সমাজ-সংস্কৃতিতে শিল্পী আসেন, শিল্পী যান। কিন্তু সবাই যুগসৃষ্টি করে যান, এমন নয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সেই উন্নত মার্গের শিল্পী, যিনি তাঁর কণ্ঠলাবণ্যে যুগ তৈরি করে গিয়েছেন। তাঁর প্রয়াণ যুগাবসানই। গানের স্বর্ণযুগ বলে কোনও কষ্টকল্পিত সিদ্ধান্ত নিষ্প্রয়োজন। তবে, অবশ্যমান্য এটাই যে, ইতিহাস তৈরি হয়ে ওঠে সুনির্দিষ্ট উপাদানের সাপেক্ষেই। সে উপাদান ছিল বলেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কালজয়ী।
কলকাতার ঢাকুরিয়ায় জন্ম, ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর। মা হেমপ্রভা মুখোপাধ্যায়, বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ছয় ভাইবোনের মধ্যে এক বোন ও এক ভাইয়ের অল্প বয়সে মৃত্যু। ছোট থেকেই পরিবারের নজরে আসে, সন্ধ্যার গানের প্রতি বিশেষ টান রয়েছে। সুর কানে এলেই দাঁড়িয়ে পড়ত ছোট মেয়েটি। মা-বাবার কাছে গানের হাতেখড়ি। দাদা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় খেয়াল করেন সঙ্গীতের প্রতি বোনের আকর্ষণ। স্বরক্ষেপণের ক্ষমতায় আন্দাজ পেয়েছিলেন, ছোট বোনের কণ্ঠে বিশেষ কিছু আছে। দাদার হাত ধরেই সন্ধ্যা পৌঁছেছিলেন তাঁর প্রথম সঙ্গীতাচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। মার্গসঙ্গীতের তালিমের সূত্রে অল্প দিনের মধ্যেই বেঙ্গল মিউজ়িক কনফারেন্স, অল ইন্ডিয়া মিউজ়িক কনফারেন্সে গুণিজনদের নজরে আসা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ১৯৪৫ সালে, বাংলা বেসিক গানের প্রথম রেকর্ড। কলম্বিয়া কোম্পানির সেই রেকর্ডে ছিল গিরীন চক্রবর্তীর কথায়-সুরে দু’টি গান— ‘তোমার আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো’ এবং ‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’। ১৯৪৮ সালে ছায়াছবিতে গাওয়ার ডাক। ছবি অঞ্জনগড়, সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল; এবং ছবি সমাপিকা, সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়। গানের ভেলায় লাগল জোয়ার। ১৯৪৮ সালেই প্রকাশ পেল তিনটি বেসিক রেকর্ডও। বাকিটা ইতিহাস।
কিন্তু সেই ইতিহাসেরও তৈরি হয়ে ওঠা ছিল। প্রস্তুতি রীতিমতো কঠিন-কঠোর। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন সন্ধ্যা। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সন্তোষকুমার বসু, এ টি কানন, চিন্ময় লাহিড়ী প্রমুখের কাছে। ১৯৪৬ সালে প্রথম হলেন ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষায়। প্রথম স্থান ভজনেও। পরীক্ষক কারা? উস্তাদ আলাউদ্দিন খান, উস্তাদ মহম্মদ দবির খান, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এর পর এল সেই সুবর্ণ সন্ধিসময়। দাদা তাঁকে নিয়ে গেলেন পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে। বাসনা, তিনি যদি বোনকে সুযোগ করে দেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের কাছে প্রশিক্ষণের। জ্ঞানপ্রকাশের বাড়িতেই সেই সুযোগ ঘটে সন্ধ্যার। তার পরই শুরু উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পীর কাছে প্রশিক্ষণ। উস্তাদজির মৃত্যুর পরও গানের পাঠ অব্যাহত রেখেছেন তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছে।
১৯৪৮ সালেই সন্ধ্যা জানতে পারলেন, শচীন দেব বর্মণ তাঁকে ‘বম্বে’ নিয়ে যেতে আগ্রহী। সে-খবর সন্ধ্যার কাছে বয়ে এনেছেন যিনি, তিনিও শচীন— শচীন গঙ্গোপাধ্যায়, পারিবারিক সুহৃদ। তাঁর পরামর্শে সন্ধ্যা মীরা দেব বর্মণের কলকাতার বাড়িতে গিয়ে গান শুনিয়ে এলেও মনস্থির করে উঠতে পারলেন না মুম্বই যাওয়া নিয়ে।
অবশেষে ১৯৫০ সালে চলে গেলেন মুম্বই। থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন শচীন দেব বর্মণই। হিন্দি ছবিতে প্রথম প্লে-ব্যাকের সুযোগ এল অনিল বিশ্বাসের হাত ধরে। তাঁর সুরে তারানা ছবির জন্য গাইলেন সন্ধ্যা। এই ছবিতেই তাঁর সঙ্গে গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। মুম্বই-ইন্ডাস্ট্রি অনুভব করল, নতুন জাদুকরের আবির্ভাব ঘটেছে। শচীন দেব বর্মণের সুরে তো গাইলেনই, গাইলেন আরও এমন অনেক গান, যা মুখে মুখে ফিরতে লাগল। কিন্তু সন্ধ্যা ১৯৫২ সালে কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর মধ্যে গাওয়া হয়ে গিয়েছে ১৭টি হিন্দি ছবিতে।
কলকাতায় ফেরার পরও সন্ধ্যা মুম্বইয়ের কাজ করেছেন। তবে মূলত আঁকড়ে ধরলেন বাংলা গানকেই। ১৯৬৬ সালে কবি শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন তিনি। দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে নানা ধরনের গান গেয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র-সমসাময়িকদের কাব্যগীতি রেকর্ড করেছেন যেমন, তেমনই ভজনে অন্য মাত্রা এনেছেন। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের শ্রোতারা আলাদা আলাদা কনসার্টে তাঁর গলায় শুনেছেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এবং আধুনিক বাংলা গান। তবে, শ্রোতাদের মনে তাঁর চিরকালীন আসন পাতা বাংলা বেসিক রেকর্ড এবং চলচ্চিত্রের জন্য তাঁর অবিস্মরণীয় সব গানের জমিতেই। মুম্বই-কলকাতা মিলিয়ে বহু সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন শচীন দেব বর্মণ, অনিল বাগচী, মদন মোহন, সলিল চৌধুরী, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
তবে, ইতিহাস তৈরি হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর জুটিতে। উত্তম-সুচিত্রা এবং হেমন্ত-সন্ধ্যা জুটি পরস্পর পরিপূরক হয়ে উঠল। বাঙালি সন্ধ্যামগ্ন হয়ে পড়ল। তবে, সুচিত্রা সেনের উচ্চারণশৈলী তাঁর নিজের গানে আনতে গিয়ে কিছুটা ‘ম্যানারিজ়ম’ও জন্ম নিয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই প্রবণতা কাব্যগীতির গায়নে প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা অবতীর্ণ হলেন অন্য ভূমিকায়। শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গানকেই মাধ্যম করে তুললেন তিনি। সমর দাস এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়দের প্রয়াসে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’। জীবনে বহু সম্মান পেয়েছেন। জয়জয়ন্তী এবং নিশিপদ্ম ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার। পেয়েছেন ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান। জীবনের একেবারে শেষ-পর্বে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মাননার প্রস্তাবে অপমানিতই বোধ করেন শিল্পী এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন। সেই অপমানের বোধ ব্যক্তিগত স্তর ছাড়িয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকেও আহত করল।
পরিপূর্ণ বয়সেই মৃত্যু হল তাঁর। তবুও, অপার শূন্যতা তৈরি করে দিয়ে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy