মিত্র: কলকাতার রাজভবনে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গাঁধীর সাক্ষাৎ। ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
অমিত শাহ বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন! তাঁর মতে, ইতিহাসের বড় বড় ‘পেশাদার’ পণ্ডিতেরা কিছুতেই নিজেদের কাজটুকু ‘ঠিক ভাবে’ করেন না। তাই তাঁদের দ্বারা ইতিহাসের প্রকৃত মূল্যায়নও হয় না। অতএব ইতিহাসকে ‘ঠিক’ করে লেখা খুব জরুরি। এটা জাতীয় দায়িত্বও বটে।
দু’বছর আগে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে সম্রাট স্কন্দগুপ্তের উপর আয়োজিত একটি সেমিনারের মঞ্চে শাহের ওই অভিমত শোনা গিয়েছিল। তবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। আমাদের দেশে রাজনীতিকদের এটাই দস্তুর। বৃহৎ নেতা-মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই। উঁচু মঞ্চ থেকে নেতা যখন জানতে চান, ‘হ্যায়, কি নহী’, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে ‘নহী’ বলবে! মঞ্চ যদি প্রশ্ন করে, ‘ঠিক বললাম তো’, শত-সহস্র কণ্ঠ বলে উঠবেই, ‘ঠিক, ঠিক!’ শাহের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটার কথা নয়।
যদিও এখন অনেকেই জানেন যে, ইতিহাস নিয়ে শাহদের দলের ভাবনাচিন্তার একটি বিশেষ ছক আছে। এ ব্যাপারে আরএসএস ওঁদের মার্গ প্রদর্শক। সঙ্ঘের মত, দেশের মান্য ইতিহাসবিদরা অধিকাংশই ‘সেকুলার’ বলে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা ইতিহাসে ‘ভারতীয়ত্ব’-এর (আসলে হিন্দুত্ববাদ) প্রতিফলন ঘটেনি।
অতএব ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় বসার পরেই শুরু হল ‘ভুল’ শুধরানোর পালা। আরএসএসের তৈরি ‘ভারতীয় শিক্ষা-নীতি আয়োগ’ সেই উদ্যোগের প্রথম ধাপ। ক্রমে আরও যা যা হয়েছে, সেই তালিকাও ছোট নয়। তার জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ থেকে এনসিইআরটি-র মতো সংস্থাগুলি কী ভাবে ‘ব্যবহৃত’, তার বর্ণনাও সর্বজনবিদিত।
তথ্য বলে, ২০০৫ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে কেন্দ্রীয় বোর্ডের পড়ুয়াদের জন্য এনসিইআরটি যে সব পাঠ্যবই প্রকাশ করেছিল, মোদী-জমানার প্রথম চার বছরেই তার ১৮২-টিতে হাজার দেড়েক ‘সংশোধন’ করা হল। রাজস্থানের স্কুলে ‘সুখপাঠ্য’ ভারতীয় ইতিহাস শেখানোর জন্য পুরনো বই ফেলে নতুন নতুন বই সিলেবাসে ঢুকল। একটি দৃষ্টান্ত দিই। নির্দেশ দেওয়া হল, সম্রাট আকবরের কোনও ‘মহানুভবতা’ যেন তুলে ধরা না হয়।
এই সময়ে এ সব প্রসঙ্গ তোলার কারণ, ইন্দিরা গাঁধী সম্পর্কে দেশের বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক মনোভাব। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিজয়োৎসবে কোথাও ইন্দিরা গাঁধীর নাম উচ্চারণ করেনি মোদীর সরকার। যদিও পাকিস্তানকে পরাভূত করার পিছনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার নেতৃত্ব কী ভাবে কাজ করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার নেপথ্যে কী ছিল তাঁর ভূমিকা, সে কথা গোটা বিশ্ব জানে। সত্যিকারের নিরপেক্ষ ইতিহাসের পাতা থেকে কেউ চাইলেও তা মুছে দিতে পারবে না। তবে শাসকদের এই বিকারের কারণ বোঝা কঠিন নয়।
যেমন, সঙ্ঘ ও বিজেপি শাসকের হাতে পড়ে রাজস্থানে অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে জওহরলাল নেহরু ‘নির্বাসিত’ হন বহু আগেই। বাবাসাহেব আম্বেডকর ‘হিন্দু সমাজ-সংস্কারক’ হিসাবে বর্ণিত। আর সাভারকর সম্পর্কে লেখা হয়, “স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।” বিজেপি-শাসিত ওই রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী গর্ব করে বলেছিলেন, “এ বার অন্তত এখানে কোনও কানহাইয়া তৈরি হবে না!”
তিন বছর আগে কলকাতায় ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের অধিবেশন হয়েছিল। ইতিহাস কংগ্রেসের তৎকালীন প্রধান কে এম শ্রীমালি বলেছিলেন, “দেশে যুক্তি-তর্কের পরিসর বড়ই কমে যাচ্ছে। ইতিহাস সম্পর্কে যাঁদের জ্ঞানগম্যি নেই, তাঁরা তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে নিজেদের মতো করে সব চাপিয়ে দিচ্ছেন।” শ্রীমালির মতে, এ-ও এক ধরনের সন্ত্রাস।
টুকরো টুকরো এই বিষয়গুলি সামনে রাখলে তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইন্দিরা গাঁধীকে ভুলিয়ে দেওয়ার কৌশল আসলে সেই ধারাবাহিকতা, যার পিছনে ‘সহায়’ হল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর এবং স্বৈরতান্ত্রিক দম্ভ।
ইন্দিরা তখন কী করেছিলেন, তা ফিরে দেখার আগে বলা দরকার, মোদী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন। কেন তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল, সেটা অবশ্য বলেননি। প্রশ্ন জাগে, হানাদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন ভারত লড়ছে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবিকে ভারত যখন সমর্থন করছে— তখন মোদীকে হঠাৎ জেলে যেতে হল কেন? কোন অভিযোগে?
ইন্দিরার ভূমিকা অবশ্য বিশ্ববিদিত। ১৯৭১-এ তদানীন্তন পাকিস্তানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরে সেখানে স্বশাসনের দাবি জোরালো হয়। অভ্যন্তরীণ অশান্তির জেরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী চলে আসেন ভারতে। ইন্দিরা পাকিস্তানকে বলেন শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু পাকিস্তানের গোঁয়ার্তুমিতে আলোচনা ভেস্তে যায়।
১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে পাকিস্তান। জানা যায়, ভারতের কয়েকটি সামরিক বিমানঘাঁটি হামলার কবলে পড়েছিল। ইন্দিরা সে দিন ছিলেন কলকাতায়। রাজভবনে তাঁর কাছে খবর পৌঁছনোর পরে তিনি দ্রুত দিল্লি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কেউ তাতে সায় দেননি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরগুলিতেও তত ক্ষণে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জারি হয়েছে। রানওয়েতে আলো নেবানো। কিন্তু ইন্দিরা নাছোড়।
দমদম বিমানবন্দরের সেই সময়ের এক পদস্থ কর্তার কাছে শুনেছিলাম, অদম্য জেদ ও সাহসে সকলকে দমিয়ে দিয়ে ইন্দিরা রওনা হন। তাঁর বিমানকে রানওয়েতে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি জিপ। জিপের পিছনের লাল আলো অনুসরণ করে টেক অফ পয়েন্ট। সেখান থেকে ঝুঁকির উড়ান।
দিল্লি পৌঁছেই বৈঠক করলেন তিনি। তার পরে গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ঘোষণা করলেন, পাকিস্তানের হামলার সমুচিত জবাব দিতে নামছে ভারত। তিনি বলেছিলেন, “এই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
মাত্র তেরো দিনে পাকিস্তান কুপোকাত। ইন্দিরা স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছিলেন গোড়া থেকেই। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক, অসামরিক সব রকম সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ইন্দিরার সরকার। আজ অনেকেই জানেন, কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করার পরে শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন কলকাতায়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্দিরা-মুজিব এক সঙ্গে সমাবেশ করলেন ব্রিগেডে। অভিজ্ঞজনেরা বলেন, ওই সভার জনসমাগম এখনও অনতিক্রম্য রেকর্ড হয়ে আছে।
সেই ইন্দিরাকে উহ্য রেখে ১৯৭১-এর যুদ্ধ জয়ের অর্ধশতবর্ষ পালন করে মোদী কী দেখাতে চাইলেন? সার্জিকাল স্ট্রাইক ‘সফল’ হলে যদি মোদীর কৃতিত্বের খাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে লিখতে হয়, শত মুখে তাঁর জয়গান গাইতে হয়, তা হলে ইন্দিরা ব্রাত্য কেন?
বস্তুত নীতি নির্ধারণ এবং রূপায়ণে মুখ্য ভূমিকা থাকে প্রধানমন্ত্রীর। সেখানে মোদী যা, ইন্দিরাও তা-ই। আর এ তো কোনও অভ্যন্তরীণ কলহ নয়। সে জন্যই বিষয়টি বড় কদর্য সঙ্কীর্ণতার বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কারও কেনা গোলাম নয়। সে নির্মোহ সত্যের কাছে দায়বদ্ধ।
একই ভাবে প্রশ্ন জাগে বিরোধীদের ভূমিকা নিয়েও। ‘যুদ্ধজয়ী’ ইন্দিরাকে অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘দুর্গা’ বলেছিলেন। আর আজ ওই প্রসঙ্গে ইন্দিরার নাম উচ্চারিত না হলেও বিরোধী শিবিরে একটি প্রতিবাদী স্বর শোনা যায় না!
ধিক রাজনীতি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy