্থক হয়ে ওঠেন এবং বহু দেশে এনপিটি-র সপক্ষে বক্তৃতা করতে শুরু করেন। যে দুই রাষ্ট্রনেতার দৃষ্টি তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয় তাঁরা হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার।
গর্বাচভ ও মোহনদাস গান্ধী—দু’জনেরই কাম্য ছিল শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা। দু’জনেই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তাঁদের প্রচেষ্টার জন্য। গর্বাচভ পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। তবু তাঁদের কেউই অর্জন করেননি পূর্ণ সাফল্য। গান্ধী ভুল ভেবেছিলেন যে তাঁর প্রয়াসেই হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষবিষের অবসান হবে। সেই ভুলের মাশুল তিনি দিলেন তাঁর জীবন দিয়ে। গর্বাচভ ভুল করেছিলেন যে সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবেন রেগনের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বুশ চাইছিলেন, যেমন করে হোক, তাঁর আমলেই যেন ইউএসএসআর শব্দবন্ধটি চটজলদি নির্বাসিত হয় মানচিত্র থেকে— তা সে গর্বাচভকে দিয়ে হোক বা ইয়েলতসিন। শেষে ইয়েলতসিন এলেন, কিন্তু পরিবর্তন এল না রাশিয়ার মনোজগতে। তার জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার কমানো, এবং ‘বিশ্বশক্তি’ মনোভাবটা কমানো।
তার পরিণতি এখন প্রকট। সোভিয়েট আমলই যে ছিল রাশিয়ার ‘স্বর্ণযুগ’ এই মনোভাবের বর্তমান সমর্থক প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। স্বৈরতন্ত্র ও জঙ্গিবাদ যে কমিউনিজমের অঙ্গাঙ্গি, তাই তো চিনের বর্তমান নেতা শি চিনফিং-এর মতাদর্শ।
বুশ যদি হাততালি অর্জন করতে এত তড়িঘড়ি না করতেন, তবে হয়তো আর কিছু দিন ক্ষমতায় থাকতেন গর্বাচভ। হয়তো গর্বাচভই রাশিয়া থেকে শুরু করতে সক্ষম হতেন এক বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া। হয়তো তা হত আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপকে সঙ্গে নিয়েই। এবং চিনকেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy