১৫ জুলাই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট র্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক-এর (এনআইআরএফ) ক্রমতালিকা প্রকাশ হল। পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীরা নিজ নিজ রাজ্যের সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌ কি পাটিগণিত মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমন র্যাঙ্কিং সম্ভব? তার মধ্যে কি গভীরতর কোনও ছক রয়েছে? কেউ বলতে পারেন, সিনেমার যদি সেরা দশ হতে পারে, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়েরই বা হবে না কেন? এর সঙ্গে রয়েছে নব্য-উদারবাদী যুক্তি— যে আদর্শে যে কোনও সংস্থানের বিচার একমাত্র বাজারি হিসাবরক্ষণের মাপদণ্ড দিয়ে করা সম্ভব। যে প্রতিষ্ঠানের যত র্যাঙ্ক, তার দৃশ্যমানতা তত বেশি। সেখানে পৌঁছতে পারার আকাঙ্ক্ষা তখন ‘প্রেস্টিজ ইকনমির’ একটা অংশ হয়ে পড়ে। শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ মিশেল স্ট্যাকের ভাষায়, এই আকাঙ্ক্ষা এক প্রকারের রাজনৈতিক শ্রম, ‘আমি সেরা’ বলতে পারার আত্মশ্লাঘা জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে।
২০০৩ সালে শাংহাইয়ের জিয়াও টং বিশ্ববিদ্যালয় চিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে বাজারি ধাঁচে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য একটি র্যাঙ্কিং পদ্ধতি তৈরি করে, যার নাম শাংহাই র্যাঙ্কিং। ২০০৪ সালে ব্রিটেনে এক সরকারি রিপোর্টে স্যর রিচার্ড ল্যাম্বার্ট বললেন, বেসরকারি ক্ষেত্রের উচিত এগিয়ে এসে বিশ্বের সেরা গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি ‘লিগ টেবিল’ তৈরি করা। ল্যাম্বার্ট একাধারে দ্য ফাইন্যানশিয়াল টাইমস-এর প্রাক্তন সম্পাদক ও ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড-এ আর্থিক নীতির প্রণেতা। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দু’টি বৃহৎ কোম্পানির জুটিতে ২০০৪ সালে গঠন হয় কিউএস-টিএইচই র্যাঙ্কিং। দ্বিতীয় সংস্থাটি, অর্থাৎ টাইম হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) ২০০৯ সাল থেকে তাদের নিজস্ব র্যাঙ্কিং প্রকাশ করাও শুরু করে। এই তিনটি র্যাঙ্কিং পদ্ধতি এখন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। এতটাই যে, এ বছরের জুন মাসে যখন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের ভাইস চ্যান্সেলর ও ডিরেক্টরদের সঙ্গে অধিবেশন হয়, সেখানে অতিথি হিসেবে ছিলেন কিউএস-এর সিইও, নানজিয়ো কোয়াকারেল্লি!
২০১৩ সালে টিএইচই-র মালিকানা বদল হয় ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে। ক্রেতা এক আমেরিকান প্রাইভেট ইকুইটি ফার্ম। ২০১৯ সালে তা আবার হাতবদল হয়। সামান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার পিছনে এত বিনিয়োগ? টমসন রয়টার্সের মতন বৃহৎ মিডিয়া সংস্থান, অথবা এলসেভিয়ারের মতো প্রকাশনী তথা ইনফর্মেশন অ্যানালিটিক্স সংস্থাই বা র্যাঙ্কিং তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে উৎসাহী কেন? উত্তর সহজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং এক বৃহৎ ব্যবসা। সাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাণিজ্যিক কাজকর্মকে আধুনিকীকরণের নামে ‘মনিটাইজ়’ করার আর একটি দিক র্যাঙ্কিং। যেমন, বিনি পয়সায় শিক্ষার তথ্য মাইন করে সেটাই প্যাকেজ করে বিক্রি করা হয় ‘বেঞ্চমার্কিং টুলস’ হিসেবে। নতুন বাজারের খোঁজে নিত্যনতুন র্যাঙ্কিং হয়— এশিয়া, লাটিন আমেরিকা, ‘ব্রিক্স অ্যান্ড ইমার্জিং ইকনমিজ়’। খবরের কাগজ পড়ে সাধারণ মানুষও জানতে চান— আমরা কবে সেরা হব?
অনেক দেশ চিনের পথে হেঁটে জাতীয় র্যাঙ্কিং তৈরি করেছে। ভারতে উচ্চশিক্ষা বিগত দুই দশক ধরে নব্য-উদারীকরণের পথে। সেই ২০০১ সালেই অম্বানী-বিড়লা রিপোর্টে উচ্চশিক্ষায় নিয়মকানুনের রাশ আলগা করা ও ‘ইউজ়ার পেস’ নীতিতে টিউশন ফি বৃদ্ধির পক্ষে সওয়াল করা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে ভারত সরকার গ্যাটস-এর ছত্রছায়ায় উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগের প্রস্তাবও দিয়ে আসে। এর পর ধাপে ধাপে নাক মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; এসেছে ‘গ্রেডেড’ স্বশাসনের মতো বিতর্কিত প্রস্তাব। ২০১৬ সালে যেমন এনআইআরএফ চালু করা হয়, তেমনই চালু হয় ইউজিসি (ওয়ার্ল্ড-ক্লাস ইনস্টিটিউশনস ডিমড টু বি ইউনিভার্সিটিজ়) বিধি। ২০১৭ সালে তার নাম পাল্টে হয় ‘ইনস্টিটিউশনস অব এমিনেন্স’। উদ্দেশ্য, এক দিকে কিছু সম্ভাবনাময় বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিয়ে তাদের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের পথে ফাস্ট ট্র্যাক করা; অন্য দিকে এনআইআরএফ-এর মাধ্যমে বাজারি ধাঁচে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি ও জনমানসে র্যাঙ্কিংয়ের চাহিদা তৈরি করা।
শিক্ষানীতির কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলে এখানে একটি শব্দবন্ধনী দেখা যায়: অর্থনৈতিক স্বশাসন। ইনস্টিটিউশনস অব এমিনেন্স-এর ক্ষেত্রে যেমন বলা হচ্ছে, এই সংস্থানগুলির অর্থনৈতিক স্বশাসন-সহ সম্পূর্ণ স্বশাসন থাকবে, থাকবে ‘বিকল্প’ (সরকার নয়) সূত্র থেকে টাকা তোলা ও খরচ করার স্বাধীনতা। সরকার তাদের একটি ‘কর্পাস ফান্ড’ দেবে ঠিকই, তবে ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস’ হওয়ার বাকি খরচটা তুলে নিতে হবে অন্য ভাবে। ২০১৬ সালের সুব্রহ্মণ্যম কমিটি রিপোর্ট এ ব্যাপারে আরও পরিষ্কার। কমিটির মতে, জাতীয় অ্যাক্রেডিটেশনে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বেতন-সহ সমস্ত বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বশাসন দেওয়া হবে। উৎকর্ষের সঙ্গে স্বশাসনের একটি ইতিবাচক সম্পর্ক থাকবে। তার সঙ্গে এই মান বজায় রাখার দায়িত্বও থাকবে। ও দিকে অ্যাক্রেডিটেশনে ফল খারাপ হলে ঝাঁপ বন্ধ করার নোটিসও দেওয়া হবে। অর্থাৎ, ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠন ও লালন-পালন করার খরচের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসবে উপভোক্তা-রূপী ছাত্রদের কাছ থেকে, সরকারের থেকে নয়। থাকবে ‘নিড-বেসড’ বৃত্তি, তবে সরকারি ভর্তুকি-প্রাপ্ত সবার জন্য কম খরচে উচ্চশিক্ষার যে বর্তমান মডেল, তার সুবিধা অন্তত ‘সেরা’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া যাবে না। বাকিদের জন্য শিক্ষাঋণের সুযোগ তো রয়েছেই।
আগামী বছরও ঘটা করে এনআইআরএফ র্যাঙ্কিং প্রকাশ হবে। আমরাও উচ্ছ্বসিত হব নিজেদের প্রতিষ্ঠান সেরা হলে। আমেরিকার ছাত্রঋণ সঙ্কট বা ভারতের বেকারত্ব সমস্যা, এই অশনিসঙ্কেত দেখেও আগামী প্রজন্মের ঘাড়ে ‘ওয়ার্ল্ড-ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে তো?
ইংরেজি বিভাগ, গুরুদাস কলেজ, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy