Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Anemia

আরোগ্যের কাঁচি ও লক্ষ্যসাধন

২০২১ সালে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) সিকল সেল অ্যানিমিয়া সারানোর উদ্দেশ্যে মানুষের দেহে জিন থেরাপির অনুমতি দেয়।

চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে গেল।

চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে গেল।

সায়ন্তনী ঘোষ দস্তিদার
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২২ ০৫:৩৪
Share: Save:

অপালা আর শান্তনুর ছেলে জন্মের সময়ে ছিল স্বাস্থ্যবান, সুন্দর। কিছু দিনের মধ্যেই আশঙ্কার মেঘ জমল। শিশুর ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গেল, তার ‘সিকল সেল অ্যানিমিয়া’ রয়েছে। ছেলেকে নিয়ে পাহাড় চড়া, সমুদ্রে সাঁতরানোর স্বপ্ন মুলতুবি রইল, এখন শান্তনু-অপালা অনেকটা সময় কাটান হাসপাতালে, ছেলেকে রক্ত দিতে। প্রতি বছর বিশ্বে তিন লক্ষের মতো শিশু জন্মায় ‘সিকল সেল অ্যানিমিয়া’ নিয়ে। তাদের বাবা-মায়েরা কেবলই খোঁজ-খবর নেন, নতুন কোনও চিকিৎসা এল কি না। তাই ২০২১ সালে যখন আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) সিকল সেল অ্যানিমিয়া সারানোর উদ্দেশ্যে মানুষের দেহে জিন থেরাপির অনুমতি দিল, আশায় বুক বাঁধলেন সকলে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া অ্যাট সান ফ্রান্সিস্কো প্রায় চুরাশি কোটি ডলার পেয়েছে এই পরীক্ষার জন্য, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু হবে এ বছর ডিসেম্বর থেকে, চলবে পাঁচ বছর। ব্যবহৃত হবে ‘সিএএস৯’ প্রযুক্তি, যার গুরুত্ব নোবেল পুরস্কারে প্রমাণিত। যদি অন্তত ছ’জনের ক্ষেত্রে এই জিন থেরাপি কার্যকর এবং নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়, তা হলে আরও তিন জন কিশোর রোগীর উপরে এর প্রয়োগ হবে।

কিন্তু এত দেরি কেন? সেই ১৯৫৩ সালে ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার করেছিলেন দুই বিজ্ঞানী, জেমস ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক। তখন মনে হয়েছিল, সব অসুখের নিরাময় এ বার হাতের মুঠোয়। বাস্তবে দেখা গেল, মানবজিনের কোড আবিষ্কার হিমবাহের চূড়াটুকু। কী করে জিনের কোড বদলাতে হয়, তা বুঝতে গত তিন দশকেরও বেশি গবেষণা চলছে। তার গতি বার বার আটকে গিয়েছে বিতর্কে। যেমন, ১৯৯৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়াতে যকৃতের একটি বিরল জেনেটিক রোগ (সংক্ষেপে তাকে ‘ওটিসি’ বলা হয়) সারানোর জন্য একটি থেরাপি পরীক্ষা করা হয়েছিল সতেরো জন রোগীর উপর। তাঁদের মধ্যে এক জন, আঠারো বছরের একটি ছেলে, জিন থেরাপির ইনজেকশন নেওয়ার চার দিনের মধ্যে মারা যান। এর ফলে অবহিত হয়ে সম্মতি দান (ইনফর্মড কনসেন্ট) করা হচ্ছে কি না, রোগী সুরক্ষিত কি না, তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ওঠে। আমেরিকায় জিন থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়।

সতর্ক হলেন বিজ্ঞানীরাও। জিন-জগতের বহু কিছু যে অজানা রয়ে গিয়েছে, পরীক্ষার প্রযুক্তিকে আরও সূচিমুখ হতে হবে, উপলব্ধি করলেন তাঁরা। ২০১২ সালে দুই বিজ্ঞানী, জেনিফার ডুডনা এবং ইমানুয়েল শারপেন্তিয়ের জিনে থাকা ডিঅক্সি-রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডকে (ডিএনএ) কাটা ও জোড়ার এক অত্যন্ত শক্তিশালী ‘কাঁচি’ আবিষ্কার করলেন। তা দিয়ে জীবনের সঙ্কেত (জেনেটিক কোড) নতুন করে লেখা যায়। ২০১৩ সালে, হার্ভার্ড এবং এমআইটি থেকে গবেষকদের দু’টি দল স্বতন্ত্র ভাবে এই ‘সিএএস৯’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ল্যাবরেটরিতে তৈরি মানবকোষ কাটা-জোড়ায় সফল হল। চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে গেল।

প্রতিটি বৃহৎ আবিষ্কার জন্ম দেয় বৃহৎ বিতর্কের। কৃত্রিম উপায়ে সন্তানের জন্ম দেয় যে সব প্রতিষ্ঠান (ফার্টিলিটি ক্লিনিক), তার মালিকরা চাপ দিতে থাকলেন, মানবভ্রূণের উপর ‘কাঁচি’ চালানোকে বৈধ করা হোক। এর পিছনে রয়েছে অতি-ধনী কিছু মানুষের সাধ, তাঁদের সন্তান দেখতে হবে হলিউড নায়কের মতো, আর বুদ্ধিতে হবে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ২০১৮ সালে চিনের এক বিজ্ঞানী, হি চিয়ানখুই, দাবি করেন যে, তিনি ভ্রূণ অবস্থায় যমজ বোন নানা আর লুলু-র জিন এডিট করেছেন এমন করে যে, তারা এইচআইভি-প্রতিরোধক হয়েই জন্মেছে। কিন্তু দেখা গেল, তিনি তাঁর নির্দিষ্ট জিনগুলি বদলাতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর কাজের ফলে দুই বোনের জিনোম-এ এমন কিছু পরিবর্তন হয়েছে, যা প্রকৃতিতে কখনও দেখা যায় না। তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও চারিয়ে যাবে। এই গবেষণা অনেক নৈতিক প্রশ্ন তুলে দিল। চিয়ানখুই-এর তিন বছরের জেল হল, অনেকগুলি দেশে ভ্রূণের জিনে ‘সিএএস৯’ প্রযুক্তি নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করল। বোঝা গেল, নতুন ‘কাঁচি’ সুনির্দিষ্ট ভাবে ব্যবহার করার লক্ষ্য থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে। সেই সঙ্গে চলছে নৈতিক বিতর্কও— যদি বা ভ্রূণের জিন কাটা-জোড়া করে পছন্দমতো সন্তান তৈরি সম্ভব হয়, তা করা কি উচিত হবে? প্রাকৃতিক বিবর্তনের উপর তার কি প্রভাব পড়বে? ‘মানবপ্রজাতি’ বলে যাকে আমরা বুঝি, তা কি আদৌ থাকবে?

এত বিতর্কের পরেও প্রতি বছরই ‘সিএএস৯’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক থেরাপি বেড়ে চলেছে। বর্তমানে সাত ধরনের অসুখের পরীক্ষামূলক চিকিৎসা চলছে এর প্রয়োগে, তার মধ্যে রয়েছে ডায়াবিটিস, ক্যানসারও। এই প্রযুক্তিতে নৈপুণ্য এলে চিকিৎসার মোড়ই ঘুরে যাবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। তবে শান্তনু-অপালার মতো অগণিত মানুষ গবেষকদের মুখের দিকে চেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। বিজ্ঞানই পারবে তাঁদের সন্তানের অসহনীয় কষ্ট দূর করতে।

অন্য বিষয়গুলি:

Anemia gene gene therapy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE