মোবাইলটা দেখুন তো, ক’টা বাজে?” রোদ চড়ছে, ডাক্তারবাবুর মেজাজও চড়ছে। চারটে ভটভটি ভ্যান ফেরিঘাটে অপেক্ষা করবে, এমনই কথা হয়েছিল পঞ্চায়েতের সঙ্গে। ওষুধ, মাস্ক, স্যানিটারি ন্যাপকিনের বস্তা তুলবে। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের পৌঁছে দেবে বানভাসি গ্রামের মেডিক্যাল ক্যাম্পে। কোথায় কী? অনেক বার চেষ্টার পর প্রধান ফোন তুলে বললেন, “ভ্যান পৌঁছায়নি? অ্যাঁ, বলেন কী?” লাল চা শেষ, আশেপাশে দোকানের সাইনবোর্ড মুখস্থ, নদীর ব্যাকগ্রাউন্ডে ফটো তোলাও সারা। সরবেড়িয়া থেকে আসা ছেলেমেয়েরা গুজগুজ করল, “তখনই বলেছিলাম, পঞ্চায়েতের সঙ্গে ক্যাম্প...।” ডাক্তারবাবু কাগজের কাপ ছুড়ে ফেলে হাঁক দিলেন, “অ্যাই, ভ্যান নিয়ে আয়। আমি ভাড়া দেব।”
হতে পারে গরিবের গাড়ি, তবু ভ্যানে বসারও প্রোটোকল আছে। সরকারি গাড়িতে বড় সাহেব ড্রাইভারের কোনাকুনি বসেন, মেজো সাহেব ড্রাইভারের পিছনে, এলেবেলেরা ড্রাইভারের পাশের সিটে। ভটভটি ভ্যানে একটু ভারিক্কিদের জন্য ড্রাইভারের দু’পাশের জায়গা বরাদ্দ— লাফায় কম, কাদার ছিটে কম। বাকিরা তিন পাশে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে, কুলোর চালের মতো ওঠা-নামা করতে করতে, গাছের ডালের ছপটি খেতে খেতে চলে। রাস্তার দু’পাশে জলবন্দি খেত, আধজাগা গাছ। জেসিবি মেশিন রাস্তা সারাচ্ছে। ভেসে-যাওয়া বাড়ি থেকে যে যা উদ্ধার করতে পেরেছেন, কংক্রিটের রাস্তার উপরে জড়ো করে, তার উপরে কালো পলিথিন টাঙিয়ে বাস করছেন। কারও সংসার ভ্যানে, কারও চৌকিতে। ত্রাণ শিবির নেই? ভ্যানের ড্রাইভার বললেন, “ফ্লাড শেল্টার? হ্যাঁ, সেখানে সবাই গিয়েছিল। এখন বাড়ির কাছাকাছি থাকছে।” ভেসে-যাওয়া বাড়িও রাতপাহারা দিতে হয় গৃহস্থকে।
আমপানের বিপর্যয়ের পরে এ বার ইয়াসে একটু যেন তৈরি ছিল সুন্দরবন। মাঝেমাঝেই দেখা গেল, রাস্তার ধারে ভটভটি ভ্যানের উপর এক জোড়া করে জলের ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই পানীয় জল মিলছে পিডব্লিউডি-র নৌকা থেকে। মেডিক্যাল ক্যাম্পে ডাক্তাররাও ডায়রিয়ার রোগী খুব বেশি পেলেন না। আশাকর্মী দিদিরা জানালেন, ডায়রিয়া কিছু হয়েছিল, তবে জল খেয়ে অত নয়, যত মরা মাছ খেয়ে। ওআরএস-এ সামলে গিয়েছে।
আর খাওয়াদাওয়া? রাস্তার মাঝখানে থলে পেতে লাইন দেখা গেল এক গ্রামে। স্থানীয় ক্লাব আজ চিঁড়ে দেবে। ডাক্তারবাবু হাঁক দিলেন, “ওরে, এখানে বাচ্চাগুলোকে কিছু দুধের প্যাকেট দে।” নার্সদিদি বললেন, “কিন্তু স্যর, সবাই বলবে আমার বাচ্চা বাড়িতে আছে।” এ বার গর্জন, “চলবে না। কেবল বাচ্চাদের হাতে দিবি।” দৃষ্টান্তমূলক নেতৃত্বের স্বাক্ষর রাখতে বস্তার মুখ নিজেই খুলে ফেললেন ডাক্তারবাবু। মিনিট দুয়েকের মধ্যে দেখা গেল, কচি হাতের পাশাপাশি শীর্ণ, শিরা-ওঠা হাতেও দুধের প্যাকেট গুঁজে দিচ্ছেন তিনি। “এদের নিউট্রিশনের অবস্থা দেখছেন?”
গত বছর সুন্দরবনের অনেকগুলো গ্রামে গণরসুই তৈরির প্রথম উদ্যোগটা বাইরে থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়েছিলেন। এ বার গোড়া থেকেই স্থানীয় উদ্যোগে হাঁড়ি চড়েছে। তবে কার হাঁড়িতে কে চাল দেয়, সে আর এক প্রশ্ন। স্কুলের দোতলায় মেডিক্যাল ক্যাম্প হবে, এক তলায় রান্না। বিশাল বিশাল গামলায় আলু পটলের স্তূপ, ঢাকাহীন মিক্সির উপর বাটি চেপে ঘড়ঘড় শব্দে পেঁয়াজ-আদা পেষা হচ্ছে। মস্ত দুটো কড়ায় মশলা সাঁতলাচ্ছেন মহিলারা, ডিমের ঝোল হবে। কাছেই থাকেন? “না না, দমদম থেকে আসছি। আজই চলে যাব।”
ব্যাপারটা কী? সবুজ পাঞ্জাবি-পরা পঞ্চায়েত প্রধান জানালেন, এ হল কলকাতার এক ডাকসাইটে বিধায়কের ‘সহায়তা’। খাবার, ত্রিপল রয়েছে— সমস্যা করছে মশা। পঞ্চায়েতই মশারি কিনে দিক না কেন? “আমাদের কেন্দ্রীয় অনুদানের (পঞ্চদশ অর্থ কমিশন) টাকা আছে, কিন্তু খরচের নির্দেশ আসেনি।” নেতার দুর্নীতি এড়াতে আমলা-নির্ভরতার এই হল ঝুঁকি। এ দিকে জমা-জলে মশা জন্মাচ্ছে, তার কামড়ে মানুষ নাকাল। ও দিকে পঞ্চায়েতের কয়েক কোটি টাকা পড়ে আছে, কিন্তু খরচের হুকুম নেই। গ্রাম পঞ্চায়েত বছরে চার-পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে, কিন্তু তিন হাজার মশারি কিনতে হাত পাতে এনজিও-র কাছে। ডাক্তারবাবুকে গালের ফোড়া দেখিয়ে প্রধান বিদায় নিলেন। সারা দিনে তাঁকে, বা তাঁর লোকজনকে আর দেখা গেল না।
তা বলে কি সরকারি ব্যবস্থার উপর গরিবের নির্ভরতা কমেছে? এক পূর্ণগর্ভা তরুণীকে পরীক্ষা করতে চাইলেন ডাক্তারবাবু। আশাকর্মী মেয়েটিকে সাহস দিয়ে শুইয়ে দিলেন বেঞ্চে। ডাক্তারবাবু যত ক্ষণ পেটে হাতের চাপ দিয়ে দেখছেন, তত ক্ষণ মেয়েটি মুঠিতে ধরে রইল আশাদিদির শাড়ির কুচি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কার্ড দেখেই ভুরু কুঁচকোলেন চিকিৎসক। “তবে যে বললেন, প্রথম বাচ্চা?” আশাদিদি ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করলেন, “স্যর, বাড়িতে জানে না।” বারো বছরের মেয়েকে বিক্রি করেছিল বাপ, অতঃপর ধর্ষণের সন্তানকে পরিবার কাকে নাকি দিয়ে দিয়েছে। বছরখানেক হল ভালবেসে বিয়ে করেছে মেয়েটি। “ব্লক হাসপাতালে বলে রেফার করে দেব কলকাতায়, আগে সিজ়ার হয়েছিল কেউ জানবে না,” আশাদিদি আশ্বাস দিলেন। মেয়েটি বাক্যহীন চেয়ে রইল। ক্লাসঘরের জানলায় শাশুড়ির মুখ। এই মেয়েটির মা, শাশুড়ি-মায়ের চাইতেও আপনজন এই বেগুনি শাড়ির স্বাস্থ্যকর্মী। সরকার তাঁকে প্রতি দিন বাষট্টিটা বাড়িতে ভিজ়িট করায়, কিন্তু কর্মীর মর্যাদা দেয় না। কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছে এই দেশ।
রোগী প্রায় সাড়ে তিনশো, চিকিৎসক চার জন। বন্যার নোনা জলে চামড়ার চুলকানিই বেশি, প্রচুর মলম লিখলেন ডাক্তাররা। সঙ্গে অ্যালার্জি, পেটের অসুখ, সর্দি-জ্বর। তবে অধিকাংশই দীর্ঘ দিনের অচিকিৎসিত রোগ। বুক ধড়ফড়, গলা জ্বালা, পায়ে খিঁচ, মাথা ঘোরা। এখানে অসুখ মানে অভাব। “সবই অপুষ্টির রোগ,” রোগী দেখতে দেখতে বললেন তরুণী শিশুবিশেষজ্ঞ।
অভাব আরও আছে। ওষুধ দেওয়ার কাউন্টারে কর্মীরা রোগীর নাম ধরে ডাকলে কেউ সাড়া দেন না। কাছাকাছি গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ফলে বার বার ডাকাডাকি চলে, এর ওষুধ চলে যায় ওর কাছে, লাইন লম্বা হয়। স্কুলশিক্ষা কেবল জ্যামিতি-ভূগোল শেখায় না— নির্দেশ পালন করতে, শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করতে শেখায়। স্কুলের ভূমিকা বহু গ্রামবাসীর জীবনে নামমাত্র বলেই হয়তো অন্যের পিছনে দাঁড়াতে বললে অস্থির হয়ে যান তাঁরা। অপেক্ষা করাকে মস্ত ঝুঁকি মনে করেন। ইস্কুলের মাঠে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলি করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হল ভলান্টিয়ারদের। কিশোরীদের ঠেলে প্রৌঢ়ারা এগিয়ে আসেন, বৃদ্ধারাও শোরগোল জুড়ে দেন। এক বছর দশেকের বালকও হাত পেতে দাঁড়িয়ে গেল। এ-ও এক শিক্ষা। এই ত্রস্ত ঠেলাঠেলিতেই ত্রাণের রাজনীতির জন্ম।
ফেরার ভ্যান ডেকে আনা হল। অমনি উদয় হলেন পঞ্চায়েতের দুই মূর্তি। “সকালে নিজেরা গাড়ি ডেকে চলে এলেন, আমাদের ভ্যান তার পর গিয়েছিল। তাদের টাকা দিতে হয়েছে। ফেরার গাড়িও বলা ছিল। আপনারা ভ্যান ডাকলেন কেন?” ডাক্তারবাবু বললেন, “আমরা পিকনিক করতে এসেছিলাম, ফিরে যাচ্ছি।” ভটভট শব্দে, কাটা তেলের গন্ধে আমোদ করে ছেড়ে দিল ভ্যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy