ধাক্কা: আর জি কর ঘটনার ‘বিচার চাই’ ধ্বনিতে উত্তাল জনতা, নদিয়া, ২১ অগস্ট। ছবি: পিটিআই।
তিন দিকের তিনটি রাস্তা জুড়েই অবরোধ, ন যযৌ, ন তস্থৌ অবস্থা, সারি সারি গাড়ি, বাস, অটোর। কিন্তু ভিতরে যাঁরা আটকে আছেন তাঁদের কারও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। এমনকি এক-দু’জন অসহিষ্ণু হয়ে উঠলে সহযাত্রীদের থেকে শুনছেন, “এটা কেবল অবরোধ নয়, এটা প্রোটেস্ট”। এই ছবি কল্যাণী, ব্যারাকপুর, কৃষ্ণনগর কিংবা পশ্চিমবঙ্গের যে-কোনও জায়গার।
ঠিক এ রকম অভিজ্ঞতা বহু দিন হয়নি আমাদের। দান্তের ‘ইনফার্নো’ বিষয়ে কোনও লেখায় পড়েছিলাম যে, ‘নারকীয় পরিস্থিতি’ বলে আমরা যা-ই বোঝাতে চাই না কেন, নরকে বাস করার সময় মানুষ একে-অপরের দুঃখ, যন্ত্রণা নিয়ে অনেক বেশি ভাবিত থাকে; স্বর্গ বরং আমাদের আরামপ্রিয়, বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
সেই আত্মসুখী বিচ্ছিন্নতা থেকে ধাক্কা দিয়ে আমাদের বার করে আনল একটি মেয়ে। সোদপুর বা ডানলপের হতদরিদ্র মানুষেরা যখন যৎসামান্য ফি নিয়ে বা কিছু না নিয়েও তাঁর নিরন্তর সেবার কথা বলেন তখন চোখের জল ধরে রাখা কঠিন হয়। যখন তাঁর সংগ্রামী মা-বাবার মুখে শুনি, গত দু’বছর ধরে নিজের বাড়িতে দুর্গাপূজার আয়োজন করছিলেন তিনি, তখন মনে না হয়ে পারে না যে, এই বছর আমাদের সকলের কালাশৌচ।
আসলে এখন আমাদের প্রত্যেকের কান্নায় লেগে আছে সেই নিহত চিকিৎসকের চোখের রক্ত। এই দূষিত বায়ুর শহরে, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করতেন যিনি, তাঁকেই পৈশাচিক অত্যাচার শেষে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলা হল! আর তার পরই কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার উত্তাল হয়ে উঠল প্রতিবাদে। সংলাপ রূপ নিল গর্জনের। সেই গর্জন নগ্ন হিংসার লাগাম টেনে ধরতে চাইল, নিজের সর্বশক্তি দিয়ে। আর তার শক্তি কোনও চেয়ার কিংবা চেম্বার থেকে উৎসারিত নয় বলে, তা উদ্ভিদের মতো জন্ম নিল, রোদের মতো ছড়িয়ে পড়ল। চার্লস ডিকেন্স কেন একই সময়কে, ‘ওয়র্স্ট অব টাইমস’ আর ‘বেস্ট অব টাইমস’ বলেছিলেন তাঁর উপন্যাসে, আমরা যেন তা উপলব্ধি করতে পারলাম আবার। কেবল ১৪ অগস্ট রাত্রি থেকে ১৫ অগস্টের ভোর পর্যন্ত নয়, তার পরও একদিন-প্রতিদিন, বিচারের দাবি ঘনান্ধকারের বুক চিরে ঝলসে উঠল আকাশে। একটি নৃশংস হত্যা প্রাণসঞ্চার করে গেল মনোলগ ভেঙে ফেলা যাবতীয় কোরাসে।
কিন্তু প্রাণকে তো চোখে দেখা যায় না। বেদনারই বা এত ছবি লাগবে কেন? কেন, এক জন পৃথিবীতে না-থাকা মানুষের মুখ কিংবা রক্তাক্ত শরীরের ছবি ক্রমাগত আছড়ে পড়বে মোবাইলে? অন ফোটোগ্রাফি বইতে সুসান সনটাগ লিখেছিলেন, ছবি কিংবা ছবিদের অভিঘাতে আমরা অনুভব করতে থাকি যে অনেক বড় একটা পৃথিবী আমাদের আওতায়, আসলে যখন অতটা আমাদের নাগালেই নেই। ছবির থেকে আরও অনেক শক্তিশালী চলমান ছবি। তা দেখতে দেখতে আমরা দৃশ্যমান কয়েকটি মুখকে মূল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার দিকে এগোই। ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োর সূত্রে জানতে চাই, কেন ‘ক্রাইম সিন’-এ উপস্থিত ছিল বর্ধমান, মালদহে কর্মরত কেউ-কেউ বা কলকাতার অন্য হাসপাতাল থেকে আসা কোনও ব্যক্তি? ভুলে যাই যে, ছবিতে যাদের দেখা যাচ্ছে তারা ছবির ভাষ্য পাল্টে দিতেও সক্ষম।
লালবাজারে ডাক পাওয়া চিকিৎসক সংগঠনের নেতা যখন ক্যামেরার সামনে বলেন যে রাসায়নিক ব্যবহার করে প্রমাণ লোপাট করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ওখানে কোনও বিশেষজ্ঞ গিয়ে থাকতে পারেন, তখন শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। ভয় লাগে, ভেঙে ফেলা পার্শ্ববর্তী স্থান, অপরাধীদের চিহ্ন লোপ করে দিয়ে যায়নি তো? আরও অবাক লাগে ভেবে, ওই অতগুলো লোক দাঁড়িয়ে এক মানবীর নিথর দেহের সামনে, তাদের মধ্যে কেউ বলল না যে ব্যাপারটা অন্যায় হচ্ছে?
ঘটনার শেষ তো এখানেই নয়। আর জি করে কর্মরত চিকিৎসক তাপস প্রামাণিক ‘অন ক্যামেরা’ বলেছেন যে, তিনি হাসপাতালে চলা জুলুমবাজি বা পয়সা না দিলে ফেল করিয়ে দেওয়ার দুঃসহ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সদ্য-প্রাক্তন অধ্যক্ষের গ্যাং তাঁকে খুনের হুমকি দিয়েছে। শুনতে শুনতে মনে হয় ওই লোকটাকে বাড়িতে রেখে পলিগ্রাফ টেস্ট ( যেখানে ওষুধ খেয়ে ফল পাল্টে দেওয়া যায়) করার অনুমতি দিল কেন সিবিআই?
আর এখানকার তদন্তকারীরা? মাঝরাতে যে গুন্ডারা হাসপাতালে ঢুকে তাণ্ডব চালাল, কোটি-কোটি টাকার চিকিৎসার সরঞ্জাম ভাঙচুর করল, তাদের পিছনে কোন মাথারা ছিল, আজও তা উঠে এল না। নিহত চিকিৎসকের মা-বাবা যখন বলছেন যে পুলিশ মিথ্যে বলছে, সে দিন তাঁদের মেয়ের নিথর শরীরের চার পাশে অনেক লোকের ভিড় ছিল, তখন কেবল ক্রোধ নয়, অসহায়তাও জন্মাচ্ছে। কার কাছে আমরা যাব তবে, ‘আমাদের বাঁচান’ এই আর্জি নিয়ে? মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যাদের প্রশ্ন করছে, ‘কেন ময়নাতদন্তের আগে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু হয়নি’, তাদের কাছে?
এখানেই রাজনীতির প্রসঙ্গ আসে। খুন হওয়া চিকিৎসকের মরদেহ সমেত গাড়িটি হাসপাতাল চত্বর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই গাড়ি আটকাতে চাওয়া যুবনেত্রী বা তার পিছনেই দাঁড়ানো এক যুবনেতা দুটো ভিন্ন রাজনৈতিক দলের। কিন্তু তাতে কী? সে তো কেবল ছবির হাতে ফিল্টার্ড বাস্তবতা। মাটিতে দাঁড়িয়ে, দুটো দল, চারটে দল, বিরোধী দল, শাসক দলেরও অজস্র সমর্থক এই নারীঘাতী বীভৎসায়, যারপরনাই আহত, ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ। সমর্থক মানেই সুবিধাভোগী নয়। আর সুবিধাভোগী নয়, এমন কারও ক্ষোভকে অগ্রাহ্য করা, ‘ছবির ফাঁদ’-এ পড়ে গিয়ে, প্রতিবাদকে দুর্বল করা। ধোঁয়া যখন আকাশ ঢাকে তখন সেটা কোন উনুনের, তা গৌণ। ফলে, ডার্বি বাতিল হলেও সবুজ-মেরুনের কাঁধে চড়ে স্লোগান দিতে পারে লাল-হলুদ। তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিতে পারে, সাদা-কালো।
শেষ কবে বিশুদ্ধ আবেগ আমাদের দৈনন্দিনকে চালিত করেছে? আজ যে তা পারছে তার কারণ আমরা বুঝতে পারছি যে এই চিকিৎসকের ভিতরে এক জন হুইসলব্লোয়ারও ছিল। সেই কারণেই সম্ভবত নারকীয়তা নেমে এসেছিল তাঁর উপর। কারা-কারা জড়িত ছিল, তাঁর গাড়িতে ধাক্কা মারা হয়েছিল কার নির্দেশে, খুন-ধর্ষণ হয়েছিল কোথায়, খুনের পরে ধর্ষণ না কি আগে, প্রশ্নগুলো জ্বলন্ত।
মিডিয়ার একাংশে রব উঠেছে, ডাক্তারদের আন্দোলনের ফলে প্রাইভেট হাসপাতালের মুনাফা বাড়ছে। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তাররা তো প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করেন না। তা ছাড়া, রোগীদের অসুবিধে হচ্ছে এও যেমন সত্যি, সত্যি এটাও যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছেন অজস্র সরকারি চিকিৎসক। কর্মবিরতি প্রত্যাহারে চাপ দেওয়ার আগে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ডাক্তারই যদি না বাঁচে, রোগী বাঁচাবে কে?
শেষে একটা কথা। মেয়েটির বাবা-মা যদি তথাকথিত ক্ষতিপূরণ নেন, তাতেও তাঁরা মেয়ের জীবনের ‘বিনিময়’-এ কিছু নিচ্ছেন না, যেমন কামদুনির নিহত মেয়েটির ভাইও বোনের জীবনের ‘বিনিময়’-এ চাকরি পাননি। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের অধিকার আজ জীবনের অধিকারের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত, বলা যায়। তাই এ নিয়ে চর্চা বন্ধ করে, ‘অন ডিউটি’ কেউ খুন হলে দায় কার, সেই প্রসঙ্গে আসতে হবে।
প্রতিটা পাড়াই যখন রক্তকরবী, নন্দিনী তখন হারাবে কী ভাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy