আততায়ীর বুলেট তাঁকে ও তাঁর লেখনীকে স্তব্ধ করে দেওয়ায় হয়তো আরও বড় এক যন্ত্রণার হাত থেকে বেঁচেছেন শুজাত বুখারি (ছবিতে)। নয়তো, ২০১৯-এর ৫ অগস্ট থেকে তাঁকে কাটাতে হত অজস্র বিনিদ্র রজনী। ওই দিন থেকেই তো কাশ্মীর হারিয়েছে পৃথক রাজ্যের গরিমা। হারিয়েছে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার অধিকারও। কাশ্মীরের ভূমিপুত্র, জাতীয় স্তরের প্রথিতযশা সাংবাদিক শুজাত বুখারির মৃত্যু হয়েছে তার আগের বছর। ২০১৮-র ১৪ জুন।
যে সংবাদপত্রের তিনি প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন, সেই রাইজ়িং কাশ্মীর-এর দফতর থেকে বেরোনোর পরেই মোটরবাইক চেপে আসা আততায়ীদের বুলেট তাঁকে স্তব্ধ করে দেয়, দেহরক্ষীরা থাকা সত্ত্বেও। অথচ, যেখানে বুখারির দফতর, শ্রীনগর শহরের প্রাণকেন্দ্র সেই লালচক অত্যন্ত সুরক্ষিত জায়গা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংবাদমাধ্যমের দফতর সেখানে। সুরক্ষা বলয় তছনছ করে শুজাতের মতো মানুষকে গুলিতে নিকেশ করে দেওয়ার পরিকল্পনা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় কষা, তাতে সন্দেহ নেই।
শুজাতকে এ ভাবে মারতে হল কেন? তিনি ছিলেন সেই বিরল প্রজাতির সাংবাদিক, যিনি সরকার ও সন্ত্রাসবাদী, দু’পক্ষেরই চোখে চোখ রেখে বলতে পারতেন, সংযত হও। যেটা করছ, ঠিক করছ না! ভারতের মতো দেশের ‘মূল ভূখণ্ডে’ যেখানে সাদাকে ‘সাদা’ এবং কালোকে ‘কালো’ বলা অসম্ভব হয়ে উঠছে, সেখানে অশান্ত উপত্যকায় বসে সর্ব ক্ষণ পুলিশ-প্রশাসন-জঙ্গি সংগঠনের নানাবিধ চোখরাঙানি ও হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার ধর্ম পালন করা ঠিক কতটা কঠিন কাজ, সেই উপত্যকায় সাংবাদিকতা না করলে তা কল্পনা করাও বোধ হয় অসম্ভব।
অথচ, সেই রক্তস্নাত উপত্যকায় দাঁড়িয়ে শুজাত বুখারি শোনাতেন স্বপ্নের কথা, কাশ্মীরে শান্তি ফেরানোর কথা। কাশ্মীর সমস্যাকে নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে কখনও দেখেননি তিনি। বার বার বলেছেন, কাশ্মীর ও কাশ্মীরিয়তকে ভিন্ন চোখে দেখতে হবে। প্রতিহিংসা বা দমনপীড়নের পথে নয়, এর সমাধানসূত্র খুঁজতে হবে রাজনৈতিক আলোচনায়। কূটনীতির ভাষায় যাকে ‘ট্র্যাক টু’ বলে, সেই পন্থায় বিশ্বাস করতেন শুজাত। বহু বার এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে শামিল করেছেন তিনি।
যে দিন বুখারি আততায়ীদের নিশানা হলেন, সেটি ছিল রমজান মাস শেষ হওয়ার আগের দিন। এই গোটা মাস জুড়ে যুদ্ধবিরতি চলছিল। কাশ্মীরের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষবিরতির মাস। শুজাত বুখারি ছিলেন প্রবল ভাবে এই যুদ্ধবিরতির পক্ষে। পরিহাস বইকি! যিনি তাঁর সাংবাদিক-জীবনের পুরোটাই অশান্ত কাশ্মীরে শান্তিপ্রয়াসে ব্রতী ছিলেন— শুধু লেখনী দিয়েই নয়, প্রত্যক্ষ যোগদানের মাধ্যমেও— তাঁকে বলি হতে হল হিংসার!
তাঁদের পরিবারে শুজাতই প্রথম হিংসার বলি নন। ১৯৯১ সালে পুলিশ ও জঙ্গিদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের মধ্যে পড়ে প্রাণ গিয়েছিল তাঁর এক তুতো ভাইয়ের। ফলে কাশ্মীরের অসংখ্য কোল-শূন্য পরিবারের মতো শুজাতের পরিবারও জানে, অশান্ত উপত্যকায় থাকার জন্য কী বিপুল মূল্য চুকোতে হয় এখানকার ভূমিপুত্রদের!
শুজাত বুখারির মতো সাংবাদিকের কথা আজ বেশি করে মনে পড়ে কেন? কারণ, তিনি ছিলেন এমন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদী, যিনি কাশ্মীরের পাশাপাশি তাঁর প্রশস্ত মন নিয়ে কুণ্ঠাহীন ভাবে দিল্লির কথাও শুনতেন। মনে করতেন, কাশ্মীরের মানুষকে ভাল থাকতে হলে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তানেরও সদর্থক ভূমিকা চাই। শান্তি আলোচনায় শামিল করতে হবে পাকিস্তানকেও। শুজাত লিখেছিলেন, এটা অস্বীকার করার মতো কোনও তথ্যই নয় যে, ভারতে অশান্তি সৃষ্টির পিছনে পাকিস্তানের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু, এরই পাশাপাশি শুজাত জানাতে ভোলেননি যে, সংখ্যালঘুদের ভাবাবেগ বোঝার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লিরও নিজস্ব ঘাটতি রয়েছে। ফলে ‘অন্দরের সন্ত্রাস’ বেড়েছে, যাতে ইন্ধন দিয়েছে সন্ত্রাসবাদীরাও। একই সঙ্গে ‘গৈরিক সন্ত্রাস’-ও এ দেশে এক বাস্তব ঘটনা।
২০১৭-য় শুজাত লিখেছিলেন, পবিত্র রমজান মাসের সঙ্গে কাশ্মীরের রক্তাক্ত হওয়ার ঘটনাচক্রে একটা সম্পর্ক রয়েছে। এই সময়ে নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষত জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের দিকে উগ্রপন্থীরা তাদের অস্ত্র তাক করে। নিরাপত্তা বাহিনীও তাদের অভিযান জোরদার করে। ফলে, ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ হিসেবে বহু অসামরিক ব্যক্তির প্রাণ যায়। এই উত্তেজনা ক্রমেই দৃশ্যমান হয় এবং ইদ উৎসবের উপরে তার একটা প্রভাব পড়ে।
ঠিক তার পরের বছরের জুনে মৃত্যু হয় বুখারির। তবে, এই মৃত্যু কিছুতেই ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ নয়। এই অকুতোভয় সাংবাদিককে যাঁরা কিঞ্চিৎও চেনেন, তাঁরা নিশ্চিত ভাবেই বলবেন, বেঁচে থাকলে কাশ্মীরকে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’-এ পরিণত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে কয়েদবাসই শ্রেয় মনে করতেন শুজাত বুখারি। রাজ-অনুগ্রহে তাঁর বিন্দুমাত্র আসক্তি থাকত না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy