Advertisement
E-Paper

বাঘ থাকবে, মানুষ নয়

কেন্দ্রীয় দফতর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন দ্বারা যুগ যুগ ধরে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের জমির অধিকারের ফয়সালা না করে, তাঁদের মতামত অগ্রাহ্য করে একের পর এক অঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছে।

বিধান কান্তি দাস

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২৩ ০৬:১১
Share
Save

১৯৭৩-এ কেন্দ্রীয় সরকার ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ হাতে নেয়, তার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। প্রকল্পের শুরুতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১৮২৭, এখন বেড়ে ৩১৬৭। ১৯৭২-এ সরকার বন্যপ্রাণী শিকার ও ব্যবসা রুখতে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে, এর দ্বারা বনসম্পদ ব্যবহারের অধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংরক্ষিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। যেমন জাতীয় উদ্যান, যেখানে জঙ্গলে বসবাসকারীদের বনজ সম্পদের উপর অধিকার নেই। অন্য দিকে রয়েছে অভয়ারণ্য, যেখানে অনুমতিক্রমে তাঁরা সীমিত বনজ সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন।

কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ দফতর বাঘ সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই আইন সংশোধন করে ‘টাইগার রিজ়ার্ভ’ তৈরি করছে, বাঘ সংরক্ষণ পরিচালনায় তৈরি করেছে ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজ়ার্ভেশন অথরিটি’। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জাতীয় উদ্যান, টাইগার রিজ়ার্ভ-এর ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছে। ১৯৭৩-এ ন’টি টাইগার রিজ়ার্ভ নিয়ে শুরু হয় ‘প্রোজেক্ট টাইগার’, আজ মোট ১৯টি রাজ্যে ৫০টি টাইগার রিজ়ার্ভ। ১৯৭২-এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০০৬-এ সংশোধিত হয়, টাইগার রিজ়ার্ভ বৃদ্ধি পায়। সংরক্ষণবাদীদের বিশ্বাস, বাঘ সংরক্ষণ করতে গেলে সেখানে মানুষকে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। ফলে টাইগার রিজ়ার্ভ অঞ্চলে অধিবাসীদের জোর করে উৎখাত করা হচ্ছে, নামমাত্র পুনর্বাসন দিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের মান খারাপ।

কেন্দ্রীয় দফতর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন দ্বারা যুগ যুগ ধরে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের জমির অধিকারের ফয়সালা না করে, তাঁদের মতামত অগ্রাহ্য করে একের পর এক অঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছে। বন্যপ্রাণী ও মানুষের সহাবস্থান অসম্ভব, এই অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে এ সব অঞ্চলে বাসিন্দাদের উৎখাত করা হচ্ছে। ২০০৬ থেকে টাইগার রিজ়ার্ভের দ্রুত বৃদ্ধি ও জনজাতিদের উৎখাতের মাত্রা বৃদ্ধি শুরুর সময়ে তখনকার ইউপিএ সরকার জঙ্গলের অধিকার ও পরিচালনায় জঙ্গলে বসবাসকারীদের নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে ‘বন অধিকার আইন ২০০৬’ প্রণয়ন করে— এই আইনে সব সংরক্ষিত অঞ্চলে জঙ্গলে বসবাসকারীদের অধিকার সুরক্ষিত। ‘ক্রিটিক্যাল ওয়াইল্ডলাইফ হ্যাবিট্যাট’ নামের কিছু এলাকাকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বাদ রাখা হয়। ওই এলাকার বাসিন্দাদের উৎখাত করতে হলে তাঁদের অনুমতি নিতে হবে, পুনর্বাসন প্রকল্প সম্পন্ন করার পরেই স্থানান্তরিত করা যাবে। কিন্তু আধিকারিকরা এই সব বিশেষ সংরক্ষিত অঞ্চলে বন অধিকার আইন প্রয়োগে অনিচ্ছুক। তাঁদের বিশ্বাস, মানুষের উপস্থিতিতে বাঘ সংরক্ষণ সম্ভব নয়।

ন্যাশনাল টাইগার কনজ়ার্ভেশন অথরিটি বন আধিকারিকদের এক নতুন সংরক্ষিত অঞ্চল (ক্রিটিক্যাল টাইগার হ্যাবিট্যাট) তৈরির নির্দেশ দেয়, যেখানে মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই বাঘ সংরক্ষণ করা হবে। এখান থেকে মানুষকে উৎখাত করলে বন অধিকার আইনের শর্ত মানার প্রয়োজন নেই। ২০০৬-এর আইনে অবশ্য শুধু ইচ্ছুক অধিবাসীদের স্থানান্তর ও পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। ২০০৮-এ স্থানান্তর ও পুনর্বাসন নিয়ে প্রকাশিত নির্দেশিকায় ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতি পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা বা সমমূল্যের জমি, বাড়ি করে দেওয়ার কথা বলা আছে, ২০২১-এ তা বাড়িয়ে ১৫ লক্ষ হয়েছে। তথ্য বলছে, ২০০৮-২০১৯ সময়কালে ৫০টি টাইগার রিজ়ার্ভ থেকে ১৭৩টি গ্রামের ১৪,৪৪১টি পরিবার এই প্রকল্পে স্থানান্তরিত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানান্তর ও পুনর্বাসনের নিয়ম মানা হয়নি। ব্যাঘ্র প্রকল্পে অর্থের জোগান বাড়তে থাকায় এ সব অঞ্চলে বসবাসকারীদের অনুমতি পেতে নেওয়া হচ্ছে নানা কৌশল। মহারাষ্ট্রের মেলঘাট টাইগার রিজ়ার্ভ-এর অধিবাসীরা পুনর্বাসন প্রকল্প বাতিল করলে স্থানান্তরের জন্য তাঁদের ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছে, যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করা, গরু-ছাগল আটকের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সরিস্কা টাইগার রিজ়ার্ভ-এ স্থানান্তরের জন্য কৌশলে গ্রামসভার অনুমতি নেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুনর্বাসন প্রকল্পে জঙ্গলের জমি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তা রাজস্ব জমিতে পরিণত করা হয়নি, সরকারি কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের এই পদ্ধতিতে বাঘ সংরক্ষণে কিছু সাফল্য এসেছে, কিন্তু জনজাতিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। নষ্ট হচ্ছে সংরক্ষিত অঞ্চলের জীববৈচিত্রও। গবেষণা বলছে, জীববৈচিত্র ঠিক রাখতে, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে স্থানীয় মানুষের যোগদান জরুরি। যে সব সংরক্ষিত অঞ্চলে বন অধিকার আইনে সমষ্টিগত বনসম্পদের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে, সেখানে গ্রামসভা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিচালনার উদ্যোগ করছে, বনসম্পদ ব্যবহারে উন্নত হচ্ছে জীবনের মানও। কর্নাটকের বিআরটি অভয়ারণ্যে সলিগা জনজাতিদের ৩২টি গ্রাম একত্রে বাঘের বিচরণক্ষেত্র ঠিক করেছে। ওড়িশার সিমলিপাল টাইগার রিজ়ার্ভে গ্রামসভা তাদের স্বীকৃত এলাকায় সংরক্ষণ ও পরিচালন পরিকল্পনা তৈরি করেছে। যেখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান সম্ভব নয় সেখানে অধিবাসীদের নিয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প তৈরি ও তার ঠিক প্রয়োগ করা দরকার। এতে স্থানীয় মানুষ ও আধিকারিকদের সম্পর্কের উন্নতি হবে, বাঘ সংরক্ষণে স্থানীয়দের সহযোগিতা বাড়বে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tiger reserve Eviction

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}