Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
75th Independence Day

শুনলাম, কী বলছে এই ছোটরা

পিয়ালির ছোটরা স্বাধীনতা ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করছে, মাটিতে নামিয়ে আনছে।

রংগন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২১ ০৫:০৮
Share: Save:

আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না...” রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো আমরা অনেকেই জানি। মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁকেও আমরা এই অভ্যাসেরই অংশ করে ফেলেছি। আজ তিনিও শুধু ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণ। আর এই কথাটাকেই আর একটু এগিয়ে নিয়ে বলা যায়, আমাদের স্বাধীনতার উদ্‌যাপন আর পালনও যেন আজ শুধু ১৫ অগস্ট আর ২৬ জানুয়ারি।

কলকাতার দক্ষিণে মাইল সত্তর গেলেই পিয়ালি। মূলভূমির মধ্যেই। সুন্দরবন এলাকা হলেও দ্বীপ নয়। পিয়ালির নাম না জানলেও অনেকেই আমরা হয়তো চম্পাহাটির নাম জানি। পিয়ালি তার কাছেই। যাঁরা পিয়ালিতে সমাজ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা বলেন, পিয়ালি-চম্পাহাটি-বারুইপুর অঞ্চলের একটা বৈশিষ্ট্য হল সুন্দরবনের নানা প্রান্ত থেকে জল-ঝড়-বন্যা নানান কারণে বহু মানুষ পিয়ালিতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলা ভাষার একটা রূপক প্রয়োগকে আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করে বলা যায়, পিয়ালি মানুষকে পায়ের তলায় জমি দিয়েছে। এ বারের ১৫ অগস্ট পিয়ালিতে কিছু বয়ঃসন্ধির আর তাদের চেয়ে আরও ছোট কিছু ছেলেমেয়ের স্বাধীনতা পালন অনুষ্ঠান দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের এই অঞ্চলের এই মাটির ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে তারা যেন স্বাধীনতাকে জমি দিতে চাইছে, তাদের ধারণার দেশ-জীবনে। কেবল হাওয়ায় পতাকা না উড়িয়ে তারা স্বাধীনতার জমিনে দাঁড়াতে চাইছে।

ঠিক কী বলছে এই ছোটরা? তাদের স্বাধীনতা দিবসের পদযাত্রায় তারা বয়ে নিয়ে চলেছে নানান পোস্টার। তার কোনওটাতে লেখা, “মেয়েরা রাত করে বাড়ি ফিরলে তাদের চরিত্র নিয়ে কথা হয়, ছেলেরা রাত করে বাড়ি ফিরলে কেউ কিছু বলে না কেন?” প্রশ্নটা নতুন নয়। হয়তো আমাদের বুড়োদের মনে পড়বে সেই কোন ১৯৭৯ সালে যখন আমাদের স্বাধীনতার বয়স ছিল ৩২, তখন একদিন প্রতিদিন ছবিতে মৃণাল সেন এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছর বয়স, “উত্তর মেলে না।” আর একটা পোস্টার বলছে “শিশু কেবল শিশুই হয়/ কন্যাশিশু গর্ভে এলে জানতে কেন ইচ্ছে হয়?/ কন্যাশিশু জানতে পারলে অত্যাচার কেন হয়?”

আমাদের বড়দের স্বাধীনতা দিয়ে এর উত্তর দিতে পেরেছি কি? এই প্রশ্নগুলো কিন্তু বই থেকে নামানো নয়, জীবন থেকে ওঠা। একটি মেয়ে তার দুই বোনকে নিয়ে যাচ্ছিল। একটি ছেলে তাদের দেখে বলল, “সব ক’টা মালই ভাল।” মেয়েটি তাকে বলল, “মাল বললে কেন?” প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়ায় অনভ্যস্ত ছেলেটি একটু থতমত খেয়েই বলল, “না মানে সুপুরি কিনছিলাম, বলছিলাম, সুপুরিগুলো ভাল।” কিন্তু তার সুপুরির বস্তার মুখ ছিল বন্ধ! ব্যাপারটা আর বেশি দূর না গড়ালেও পোস্টার হল: “মাল বলতে বস্তু বুঝি, মেয়েরা তবে মাল কেন?” সেই মিছিলে মেয়েটি এই পোস্টার নিয়ে হাঁটল, তার পর বলল, “পোস্টার অনেকে পড়ছিল, বেশ ভাল লাগছিল।” বেদখল জমির খুঁটি কি একটু নড়ল?

এই মিছিলে নেতাজি, ক্ষুদিরামের পাশাপাশি কল্পনা দত্ত, মণিকুন্তলা সেন, বীণা দাসের মতো জাতীয় আন্দোলনের নেত্রীদের ছবিও বয়ে নিয়ে চলেছিল ছেলেমেয়েরা। ছিল সৈয়দা মনোয়ারা খাতুনের ছবি, যিনি ১৯১০-২০’র সময়ে যখন মেয়েদের বাইরে বেরোনোই ছিল সংগ্রাম, তখন মেয়েরা কী রকম ভাবে স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেওয়ার লড়াই লড়ত, সে কথা লিখেছিলেন। ছোটরা মাইকে সে কথা বলছিল আর বলছিল, “আমাদের জীবনে নানান পরাধীনতার কথাও আমরা বলব।” দুনিয়ার রাজনীতির ইতিহাসে আমরা অনেক সময় ‘অসমাপ্ত বিপ্লবের’ কথা বলি। নিজেদের মতো করে এই ছোটরাও সে কথাই বলছিল?

এই যাত্রায় কেবল মেয়েরাই ছিল না। কিছু ছেলেও ছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলছিল, ‘মেয়েলি ছেলে’ বলে, পাড়ায়, পরিবারে তাদের নানান ঝামেলা। শুনে মনে পড়ল, ক’দিন আগে কলকাতায় একটি ছেলে, চমৎকার লেখে, একটা কাজের জন্য এসেছিল। কী সহজ ভাবে বলছিল, সে মেয়েলি বলে ছোটবেলায় পুরুষালি কাজ়িনরা তাকে ইলেকট্রিক শক খাওয়াত। এই নিয়ে ওর মায়ের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

লেখার সময়, মাথার ভিতরে একটা সমালোচনা শুনতে পাই: “আবার সেই জেন্ডার?” তবে এখন আর এই নিয়ে সঙ্কোচ হয় না। অনেক মাঠে ঘাটে ঘুরে, নিজেদের আলমারিতে অনেক কঙ্কাল দেখে এখন বুঝে গিয়েছি, জেন্ডার নিয়ে এত ভয় কেন? আমাদের ক্ষমতার আর রাজনীতির কাঠামোটা এতটাই পিতৃতান্ত্রিক যে, শ্রেণি-অসাম্যের কথা বা সম্ভাব্য সাম্যের কথা জেন্ডার বাদ দিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। পিতৃতন্ত্রকে কেবল মেয়েদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার গল্প বলে দেখলে সমাজের সব রকমের পরাধীনতায় বা অসাম্যে এর মূল ভূমিকা পুরোটা বোঝা যাবে না। জেন্ডার সব রকমের প্রাধান্য আর প্রান্তিকতার গোড়ার গল্প। পৌরুষকেই প্রধান এবং বাকিগুলোকে তার তুলনায় নিকৃষ্ট শারীরিক এবং মানসিক অবস্থান বলে চিহ্নিত করার গল্প। এর থেকেই নানান পরিচয়ের মধ্যে অসাম্যের ধারণা উৎপন্ন এবং বিস্তৃত হয়। সামাজিক হিংস্রতার গল্প তৈরি হয়। এই কারণেই শ্বেত সন্ত্রাসের পাল্টা আমরা লাল সন্ত্রাস দেখি, অন্য সামাজিক ভাষার সম্ভাবনা তৈরি হয় না। কিন্তু জেন্ডার নিয়ে প্রশ্ন মানে নিজেকেই প্রশ্ন করা, নিজের দিকে আঙুল তোলা, “আমরা কারা সর্বহারা” বলে সহজে পার পাওয়া যাবে না। তাই এত রাগ।

আশা এটাই— পিয়ালির ছোটরা স্বাধীনতা ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করছে, মাটিতে নামিয়ে আনছে।

অন্য বিষয়গুলি:

75th Independence Day Gender Identity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE