যুদ্ধ: ইউক্রেনের সীমান্তে প্রবেশ করল রুশ সাঁজোয়া গাড়ি। ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। রয়টার্স
অবশেষে রুশ সৈন্যরা পূর্ব ইউক্রেনের দু’টি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে যে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল, এখন সেই ধোঁয়ার সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা। গোটা পৃথিবী বুঝতে পারছে, আর একটা ভয়ানক যুদ্ধ সম্ভবত আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষামাত্র।
ইউক্রেনের পূর্ব এবং দক্ষিণ সীমান্তের কাছে রাশিয়া এক লক্ষেরও বেশি সৈন্য ও বিপুল অস্ত্রসম্ভার মজুত করেছে বলে খবর আসছিল গত দু’মাস ধরে। সাম্প্রতিক অতীতে রাশিয়ার সামরিক শক্তিমত্তার এত ব্যাপক প্রদর্শন দেখেনি বিশ্ব। ফলত বিশ্ব জুড়ে এই আশঙ্কা আগেই তৈরি হয়েছিল যে, ইউরোপ সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আশঙ্কা এখন সত্যি হওয়ার মুখে।
প্রশ্ন হল, কেন হঠাৎ ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে এত বড় সংঘাত, এই যুদ্ধ-পরিস্থিতি? সেটা বুঝতে গেলে গত নয় বছরের ঘটনাপ্রবাহের উপর চোখ রাখাটা জরুরি। ২০১৩-র নভেম্বর মাসে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সংযুক্তিকরণের একটি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন ইউক্রেনের রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। সেই সিদ্ধান্তের ফলে বিপুল বিক্ষোভ দেখা দেয় ইউক্রেন জুড়ে। এর দরুন ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারিত হন, এবং ২০১৪-র ফেব্রুয়ারি মাসে দেশ ছেড়ে পালান। এই ঘটনায় যারপরনাই রুষ্ট হয় মস্কো। তারই ফলে ২০১৪-র মার্চ মাসে, রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের অন্তর্গত দক্ষিণ ক্রাইমিয়ার উপদ্বীপকে দখল করে, একটি বিতর্কিত স্থানীয় গণভোটে ক্রাইমিয়ানরা রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগদানের পক্ষে রায় দেওয়ার পরে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য এর কারণ হিসাবে জানিয়েছিলেন ক্রাইমিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে রুশ নাগরিক এবং রুশ ভাষাভাষীদের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। এই সঙ্কটটি জাতিগত বিভাজন বাড়িয়ে তোলে বলে অনেকের ধারণা। তার কারণ, এর ঠিক মাস দুয়েক পর পূর্ব ইউক্রেনের ডনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একটি গণভোট আয়োজন করে।
পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী এবং ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে হিংসায় ২০১৪-র এপ্রিল থেকে এখনও পর্যন্ত আনুমানিক ১০,৩০০ জনেরও বেশি নিহত, এবং প্রায় ২৪,০০০ জন আহত হয়েছেন। যদিও মস্কো বরাবর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত জোগানোর অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে, ইউক্রেন এবং উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা নেটো মস্কোর দাবিকে কখনওই মানেনি। উল্টে তারা ডনেৎস্কের কাছে রুশ সৈন্য এবং সামরিক সরঞ্জাম মজুত করা এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের সীমান্তে গোলাগুলির কথা জানিয়ে এসেছে।
২০১৪ সালেরই জুলাই মাসের একটি মর্মান্তিক ঘটনা ইউক্রেনের পরিস্থিতিকে একটি আন্তর্জাতিক সঙ্কটে এবং আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়াকে যুযুধান দুই পক্ষে পরিণত করে। তারিখটা ছিল ১৭ জুলাই। ইউক্রেনে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ২৯৮ জন বিমানযাত্রী সমেত ভেঙে পড়ে। বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারীরা ২০১৫-য় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, বিমানটিকে একটি রুশ-নির্মিত ‘সারফেস টু এয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করা হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন যে, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি রাশিয়াই সরবরাহ করেছিল। দুর্ঘটনার আগে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি পূর্ব ইউক্রেনে স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং বিমানটি ভেঙে পড়ার পরে রাশিয়ার ভূখণ্ডে সেটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনায় রাশিয়া নেটোর চক্ষুশূল হয়ে ওঠে।
রাশিয়ার প্রতি নেটো বিরূপ হয়ে ওঠে আরও একটি কারণে। ২০১৪ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেন বেশ কয়েকটি সাইবার হামলার লক্ষ্য হয়ে ওঠে। যেমন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে একটি সাইবার হামলায় ইউক্রেন জুড়ে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ২০১৬-র ডিসেম্বরে একটি ইউক্রেনীয় পরিষেবা সংস্থাকে লক্ষ্য করে অনুরূপ হামলার পর ইউক্রেনের রাজধানী কিভের কিছু অংশে আর একটি বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছিল। অনেকের মতে, এই রকম সাইবার হামলার নেপথ্যে রাশিয়ার হাত থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
রাশিয়ার এই ধরনের কার্যকলাপের প্রতি রুষ্ট হয়েই সম্ভবত ২০১৬ সালের এপ্রিলে নেটো ঘোষণা করেছিল যে, তারা পূর্ব ইউরোপে চারটি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করবে (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ডে), যাতে ভবিষ্যতে ইউরোপের বাল্টিক অঞ্চলে সম্ভাব্য রুশ আগ্রাসন রোধ করা যায়। এই ব্যাটালিয়নগুলির সঙ্গে আমেরিকান সেনাবাহিনীর দু’টি ট্যাঙ্ক ব্রিগেডও পোল্যান্ডে মোতায়েন করেছিল ২০১৭ সালে, রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক জোটের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করার জন্য।
আমেরিকা যে ইউক্রেনের পক্ষে এবং রাশিয়ার বিপক্ষে, এই বার্তাটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০১৮ সালে। সে বছর জানুয়ারিতে আমেরিকা বেশ কয়েক জন রুশ কর্মকর্তা এবং ন’টি রুশ সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষে যুক্ত থাকার জন্য। সেই বছর মার্চে, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইউক্রেনের কাছে অ্যান্টি-ট্যাঙ্কের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেয়। তার কয়েক মাসের মধ্যেই, পশ্চিম ইউক্রেনে বৃহৎ আকারের বিমান অনুশীলনে ইউক্রেন আমেরিকা এবং নেটোভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে যোগ দেয়। উল্লেখ্য, এই ঘটনা ঘটেছিল ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার বার্ষিক সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায়, যার ফলে অনেকের মনে হয়েছিল, নেটো-ইউক্রেনের বিমান অনুশীলনের মাধ্যমে রাশিয়াকে সমঝে চলার বার্তাই দিতে চেয়েছিল নেটো।
আমেরিকা ও নেটোর সদস্য অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে এই রকম চাপের মুখে পড়েই পুতিন গত কয়েক বছর ধরে জানিয়ে আসছিলেন যে, তিনি ইউক্রেনের নেটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষাকে রাশিয়ার সীমান্ত নিরাপত্তায় বড় বিপদ হিসাবে গণ্য করছেন (এখনও পর্যন্ত ইউক্রেন নেটোর সদস্য নয়, তবে তারা দীর্ঘ কাল ধরে নেটোর সদস্য হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে)। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলির মধ্যে পাঁচটি দেশ ইতিমধ্যেই হয় নেটোয় সরাসরি যোগ দিয়েছে, অথবা নিজেদের নেটোর মিত্র-রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেছে। ইউক্রেন নেটোয় যোগদান করলে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী নেটোর সদস্য বা মিত্র-রাষ্ট্রের সংখ্যা ছয়ে গিয়ে দাঁড়াবে, যা রাশিয়ার সীমান্তে নেটোর সামগ্রিক শক্তিবৃদ্ধি করবে। এটা মস্কো একেবারেই চাইছে না।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে, পুতিন স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছিলেন যে, আমেরিকা এবং তার মিত্র রাষ্ট্রগুলির কাছে রাশিয়া ‘নির্ভরযোগ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার আশ্বাস’ চাইছে। বাইডেন সরকারের কাছে পুতিনের দাবি ছিল, তারা যেন প্রতিশ্রুতি দেয় যে, নেটো আর পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে না, এবং রাশিয়ার ভূখণ্ডের কাছাকাছি অস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করা বন্ধ করবে।
আমেরিকা ও নেটো রাশিয়ার দাবিতে ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ইউক্রেনকে নেটোর সদস্য না করা এবং আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে সামরিক জোট আরও পূর্বে প্রসারিত হবে না— পুতিনের এই দু’টি দাবির একটিও মানা হবে না বলে আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে মস্কোকে (দু’পক্ষের কেউই এটা স্পষ্ট করে না জানালেও, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের অন্তত তাই মত)।
তারই ফল এ বছরের গোড়া থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য মজুত করা, কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধজাহাজ ভাসিয়ে ইউক্রেন ও তার বন্ধু রাষ্ট্রদের ভীতিপ্রদর্শন এবং অবশেষে আরও একটা যুদ্ধ। উপরের ঘটনাপ্রবাহ বিচার করলে রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতকে আর যা-ই হোক হঠাৎ করে সৃষ্টি হওয়া বলা চলে না। গত নয় বছর ধরে এই সংঘাতের চিত্রনাট্য আস্তে আস্তে রচিত হয়েছে। রচনা করেছেন অনেকে মিলে। চিত্রনাট্য রচনা এখন সম্পূর্ণ। ‘শুটিং’-ফ্লোরে পৌঁছে গেছেন পাত্রপাত্রীরা। এর পর সম্ভবত শুধুই ‘অ্যাকশন’।
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy