প্রধান: কানপুরে দলীয় কর্মসূচিতে বক্তৃতা করছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। ১০ অক্টোবর ২০২২। পিটিআই
সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাদিবস উপলক্ষে বিজয়া দশমীর দিন এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটা বক্তৃতা করলেন মোহন ভাগবত। তার আগে, সেপ্টেম্বর মাসে, বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট মুসলমানের সঙ্গে দেখা করেন তিনি— প্রাক্তন আমলা, শিক্ষাবিদ, মৌলবি। সেই তালিকায় কোনও রাজনীতিক ছিলেন না, এই কথাটি শুধুমাত্র তথ্যের খাতিরেই উল্লেখ্য নয়, তার আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু, আপাতত ভাগবতের বক্তৃতার কথা বলি। তাতে এল ভারতীয় মুসলমানদের কথা, দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতির কথা, এবং হিন্দুরাষ্ট্রের কথা। এমন ভাবে এল, যাতে সেই কথাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ভাবে পাঠ করা যায়, আবার পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত যুক্তিক্রম হিসাবেও দেখা যায়।
ভাগবত বললেন, হিন্দুরা সংগঠিত হচ্ছে বলে ভারতের ‘তথাকথিত সংখ্যালঘু’-দের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই— সঙ্ঘের থেকে অতীতেও মুসলমানদের কোনও বিপদ হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। আশ্বাসবাণীটি যেমন সবিশেষ, ‘তথাকথিত’ কথাটিও তাৎপর্যপূর্ণ। এই ভাষণেই ভাগবত জনসংখ্যা নীতির কথা বলেছেন। তাঁর মতে, সেই নীতি সব সম্প্রদায়ের জন্য সমান ভাবে প্রযুক্ত হওয়া প্রয়োজন, যাতে ভারতের জনসংখ্যায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুপাত অপরিবর্তিত থাকে। নচেৎ, তা দেশের অখণ্ডতার পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে— উদাহরণ, ভারতের দেশভাগ, এবং সাম্প্রতিকতর সময়ে ইস্ট টিমোর, সাউথ সুদান ও কসোভো। অর্থাৎ, জনসংখ্যাতত্ত্ব যা-ই বলুক, ভাগবত এবং সঙ্ঘ তাঁদের সনাতন বিশ্বাসে অটল— মুসলমানদের জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে, এবং তা অখণ্ড ভারতের পক্ষে বিপজ্জনক। তাঁদের মত স্পষ্ট— রাষ্ট্র মুসলমানদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য করবে, এবং তারা সেই বাধ্যতা মেনে নিয়ে থাকবে।
কোথায় থাকবে? এই ভারত নামক হিন্দুরাষ্ট্রেই। ভাগবত জানিয়েছেন, ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ কথাটিতে অনেকের আপত্তি আছে, ফলে তাকে অন্য নামে ডাকলেও সঙ্ঘ পরিবারের অসুবিধা নেই— তাঁরা অবশ্য নিজেদের ব্যবহারের সুবিধা অনুযায়ী ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ কথাটিই ব্যবহার করবেন। নামে সত্যিই খুব কিছু যায়-আসে না। ঐতিহাসিক ভাবে, হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনার সঙ্গে হিন্দুধর্মের যোগ— নামমাহাত্ম্যের তুলনায়— কম। এই রাজনীতিতে ‘হিন্দু’-র সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় চারটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে— যাদের শরীরে আর্য রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে; যারা ভারত নামক দেশটিকেই নিজেদের পিতৃভূমি বলে মনে করে; যাদের কাছে সংস্কৃত হল পবিত্র ভাষা; এবং যারা হিন্দু সংস্কৃতিকে নিজের বলে জ্ঞান করে, তারাই হিন্দু। যাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ইউজ়ার ম্যানুয়েল বলা যেতে পারে, সেই হিন্দুত্ব: হু ইজ় আ হিন্দু নামক বইটিতে সাভারকর লিখেছেন, ‘অ-হিন্দু মা-বাবার সন্তানও যদি কোনও হিন্দুকে বিয়ে করে, এই দেশকে ভালবেসে আপন করে নেয় এবং একেই নিজের পিতৃভূমি জ্ঞান করে, তা হলে তাকে হিন্দু বলে গণ্য করা হবে’। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র নামে ডেকে অথবা না ডেকেও, এই শর্তগুলি মেনে মুসলমানরা ভারতে থাকলে সঙ্ঘের কোনও আপত্তি নেই, বিজয়া দশমীর বক্তৃতায় ভাগবত অনতিপ্রচ্ছন্ন ভাবে জানিয়েছেন সে কথাটাই। সংখ্যালঘুর আগে ‘তথাকথিত’ শব্দটিও এসেছে ইতিহাসের পথ বেয়েই। গোলওয়ালকর বলেছিলেন, কোনও অ-হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায় যদি নিজেদের সংখ্যালঘু বলে দাবি না করে (অর্থাৎ, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের থেকে নিজেদের দূরত্বকে যদি তারা প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা না দিতে চায়, বরং তাদের আধিপত্যকে মেনে নেয়), তা হলে তাদের ভারত নামক হিন্দুরাষ্ট্রের বৈধ নাগরিক হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি নেই।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই অবস্থানের মধ্যে একটা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’-এর ইঙ্গিত রয়েছে। তার শর্তগুলো অবশ্যই হিন্দু আর মুসলমানের জন্য সমান নয়— বস্তুত, হিন্দুদের জন্য কোনও শর্তই নেই, মুসলমানদের ত্যাগ করতে হবে মক্কা-মদিনার প্রতি অথবা আরবি ভাষার প্রতি আনুগত্য। এবং, মুসলমানদের কোনও ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্বও থাকবে না— সেই কারণেই, ভাগবত আলোচনার জন্য মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকে যাঁদের বেছে নেন, তাঁদের মধ্যে ধর্মগুরুরাও থাকেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা নন। কিন্তু, তার পরেও, এনআরসি-সিএএ’র মাধ্যমে বিজেপি যে ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করছে, অর্থাৎ মুসলমান ধর্মীয় পরিচয়মাত্রেই ‘অভারতীয়’, তার সঙ্গে ভাগবতের সংজ্ঞার স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কেউ বলতেই পারেন, এক সংজ্ঞায় মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, আর অন্য সংজ্ঞায় নাগরিকই নন— এই দুইয়ের মধ্যে ধারণাগত ফারাক যদি বা থাকেও, ব্যবহারিক পার্থক্য কোথায়? আপত্তিটি কোনও মতেই অগ্রাহ্য করার নয়, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মাথায় রাখা জরুরি যে, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা যতই নিজেদের মতো করে দল চালাতে চান, বিজেপির রাজনীতির অন্তত আংশিক নিয়ন্ত্রণ সঙ্ঘ পরিবারের হাতেই থাকবে। খেয়াল করা প্রয়োজন, গুজরাতে যখন বিজেপি হুঙ্কার দিয়ে জানাচ্ছে যে সিএএ হবেই, তার আগে-পরেই প্রধানমন্ত্রী পসমন্দা (অনগ্রসর) মুসলমানদের কাছে টানার কথা বলছেন, তাঁদের আর্থিক উন্নয়নের কথা বলছেন, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি পসমন্দা মুসলমানদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের চেহারা এবং সীমা কী হবে, সঙ্ঘের অবস্থানের জটিলতাকে অগ্রাহ্য করে সে কথা বোঝার উপায় নেই।
ভারতের ইতিহাসে মুসলমান শাসকরা যে কোনও মতেই ‘ভারতীয়’ নন, তা নিয়ে সঙ্ঘের মধ্যে কোনও তর্ক নেই। প্রশ্ন হল, সাধারণ মুসলমানরা কি ভারতীয়? বিশেষত, যাদের যথাক্রমে হিন্দু অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি ও তফসিলি জাতিভুক্তদের সঙ্গে তুলনীয় বলা হয়, সেই আজ়লাফ ও আরজ়াল গোষ্ঠীভুক্ত মুসলমানরা? সঙ্ঘের অভ্যন্তরেই দীর্ঘ দিন ধরে একটি মত রয়েছে যে, সাধারণ মুসলমানরা পরিস্থিতির চাপে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, কাজেই তাঁদের ভূমিপুত্র বলে মেনে নিতে কোনও সমস্যা নেই। তবে দেখতে হবে যে, তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্য যেন ভারতের প্রতিই থাকে, পাকিস্তানের প্রতি নয়। হিন্দু রাজনৈতিক প্রাধান্যের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নটি স্বাধীনতার আগে, এবং পরের অন্তত দু’দশক সময় সঙ্ঘের রাজনীতিকে মুসলমানদের প্রতি সন্দিহান রেখেছিল। সেই আগল অনেকখানি ভাঙল ১৯৭০-এর দশকে— এক ব্যক্তি, এবং একটি ঘটনার দৌলতে। ব্যক্তির নাম মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরস— আরএসএস-এর তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক, গোলওয়ালকরের বেছে নেওয়া উত্তরাধিকারী। এবং ঘটনাটি জরুরি অবস্থা, ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে যার গুরুত্ব তুলনাহীন। দেওরসের আমলেই সঙ্ঘের সদস্যপদ গ্রহণের দরজাটি মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য খুলে দেওয়া হয়, ১৯৭৯ সালে। কিন্তু, তারও আগে, জরুরি অবস্থা-বিরোধী জনতা জোটের অংশীদার হওয়ার জন্য জামাত-এ-ইসলামির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাতেও সম্মতি জানিয়েছিলেন দেওরস।
মুসলমানরা যত ক্ষণ হিন্দুত্বের আধিপত্যকে মেনে নিয়ে থাকতে রাজি, তত ক্ষণ অবধি তাঁদের প্রতি সহনশীল থাকার এই রাজনৈতিক ধারাটি সঙ্ঘ বজায় রেখেছে। তার একটা মোক্ষম উদাহরণ মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ— সঙ্ঘ পরিবার তাকে কখনও শাখা সংগঠন হিসাবে স্বীকার করেনি বটে, কিন্তু ২০০২ সালে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা থেকে প্রতি মুহূর্তে তাকে সাংগঠনিক সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছে। এমআরএম-ও বিজেপির হয়ে নির্বাচনী প্রচার করেছে মুসলমানদের মধ্যে, শ্রীনগরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছে, গোহত্যার বিরুদ্ধে দশ লক্ষ মুসলমানের স্বাক্ষর-সম্বলিত আবেদনপত্র জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে।
ভাবার কোনও কারণ নেই যে, মুসলমানদের প্রতি কতখানি ‘উদার’ হওয়া উচিত, তা নিয়ে সঙ্ঘের অভ্যন্তরে কোনও টানাপড়েন নেই। বিলক্ষণ আছে। সত্তরের দশকে মহারাষ্ট্রের সঙ্ঘচালক কে বি লিমায়ে দেওরসকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “যদি মনে করেন যে, সঙ্ঘকে পাল্টে দেওয়া জরুরি, তা হলে নিজে নতুন দল তৈরি করুন, হেডগেওয়াড়ের সঙ্ঘকে আমাদের জন্য ছেড়ে দিন।” মুসলমানদের নাগরিকত্ব স্বীকার করার জন্য তাদের হিন্দুরাষ্ট্রের শর্ত-অনুসারী ‘ভারতীয়’ করে তোলাই যথেষ্ট, না কি ধর্মান্তরণের মাধ্যমে হিন্দুধর্মে ‘ঘর ওয়াপসি’ জরুরি, সেই বিতর্কও আছে। কিন্তু, মুসলমানরা যদি নিজেদের রাজনৈতিক দাবি ত্যাগ করে, যদি নামে অথবা বেনামে হিন্দুরাষ্ট্রের শর্তগুলিকে মেনে নেয়, তা হলে ভারতে তাদের জায়গা দেওয়ার প্রশ্নে সঙ্ঘের অবস্থানটি এক রকম পরিষ্কার। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সাকুল্যে সাত জন মুসলমান প্রার্থী দেবে, কিন্তু মুসলিম জাগরণ মঞ্চ মুসলমানদের মধ্যে সেই বিজেপির হয়ে প্রচার করবে, আনুগত্যের শর্ত এই রকমই। এই শর্তের কথা মাথায় রাখলে ভাগবতের ভাষণের সারমর্ম বুঝতে সমস্যা হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy