Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
উদারবাদের অনিবার্য ফল
Russia Ukraine War

ন্যায় বা নীতির মানদণ্ডে বর্তমান সঙ্কটের ব্যাখ্যা অর্থহীন

আমেরিকার দুর্বলতার সব থেকে বড় প্রমাণ নিঃসন্দেহে আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন।

দ্বন্দ্ব: গত মাসে ব্রাসেলসে নেটো-নেতাদের ভার্চুয়াল সম্মেলনের বাইরে বিক্ষোভ।

দ্বন্দ্ব: গত মাসে ব্রাসেলসে নেটো-নেতাদের ভার্চুয়াল সম্মেলনের বাইরে বিক্ষোভ। পিটিআই

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২২ ০৬:৪৫
Share: Save:

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ ঘোষণা ইউরোপ তথা বিশ্ব-রাজনীতিতে যে গভীর সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে, তা নজিরবিহীন না হলেও ভবিষ্যতের জন্য অশনি-সঙ্কেতবাহী। কেন এই যুদ্ধ? কী ভাবে আমরা রাশিয়া ও অন্য শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারি? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা জাতীয় যুক্তি দিয়ে এই ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। অন্য সমাজবিজ্ঞানের মতো আন্তর্জাতিক সম্পর্কেরও নিজের তত্ত্ব আছে, বিষয়গত পরিভাষা আছে। যুদ্ধের আলোচনায় সেই ধারাগুলির ব্যবহার প্রয়োজন।

উদারনীতিবাদের নানা ধারা ও জটিলতার মধ্যে হারিয়ে না গিয়েও কিন্তু মূল বৈশিষ্ট্যগুলি সহজেই চেনা যায়। প্রথমত, বিদেশনীতি পরিচালিত হয় দেশের অভ্যন্তরীণ চাপ-গোষ্ঠীর দরকষাকষির ভিত্তিতে। এলিট কোনও অভেদ শ্রেণি নয়। যারা ক্ষমতাশীল, তাদের স্বার্থে নীতি পরিচালিত হয়। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য ও ব্যবসার প্রসারের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক নিবিড় হয়, সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি পায়। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা একটা নিয়মনিষ্ঠ পরিসর, জঙ্গলের রাজত্ব নয়। চতুর্থত, গণতন্ত্র শান্তির পথ নির্মাণ করে— স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অপসারণ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা শুধু যে সেই দেশের মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটায় তা-ই নয়, গণতান্ত্রিক দেশগুলি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেও ইচ্ছুক। পঞ্চমত, অর্থনীতি বা সামরিক ক্ষেত্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিকে প্রভাবিত করে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এই প্রতিষ্ঠান-নির্ভর চিন্তার আর এক অভিমুখ আন্তর্জাতিক আইনের সর্বজনীন প্রসার ও অঙ্গীকার। আসল কথা, উদারনীতিবাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সামাজিক জীবনের সম্প্রসারণ রূপে গণ্য করে। সমাজ সদা পরিবর্তনশীল, বিশ্ব-রাজনীতির চরিত্রও বদলাতে বাধ্য। শক্তিধর দেশ নানা ধরনের বিদেশনীতি চালিয়ে থাকে, নিরাপত্তার একমাত্রিক অর্থ এখানে খাটে না।

১৯৯০ থেকে ইতিহাসের প্রবাহ অনুধাবন করলে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে, কী ভাবে এই উদারনৈতিক প্রকল্প ক্রমশ রাশিয়া ও পশ্চিমি দুনিয়ার মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান তৈরি করেছে। আমেরিকা ও ইউরোপের সন্ধিবদ্ধ ‘নেটো’ দেশগুলি সামরিক প্রতিষ্ঠানটির পূর্ব ইউরোপে বিস্তারে যত আগ্রহী হয়েছে, রাশিয়ার নিরাপত্তাহীনতা তত বেড়েছে। উদারনৈতিক কল্পনার পূর্বাভাসের বিপরীতে, রাশিয়ায় পূর্ণ মাত্রার গণতন্ত্রীকরণের বদলে স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণে। তা ছাড়া, উদারনৈতিক চিন্তায় গণতন্ত্রের উন্নতিতে যে ধরনের এলিট-প্রচলন দরকার, তা রাশিয়ায় কোনও কালেই ছিল না। সে দেশে কোনও দিনই প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি; বরং ইয়েলৎসিনের পর পুতিন ক্ষমতায় এলে তা আরও ঘনীভূত ও কেন্দ্রীভূত হয়। স্বভাবতই, রাশিয়াতে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটেনি। যত দিন গিয়েছে, পশ্চিম ইউরোপ ও রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবধান আরও বেড়েছে, এবং তা অনিবার্য ভাবেই তীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেহারা নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির উত্থানে উদারনীতিবাদের সামগ্রিক প্রাসঙ্গিকতাও কমেছে। উদারনৈতিক পথে রাশিয়াকে বোঝা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তাই, নৈতিকতা বা ন্যায়পরায়ণতার মানদণ্ডে এই সঙ্কটের ব্যাখ্যা অর্থহীন।

ন্যায়পরায়ণ পৃথিবী নির্মাণের পরিকল্পনা আদর্শগত দিক থেকে যতই কাম্য হোক, ভূ-রাজনীতির নিয়মে তা অবান্তর। জাতিরাষ্ট্র-নির্ভর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় স্থানিক সার্বভৌমত্বের ধারণাটিই প্রধান নিয়ন্ত্রক। তাই বাস্তববাদী যুক্তিতে বিচার করলে, উদারনৈতিক চিন্তারই অনিবার্য পরিণাম এই যুদ্ধ। বাস্তববাদীরা বলেন, যে কোনও রাষ্ট্রের প্রথম উদ্দেশ্য নিজেকে টিকিয়ে রাখা, এবং নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য যে পরিমাণ শক্তি দরকার তা সুনিশ্চিত করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, নেটোর প্রসারকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাশিয়াকে প্ররোচিত করে পশ্চিমি দুনিয়াই এই সঙ্কটের বাতাবরণ তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত, শক্তিধর রাষ্ট্র পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ণয় করে। দ্বিমেরু বা একমেরু পৃথিবীতে ক্ষমতার ভারসাম্য নির্মাণ তুলনায় সরল, কিন্তু বহুমেরু ক্ষমতাব্যবস্থায় ভারসাম্যের অঙ্ক অত্যন্ত জটিল ও অনিশ্চিত। অর্থাৎ, যুদ্ধের জন্য বিকৃত মানসিকতার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধা ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা থেকেই তা তৈরি হতে পারে।

২০০৮ সালের পর পৃথিবীর ক্ষমতাবিন্যাস পাল্টেছে। নিরঙ্কুশ আমেরিকান আধিপত্যের দিন শেষ। চিন ও রাশিয়ার উত্থান ক্ষমতার সমীকরণগুলো অনেকটা বদলে দিয়েছে। তা ছাড়া, পুতিনের আগ্রাসনের পিছনে গণসমর্থনের কোনও জোরালো ভিত্তি নেই। পিটার রুটল্যান্ড তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, তার কোনও প্রয়োজনও পুতিন অনুভব করেন না। পুতিন আত্মবিশ্বাসী যে, পশ্চিম থেকে বৃহত্তর সুবিধা আদায় করার মতো সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি তাঁর আছে। ২০০৮-এ জর্জিয়া আক্রমণ, ও ২০১৪-য় ক্রাইমিয়া অধিগ্রহণের সময়ে কোনও কার্যকর পশ্চিমি প্রতিরোধ চোখে পড়েনি। ক্রাইমিয়া দখল-পরবর্তী নিষেধাজ্ঞাগুলির পরিধি ছিল সীমিত, এবং তা রাশিয়ার অর্থনীতিকে সে ভাবে দুর্বলও করতে পারেনি। বরং, এর ফলে পুতিন রাশিয়ার শাসকবর্গকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হন।

তা ছাড়া, বিশ্ব-রাজনীতির নিরিখে আমেরিকান ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এখন প্রকট। এতে রাশিয়া ও চিনের গুরুত্ব বেড়েছে। সিরিয়াতে আমেরিকা পথভ্রষ্ট হলে, ২০১৫-য় সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় রাশিয়া। ইসলামিক স্টেট দমনের যুদ্ধে রাশিয়া যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ট্রাম্পের শাসনে আমেরিকা নেটোর ঐতিহ্যগত সমর্থন থেকে কিছুটা সরে আসে।

আমেরিকার দুর্বলতার সব থেকে বড় প্রমাণ নিঃসন্দেহে আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার শর্ত অনুযায়ী, এর ফলে প্রতিযোগী দেশগুলো আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্গত বহু দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা, ব্রেক্সিট ও শরণার্থী সঙ্কট পশ্চিমি দুনিয়াকে দুর্বল করেছে। এক দিকে, রাশিয়ার বিপুল জ্বালানি গ্যাস ও সম্পদের প্রাচুর্য, অন্য দিকে পশ্চিম ইউরোপের শক্তি-নিরাপত্তার স্বার্থে রাশিয়ার প্রতি নির্ভরশীলতা মস্কোকে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে অনেক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। আজকের নিষেধাজ্ঞা অনেক ব্যাপ্ত হলেও তার ফল হবে দীর্ঘমেয়াদি। তাই অর্থনৈতিক বয়কট রাশিয়াকে দ্রুত দুর্বল করবে, এমন আশঙ্কা অমূলক। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গৃহীত পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞা কতটা সফল হবে, তা বহুলাংশে নির্ভর করছে চিনের ভূমিকার উপর। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক পণ্ডিতদের মতে, বাস্তববাদের নিদানে এই যুদ্ধ ঠেকানো যেত। রাশিয়াকে কোণঠাসা করে আখেরে নেটো-অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর স্বল্পমেয়াদি কোনও লাভই হয়নি। তারা ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি, আমেরিকার অঙ্গীকারমূল্য তলানিতে ঠেকেছে, আর কিছু সাময়িক বোঝাপড়া করে এই সঙ্কটের নিরসনও হবে না। নেটোর প্রসার ও রাশিয়ার নিরাপত্তা এক সঙ্গে বাড়তে পারে না। এই মৌলিক ও প্রাথমিক শর্ত যদি যুযুধান পক্ষ না মানে, এই সঙ্কটের অবসান অসম্ভব।

সোভিয়েট প্রজাতন্ত্রে বহু জাতীয়তার প্রকল্প পার্টি শাসনের কঠোর নিয়ন্ত্রণে সুপ্ত ছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে জাতীয় সত্তা নির্মাণের প্রশ্নে বহু ক্ষেত্রে বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যার সর্বজনীন-স্বীকৃত ভিত্তি রুশ ও অন্য জনজাতির মানুষের বহুমাত্রিক সম্পর্কে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাষা ও ধৰ্মকে কেন্দ্র করে বিরোধ সৃষ্ট হয়েছে। মহাশক্তিধর ও সুবিশাল রাশিয়া বহু ক্ষেত্রে এই বিরোধ নিরসনে সামরিক ভূমিকায় অবতীর্ণ। মস্কোর উদ্দেশ্য পুরনো সোভিয়েট ইউনিয়নের গরিমা কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করা।

এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে রাশিয়া সামরিক দিক থেকে প্রবল শক্তিধর রাষ্ট্র, তাকে পর্যুদস্ত করাও সম্ভব নয়। যেখানে আইনের শাসন প্রবর্তনের পিছনে বৈধ শক্তির অঙ্গীকার নেই, সেখানে নৈতিকতা ও সর্বজনীন মানবতাবাদের ধারণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় হিংসাকে প্রতিহত করা কঠিন। যুদ্ধের নৈতিকতার আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে যে সহিংসতা লুকিয়ে আছে, তার আলোচনাও তাই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Russia Ukraine War
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy