এক ডজন বছর ধরে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার লিঙ্গবৈষম্য পরিমাপক প্রতিবেদনে লাগাতার প্রথম স্থানে আছে আইসল্যান্ড। রাষ্ট্রপুঞ্জের লিঙ্গ-অসাম্য সূচকেও ছবিটা একই রকম— বিশ্বের সর্বাধিক লিঙ্গনিরপেক্ষ দেশগুলির মধ্যে আইসল্যান্ড বরাবরই প্রথম পাঁচে। এই সাফল্যের রহস্য কী? ভারতের মতো যে দেশগুলি লিঙ্গসাম্যের নিরিখে বিশ্বে শেষ পনেরোতে, তাদের জন্য এই সাফল্যের রহস্যোদ্ঘাটন বিশেষ জরুরি।
আইসল্যান্ডের এই সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার। যে শিক্ষাব্যবস্থা আইন করে ২০০৮ সাল থেকে ‘লিঙ্গসমতা’ নামক একটি বিষয়কে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকেই পাঠ্যসূচির অন্তর্গত করেছে। ইউনিভার্সিটি অব আইসল্যান্ড-এর অন্তর্গত সেন্টার ফর রিসার্চ অন ইক্যুয়ালিটি, জেন্ডার অ্যান্ড এডুকেশন-এর কাজই হল, শিশুরা লিঙ্গসমতা বিষয়ে কত দূর শিখল তার ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা, এবং যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিষয়টি শিশুদের পড়াবেন, তাঁদের বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞান ও চিন্তাভাবনার উপরে নজর রাখা। পরবর্তী কালে, ২০১১ সাল থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এই সমতার বিষয়টিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় ও আইসল্যান্ডের জাতীয় শিক্ষাক্রমের ছয়টি মূলস্তম্ভের অন্তর্গত করা হয়।
আইসল্যান্ডের বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রতি দিন নানা রকম কঠোর শারীরচর্চা করানো হয়— কখনও ভোরবেলা খালি পায়ে বরফের উপরে হাঁটানো হয়, কখনও লাগাতার হাই জাম্প। শেখানো হয় মাটি-কাটা, পাহাড়ে চড়া ইত্যাদিও। অন্য দিকে, ছাত্রদের দেওয়া হয় সহমর্মিতার, সমব্যথী হওয়ার ও আবেগপ্রবণতার পাঠ। কী ভাবে গুছিয়ে সংসার করতে হয় ও শিশুর যত্ন নিতে হয়, তা শেখানোর জন্য তাদের পুতুল খেলতে উৎসাহী করা হয়। কী ভাবে সবাইকে খাবার বেড়ে দিতে হয়, কী ভাবে সমান ভাবে ভাগ করে খেতে হয়, শেখানো হয়।
লিঙ্গসমতার শিক্ষায় ছাত্র ও ছাত্রীদের এমন অসম শিক্ষার আয়োজন কেন? আইসল্যান্ড বুঝেছে যে, পিতৃতন্ত্রের তৈরি করা লিঙ্গ-পরিচিতির খাঁচার অভ্যাস মানবসভ্যতার অস্থিমজ্জায় প্রসারিত হয়ে, নারী ও পুরুষের পৃথক ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, মেয়েদের ‘মেয়েলি’ গুণাবলি বা ছেলেদের ‘পুরুষালি আচরণ’ আলাদা করে আর শেখাতে হয় না; ইতিহাস, পরিবার, সমাজ তাকে পদে পদে এ-শিক্ষা এমন ভাবে দিতে থাকে যে, তার ব্যক্তিচেতনা এই বাঁধাধরা গতের বাইরে বেরোতেই পারে না। আজকের দিনেও সমাজ বলে দেয়, ‘মেয়েদেরই মানিয়ে নিতে হয়’ আর ‘ছেলেদেরই বৃদ্ধ বাবা মা-র দায়িত্ব নিতে হয়’। নারীর ‘সম্মান’ আজও বিষম বস্তু; ধূমপান থেকে ধর্ষণ— কখন কিসে যে খোয়া যায়, বলা মুশকিল। পুরুষেরও জ্বালা কম নয়। স্বপ্ন দেখার আগেই তাকে সফল হওয়ার অঙ্ক কষতে হয়; যার হিসেব মেলে কেবল মোটা অঙ্কের মাইনেয়।
আইসল্যান্ড জানে, মানুষের সভ্যতার মতোই প্রাচীন এই ভিন্নমুখী নারী ও পুরুষ চরিত্রায়ণের পরিবর্তন সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক, সুচিন্তিত, নিরবচ্ছিন্ন এবং ব্যতিক্রমী শিক্ষণ পদ্ধতি। এবং তার সূচনা হতে হবে প্রাথমিক স্তরেই। বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থা, নবীন মনকে গতানুগতিকতার কারাগারে আবদ্ধ করার আগেই, তাতে লিঙ্গসমতার আলোক প্রবেশ করাতে হবে; একদম প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে।
নারী ও পুরুষের আরোপিত সামাজিক অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই আইসল্যান্ডের লিঙ্গসমতার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তবে শুধু শিক্ষাপ্রদানেই নয়, লিঙ্গসমতার প্রতিফলন এ-দেশের নিয়মনীতি, আইন-কানুন, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট জুড়েও। যেমন, সন্তান জন্মানোর বা দত্তক নেওয়ার পর আইসল্যান্ডে সব মিলিয়ে বারো মাসের ছুটি পাওয়া যায়। কিন্তু সে ছুটি সন্তানের পিতার জন্য ধার্য থাকে ছয় মাস ও মাতার জন্যও ধার্য থাকে ছয় মাস। আবার প্রয়োজনে পিতা বা মাতা যে কেউ, অপর জনকে নিজের ছুটির এক মাস দিয়ে দিতে পারেন। আইসল্যান্ডের ছুটির এই নিয়ম বলে দেয় যে, সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব শুধু মায়ের নয়। স্বীকার করে যে, সন্তানসান্নিধ্য পাওয়ার বাসনা পিতারও থাকে।
গত কয়েক শতক ধরে বিশ্ব জুড়েই লিঙ্গসমতার গুরুত্ব আলোচনা হচ্ছে। তবে আইসল্যান্ড বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে, তার জন্য ইতিমধ্যেই বহু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করে নিয়েছে। আজকের দিনে সারা বিশ্ব যখন লিঙ্গভিত্তিক অসম বেতন ব্যবস্থার বিষয়টি নিয়ে সবে নড়েচড়ে উঠেছে, সেখানে ২০১৮-র গোড়াতেই আইসল্যান্ড আইন করে সারা দেশে সমবেতন নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে, নীতি লঙ্ঘনে কঠোর শাস্তিও ধার্য করেছে। পাশাপাশি সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে বা সমিতিতে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ পদ মহিলাদের জন্য বরাদ্দ করেছে। ভারতবর্ষের মতো যে-সকল দেশে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হারই সাকুল্যে ২০%, তাদের জন্য এই পরিসংখ্যান বিশেষ অর্থবহ।
লিঙ্গসমতা প্রসঙ্গে আমরা নারীশিক্ষার কথা বলি। ঠিকই। কারণ, শিক্ষাই সমতার ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু এ দেশের স্কুল-শিক্ষায় লিঙ্গসমতার শিক্ষা কোথায়? সে শিক্ষা ছাড়া, এ দেশের শিক্ষিত মেয়েরা সমতার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে কি? বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা তো তাদের পিছিয়ে থাকতে, মানিয়ে নিতে আর অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেই শিখিয়েছে।
অথচ, এই সাম্য যতটা নারীর জন্য প্রয়োজনীয়, ততটাই কিন্তু প্রয়োজনীয় পুরুষের জন্যও। ১৯৪৯ সালে সিমন দ্য বোভোয়া-র দ্য সেকেন্ড সেক্স মুক্তি পেলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনা করেন বোভোয়ার প্রিয় বন্ধু অ্যালবেয়র কামু-ও। তবে, সঙ্গে বোভোয়াকে একটি প্রশ্নও করেন তিনি। বলেন, “লিঙ্গ-অসাম্যের কুফল কি পুরুষকেও ভুগতে হয় না? মেয়েদের পিছিয়ে রাখলে দুই অসম ব্যক্তি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। অসম জীবনসঙ্গী নিয়ে কোন পুরুষই কি বিবাহিত জীবনে প্রকৃত সুখী হতে পারে বলে মনে করো?”
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy