এত নতুন গায়ক, এত নতুন ধাঁচের গীতরচনা ও সুর, কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ কেন এখনও অদ্বিতীয়? তাঁর প্রয়াণদিবসের আবহে কথাটা ভাবতে গেলে মনে হয়, ওস্তাদি কারুকাজ বা ওজোগুণ নয়, আসলে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল কতকগুলি আপাতবিরোধী উপাদানের বিরল সমাবেশ। এক দিকে ঘনীভূত অন্তর্মুখী বিষাদ ও নিরাসক্তি, সূক্ষ্ম সানুনাসিকতার আভাসে যা পেত এক চাপা অভিমানের সুর। অন্য দিকে, এই নিরাসক্তি তারুণ্যে ভরপুর, দৈনন্দিনতার ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত নয়। এ যেন এক চিরন্তন তরুণ বিবাগি। মুক্ত উদাত্ত প্রসারিত কণ্ঠ, আর একটা ঝোঁক তাঁকে ঠেলে দিত বিপরীতে, অন্তর্মুখী রহস্যে।
আসলে বাক্যন্ত্র আমাদের আচরণেরই এক সম্প্রসারণ। মানুষের কণ্ঠস্বর প্রথাসিদ্ধ বিশেষ নিয়মে বর্ণবদ্ধ হওয়ার আগেই সে স্বয়ং একটা সর্বজনীন ভাষা। আমাদের স্বরক্ষেপণেও সমস্ত দেহ জড়িত, শুধু স্বরনালি নয়। গান গাওয়ার সময়ে গায়কের পেট ও পিঠের মাংসপেশি, বুকের খাঁচা, ফুসফুস, মুখবিবর, সব সঞ্চালিত হয়। নিচু স্বরগুলি গাওয়ার সময় আলোড়িত হয় বুকের ছাতি, উঁচু স্বরে প্রতিফলিত মস্তকের কম্পন। গানের মধ্যে গায়কের ব্যক্তিত্ব অনুরণিত হয়, ধ্বনি শুধু ধ্বনি থাকে না, গায়ক স্বয়ং তাতে অনুপ্রবেশ করেন। এক উদাত্ত প্রসারণ ও তারই সঙ্গে এক গোপন বেদনা মিলে এক অভাবনীয় দ্বন্দ্ব তৈরি করত।
তাঁর প্রথম দিকে রেকর্ড করা দু’-একটি গানে— ‘জানিতে যদি গো তুমি’, ‘বলো গো বলো মোরে’—তাঁর কণ্ঠ নাসিকাসর্বস্ব, অগভীর, উচ্চারণে শহুরে পরিশীলন তখনও আসেনি। এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে তাঁর বেশি দিন লাগেনি। প্রথম দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীতে (‘পথের শেষ কোথায়’ ও ‘আমার আর হবে না দেরি’) তাঁর কণ্ঠ স্বকীয়তা পেতে শুরু করেছে। পঙ্কজ মল্লিকের গলায় জলদমন্দ্র গম্ভীরতা থাকলেও হেমন্তের বেদনাময় মাধুর্য ছিল না, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গলায় প্রসারময় একাকিত্বের আমেজ থাকলেও হেমন্তের তারুণ্য ও সজীবতা ছিল না। ক্রমে তাঁর গান পরস্পরবিরোধী উপাদানের ঠিক অনুপাত— সলিল চৌধুরীর সুরে ‘গাঁয়ের বঁধু’, ‘রানার’, ‘পাল্কি চলে’, ‘আমি ঝড়ের কাছে’, ‘আমায় প্রশ্ন করে’; এ ছাড়াও ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘আমার গানের স্বরলিপি’, মনের জানালা ধরে’, ‘এক গোছা রজনীগন্ধা’। ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায়’, ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত’, রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্ত একচ্ছত্র নায়ক। বম্বেতে করা ‘তুম পুকার লো’, ‘ইয়ে রাত, ইয়ে চাঁদনী’, ‘চুপ হ্যায় ধরতি’, ‘হ্যায় অপনা দিল’ গানে হিন্দির অপরিচিত ধ্বনিসমাবেশ হেমন্তময়, তৈরি করে বাংলা ও হিন্দির স্বতন্ত্র ভাষাচরিত্রের আনকোরা মেলবন্ধন। গানগুলিতে মহম্মদ রফির গায়কির সঙ্গে হেমন্তকুমারের শাণিত বৈষম্য। রফি তাঁর আবেগ-অনুভূতির সবটা ছুড়ে দেন বাইরে, সচেতন প্রয়াসেই। হেমন্তের কণ্ঠে তা পুরো বেরোতে পারে না, অনায়াস স্রোতে তাকে বিপরীত মুখে টেনে রাখে।
নিছক হাসির গান, খুব দ্রুত লয়ের, চটজলদি শব্দোচ্চারণের গান তাঁর কণ্ঠের উপযুক্ত নয়। মান্না দে-র ‘অভিমানে চলে যেয়ো না’, বা কিশোর-মান্নার ‘এক চতুর নার’-এর মতো রাগধর্মী পরীক্ষণে তিনি সচেতন ভাবেই আসেননি। তা বলে কি উচ্ছল বা দ্রুত লয়ের গান গাননি? ‘শোন শোন গেরোবাজ’ বেশ চনমনে গান, অনেকগুলি স্তর, প্রতিটিতে আলাদা মেজাজ, প্রতিটিতেই তিনি সফল। কিন্তু খুঁটিয়ে শুনলেই বোঝা যায়, প্রতিটি হাসির প্রকাশ, শ্লেষের স্ফুরণের নীচে বইছে এক অবদমিত বিষাদের সম্ভাবনা, যেন যে কোনও মুহূর্তে তাঁর উচ্ছলতা অনায়াসে মোড় ঘুরতে পারে বেদনায়, অভিমানে। ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’-তে উচ্ছলতা আছে, ধমক নেই, ‘দুরন্ত ঘূর্ণি’-তে দ্রুতগামিতা আছে, উদ্দামতা নেই। চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যে অর্জুনের ‘হাহা/ হাহা/ হাহা/ হাহা বালকের দল’ হেমন্তের কণ্ঠে সম্পূর্ণ দানা বাঁধে না, ‘অহো কি দুঃসহ স্পর্ধা’ বা ‘অশান্তি আজ হানলো’-তেও শৌর্য-বীর্যের প্রতিফলন শুনি না। লোকসঙ্গীতও তাঁর জন্য নয়, তাঁর উচ্চারণে ছিল স্বভাবজ পরিশীলন, নিশ্চিত নাগরিকতা। ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’-র সজল পূর্বরাগ, ‘আলতার দাগ’, ‘হাতের শাঁখা’, ‘বিনোদিনীর কুল মজানো’ শব্দগুলির গ্রাম্য অনুষঙ্গ ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর গায়কির আধুনিকতা। ‘আয় আয় আসমানী কবুতর’, সিনেমার লম্পট মাতালের গানে চরিত্রের জন্য মুখব্যাদান, স্বরক্ষেপণে শৈথিল্য, উচ্চারণে বিকৃতি সবই আনার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সব ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর কণ্ঠের স্বাভাবিক মার্জনা।
সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে বিশাল পরিসর তাঁর। কিন্তু তাঁর সুর দেওয়া ও গাওয়া একটি গানের কথা না বললেই নয়, দীপ জ্বেলে যাই ছবির ‘এই রাত তোমার আমার’। আবহসঙ্গীতে রাতের নিস্তব্ধতা ঘনীভূত হয় এক রহস্যময় অন্তিমে, তা থেকেই উঠে আসে একটা সুরের মৃদু গুঞ্জন, আরও কিছু সুর ও কথা, কিছু ক্ষণ পরেই সুরধ্বনি মিলিয়ে যায় আবহসঙ্গীতের অমোঘ কালধ্বনিতে। এ যেন গান নয়, শূন্যতা থেকে উঠে আসা এক হালকা বাতাসের আমেজ, মূর্ত আকারের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েই ফের মিলিয়ে যায় শূন্যতায়। ছবিতে যে মানব-মানবীর সম্পর্ক এ গানের উপজীব্য, সেই সম্পর্কও ওই হঠাৎ বওয়া বাতাসের মতো। এই একটি গানের মধ্যেই সুরকার হেমন্তকে চিনে নেওয়া যায়।
হেমন্তের কণ্ঠে আমরা উচ্ছ্বসিত বা উল্লসিত হই না। মুগ্ধ হই, বিষণ্ণ, বিস্মিত হই। এই বিস্ময় সদা বিপন্ন, বিপরীতের সমাবেশে তৈরি তাঁর কণ্ঠস্বর যে বড় স্পর্শকাতর, সর্বদাই ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা। তাঁর কণ্ঠের অসম্ভবের অনুপাতে সব সময় মিশে থাকত ওই সূক্ষ্ম ভারসাম্য ধরে রাখার আকুতি, সেটাই ছিল তাঁর সম্মোহনী আকর্ষণ। এই আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়, ১৯৮০ সালে হৃদ্রোগের পরে তিনি তাঁর স্বরক্ষেপণ ও শ্বাসপ্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। হেমন্তবাবু জানতেন তাঁর কণ্ঠের অসাধারণ রসায়ন, তা নষ্ট হওয়ার পূর্বাভাস ও পরিণতিও। কেমন ছিল তাঁর এই নিজেকে জানা?
দর্শন বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy