ক্রোধাগ্নি: কৃষক আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি ব্যক্ত করায় রিহানা ও গ্রেটা থুনবার্গের ছবিতে আগুন ধরানো হচ্ছে, দিল্লি, ৪ ফেব্রুয়ারি। রয়টার্স
একটি প্রবাদ আছে, স্যাকরার ঠুকঠাক কামারের এক ঘা! একটি টুইট: ‘আমরা কেন এই বিষয়ে কথা বলছি না?’ তাতেই দেশের পরাক্রমশালী শাসক দলের ঘুম উড়ে গেল। কৃষি আইনের প্রতিবাদে ভারতীয় কৃষকদের তিন মাসব্যাপী আন্দোলন শেষ অবধি সারা পৃথিবীর নজরে চলে এল! বিশ্ববিখ্যাত মানবাধিকার ও পরিবেশকর্মীরা আজ রীতিমতো আলোচনা করছেন এই নিয়ে, কিন্তু প্রথম বড় খোঁচাটা বার্বাডোজ়-এর কৃষ্ণাঙ্গ কন্যার ছাতা থেকেই এসেছিল।
কৃষি আইন নিয়ে বেশি কিছু বলছি না। সচেতন নাগরিক জানেন, এই কৃষি বিল কতটা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাশ করানো হয়েছে সংসদে। চুক্তি চাষে কী ভাবে মৌরসিপাট্টা তৈরি হতে পারে কিছু লোকের, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে কী ভাবে দেশের কৃষিব্যবস্থা চলে যেতে পারে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে, সেটা যাঁরা খেতে নেমে ফসল ফলান, তাঁরা বুঝবেন না তো কে বুঝবে? তাঁরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘কালো আইন’ প্রত্যাহার না করলে তাঁরা পিছু হটবেন না। আজ অবধি দু’শোরও বেশি কৃষক আন্দোলনরত অবস্থায় মারা গিয়েছেন। গত কয়েক বছরে যেমন ভাবে অন্য সব আন্দোলনকে েহয় করেছে শাসক দল, এ ক্ষেত্রেও গত তিন মাসে আন্দোলনকারীদের নিয়ে কম কুৎসা করার চেষ্টা হয়নি। বিরোধীদের সাজানো ব্যাপার, নির্বোধ কৃষকরা বুঝছেন না, এমনকি তাঁরা খলিস্তানি, এমনও বলা হয়েছে। কিন্তু কৃষকদের প্রতি জন-সহানুভূতি কিছুতে কমছিল না।
অবশেষে ঘটল ২৬ তারিখে দিল্লির বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনা। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হিংসা ঢুকে পড়া শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকরও বটে। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমগুলি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে ক্ষতিটাকেই দেখাল। অথচ, এই হিংসা কে বা কারা করলেন, তাঁরা আদৌ কৃষক সংগঠনের কেউ, না কি ‘সাবোটাজ’ করার জন্যে বাইরে থেকে ‘ঢুকিয়ে’ দেওয়া কেউ, সেটাও সন্দেহাতীত নয়। যা হোক, আন্দোলন দমল না, আরও ছড়িয়ে পড়তে থাকল হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে। প্রতিবাদ উঠে এল মাটির একদম কাছে থাকা সেই মানুষগুলোর কাছ থেকে, যাঁরা হয়তো কিছু বছর আগে ‘অচ্ছে দিন’-এর আশায় ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু হিতে বিপরীত হওয়াতে আজ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। অবস্থানকারীদের জলের লাইন কেটে দেওয়া হল, রাজধানীর সীমান্তে পেরেক পুঁতে দেওয়া হল মাইলের পর মাইল জুড়ে, কাঁটাতার এবং দেওয়াল তোলা হল চাষিদের একঘরে করতে, বন্ধ করে দেওয়া হল ইন্টারনেটও।
ঠিক এই মুহূর্তে প্রবেশ ঘটল রিহানা, গ্রেটা থুনবার্গ, মিনা হ্যারিসের মতো বিখ্যাত ব্যক্তির। তাঁরা কৃষক আন্দোলন এবং তাকে ঘিরে ঘটতে থাকা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সরব হলেন তাঁদের ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়া ‘হ্যান্ডল’গুলি থেকে।
গত কয়েক বছরে গণতন্ত্রের সূচকে হুড়মুড় করে নীচের দিকে গড়িয়েছে আমাদের প্রজাতন্ত্র। সমাজমাধ্যমের নিরপেক্ষতা বা স্বাধীনতার মাপকাঠিতেও পিছিয়ে পড়েছে অনেকটা। জোর করে বিরোধী স্বর রোধ করতে ইন্টারনেট কাটার যে রীতি, তাতে বিশ্বে প্রথম পাঁচটির মধ্যে আছে এই নয়া ভারত; উত্তর কোরিয়া, ইরান, মায়ানমারের পাশাপাশি। এগুলি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা চলছিল বেশি কিছু দিন ধরেই। আর এই সময় আমাদের দেশের সরকার কী করল? নজিরবিহীন ভাবে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকার এক পপস্টার এবং কিছু মানবাধিকার ও পরিবেশকর্মীর ব্যক্তিগত টুইটের উত্তরে সরকারি বিবৃতি জারি করল! বলা হল, কৃষক আন্দোলন ও কৃষি আইন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বিদেশি হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
তার সঙ্গে কিছু জনপ্রিয় অভিনেতা এবং ক্রীড়াজীবীদের দিয়েও টুইট করানো হল একটি কথা। এঁদের মধ্যে কিছু খেলোয়াড় (সবাই নন) আশৈশব জাতীয় বীর হিসেবে বন্দিত। ‘করানো হল’ বলছি, কারণ এঁদের সবার টুইটের ভাষা কমবেশি এক, একই ছাঁচের হালকা রকমফের। এক জন চিত্রতারকা তো আবার স্থানীয় বিজেপি নেতার নামটা টুইটে ট্যাগও করে ফেলেছিলেন; কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপন করার সময়ে আমরা যেমন যাদের পণ্য তাদের ট্যাগ বা ‘মেনশন’ করি, সেই রকম। বোঝা গেল, আমাদের সার্বভৌমত্ব এতটাই ভঙ্গুর যে, কোনও বিদেশি নেতা নন, বিদেশি সরকারও নয়, কিছু শিল্পী ও সমাজকর্মীর ব্যক্তিগত মত প্রকাশেই তা নড়বড় করে!
প্রশ্ন এখানেই। গণমাধ্যমে করা কয়েকটি বক্তব্য নিয়ে শাসক এত বিচলিত হল কেন? এতটাই বিচলিত যে, টুইটারকে তাদের বলতে হল প্রায় দেড় হাজার প্রোফাইল বন্ধ করে দিতে? বলা হল, ‘হ্যান্ডল’গুলি নাকি আন্দোলন সমর্থন করার নাম করে মিথ্যে খবর ছড়াচ্ছে এবং শান্তিভঙ্গ করছে!
কার শান্তি? ঠিক ধরেছেন, মানুষের নয়, সরকার বাহাদুরের। এত বছর ধরে যে শাসক দলের তৈরি আইটি সেল মিথ্যে খবর, ভিডিয়ো ছড়িয়ে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস ভিতর থেকে ভেঙেছে, দাঙ্গা লাগিয়েছে, সরকারের সমালোচনা করলে খুন বা ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে, সংখ্যালঘুদের পিষে ফেলে বিজয়পতাকা ওড়ানোর কথা বলে চলেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু হাজার অভিযোগ করেও ‘সাসপেন্ড’ করানো যায়নি, কারণ সরকার তাদের নীরব পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আজ তাদের ঘৃণা ছড়ানোর প্রিয় মাধ্যমকেই তারা চোখ রাঙাচ্ছে কেন হঠাৎ? কারণ, এই ক্ষেত্রে তারা নিজেদের অস্ত্রে নিজেরাই বিদ্ধ হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতে এক পক্ষকে গলা ফাটাতে দিলে অন্য পক্ষও তাদের কথা বলে— এই হল মুশকিল।
আর শাসক দলের পছন্দের হাতিয়ার এই ইন্টারনেট ব্যবহার করেই কৃষক আন্দোলন আজ এত বড় চেহারা নিয়েছে। মিথ্যে প্রচার রোখার জন্যে কৃষকরা গণমাধ্যমগুলিকেই ব্যবহার করেছেন বেশি, টিভি চ্যানেলগুলিকে ছেড়ে দিয়েছেন সরকারি প্রোপাগান্ডা চালানোর জন্যে। তাঁরা সমর্থন পাচ্ছেন এমন সব আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে, যাঁদের কারও ফলোয়ার চল্লিশ লক্ষ, কারও এক কোটি। টনক নড়ছে পৃথিবীর, আর ঘাম ছুটছে শাসকের। তাই তাঁরা বোঝাতে চাইছেন যে, তাঁদের কথাটাই সত্য, বাকিদের কথার কোনও মানেই নেই। পঞ্জাবি প্রবাদ উদ্ধৃত করে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, “ত্বাদ্দা কুত্তা টমি, মেটা কুত্তা কুত্তা?” তোমার পোষা কুকুর বাহারের টমি, আর আমারটা ঘেয়ো নেড়ি?
ফেসবুকে কিছু মানুষ রিহানার প্রসাধনী ব্র্যান্ড বয়কট করছেন, প্রশ্ন করেছেন যে রিহানা বা গ্রেটারা নিজেদের দেশের সমস্যাগুলো সম্বন্ধে জানেন কি না। পৃথিবী এবং রাজনীতি নিয়ে হঠাৎ এক দিন সচেতন হওয়ার চেষ্টা করলে এই হয়— ঝকঝকে মিউজ়িক ভিডিয়ো বা দামি কসমেটিক ব্র্যান্ড যেমন রিহানার সেলেব্রিটি ব্যক্তিত্বের অঙ্গ, তেমনই বিভিন্ন মানবাধিকারের বিষয়ে তিনি সদা সচেতন, রিহানা বহু বার ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। গ্রেটা থুনবার্গ সব দেশের পরিবেশনীতির সমালোচক। অনেক নামজাদা বিশ্বনাগরিক নিজেদের দেশের সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে অন্য দেশের অন্যান্য ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আমাদের দেশে এবং রাজ্যেও এমন মানুষ আছেন, যাঁরা তথ্য ও যুক্তি দিয়ে সমালোচনার কণ্ঠস্বর বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু, দেশের বর্তমান অতিদক্ষিণপন্থী হাওয়ায় শিল্পী ও শিল্পের পরিসরটিকে নেহাত মনোরঞ্জনে সঙ্কীর্ণ করে রাখা হয়েছে। প্রচারযন্ত্রের সাহায্যে সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়েছে যে অভিনেতা, পরিচালক, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী সবাই নেহাতই ‘এলিট’, এঁদের সৃষ্টি মানুষের কোনও কাজে লাগে না, তাই গালাগালির মতো এঁদের ‘বুদ্ধিজীবী’ বলা হচ্ছে। সমাজে এঁদের মেধার গুরুত্ব ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিজের সময় এবং সমাজ সম্বন্ধে সচেতন থাকা শিল্পীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, হয়তো বা দায়িত্বও বটে। শিল্পী এক দিকে তাঁর সমাজের প্রতিনিধি, অন্য দিকে তার সমালোচকও। শিল্পীর এই সংজ্ঞার উদাহরণ বা প্রমাণ খুঁজতে বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই, বাংলার বাইরেও যেতে হবে না, গিরিশ ঘোষ থেকে রবীন্দ্রনাথ, উৎপল দত্ত থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সবাই এই বৃহৎ শিল্পীসত্তার ধারক ও বাহক।
একটা সময়ে প্রতিবাদের আঙিনায় বাংলা বাকি দেশকে পথ দেখাত। সে আজ অতীত। কিন্তু সংবেদনশীল, ভাবুক, শিল্পপ্রেমী একটি জাতি বলে তার পরিচয়টা এখনও টিকে আছে। এর মূলে আছে সারা পৃথিবীর ঘটনা সম্বন্ধে সচেতন থাকা এবং তা নিয়ে তর্ক করার একটি সহজাত প্রবণতা।
সেটুকুও আর থাকবে কি? আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে, পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি, আমাজ়নের আগুন লাগা নিয়ে চায়ের কাপ বা গণমাধ্যমে তুফান তুললে যদি সেই সব দেশের সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা গলাচ্ছি বলে আমাদের আক্রমণ করে? বিশ্বনাগরিক হওয়ার সুযোগ বা গৌরবটাই তো তা হলে ভেঙে চুরমার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy