সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের মননে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল সমাজচেতনা। তাঁর লেখায় বার বার দেখতে পাই সংস্কারমূলক নানা ভাবনা। রবীন্দ্রনাথের সমাজ পরিবর্তনের ধারণা ছিল অত্যন্ত মানবিক। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের, তাঁর চিন্তায় তা বেশ স্পষ্ট। সাধারণ মানুষের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তিনি আর্থ-সামাজিক সংস্কারের কাজে নিজেকে যুক্ত করেন, কৃষি উন্নয়ন, কুটির শিল্পের প্রসার-সহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজে নিত্যনতুন চিন্তা ও অর্থের সম্মিলন ঘটান। এই কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন।
তাঁরই ভাবনার অনুসরণে পরবর্তী কালে গঠিত শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী সমিতি সমগ্র এলাকাকে কয়েকটি মণ্ডলে ভাগ করে সমবায়-ভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করেছিল। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হয় ছোট ছোট স্বনির্ভর গোষ্ঠী, যারা কুটিরশিল্প-সহ বিভিন্ন বাস্তব-ভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান ও সর্বাঙ্গীণ আর্থিক উন্নতি সাধনের চেষ্টায় রত হয়। ১৯০৪-এ লেখা ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই সার্বিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। বর্তমানে ‘সেল্ফ হেল্প গ্রুপ’-এর যে মডেল আমরা অনুসরণ করি, শান্তিনিকেতনে বহু আগেই সেই ধারণার সূত্রপাত।
কবি তাঁর আর্থ-সামাজিক চিন্তাভাবনার বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে ছিলেন খুবই উদ্যমী। রাশিয়া ভ্রমণের সময়ে লেখা রাশিয়ার চিঠি-তে লিখেছিলেন, “আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি, এরা সমস্ত দেশজুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে। আমাদের কর্মীরা যদি কিছুদিন এখানে এসে শিক্ষা করে যেতে পারত, তাহলে ভারি উপকার হত।” তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনও পরিকল্পনার কার্যকারিতার জন্য চাই যথাযথ প্রশিক্ষণ। জনসাধারণের উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে তাঁর চিন্তা যে কত মৌলিক ছিল, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কালান্তর প্রবন্ধ-সঙ্কলনের বহুপঠিত প্রবন্ধ ‘লোকহিত’। প্রকৃত অর্থেই যুগান্তকারী এই রচনায় তিনি জনহিত ও সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে এমন কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, যা এই একুশ শতকেও আমাদের সমান প্রভাবিত করে।
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, ভারতের উন্নতিকল্পে মূল প্রয়োজনটা আসলে গ্রামীণ উন্নয়নের। তাই তিনি হয়ে ওঠেন শান্তিনিকেতনের সমবায়-ভিত্তিক পল্লি-উন্নয়ন কর্মসূচির পুরোধা। মহাজনের হাত থেকে দরিদ্র কৃষক কারিগরদের রক্ষা করে স্বনির্ভর করে তোলার পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার, কৃষকের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা, দরিদ্র কৃষকদের মহাজনি ঋণের জাল থেকে বার করে আনার মতো উদ্যোগ করেছিলেন। সমবায় গঠন করে আর্থিক সুরাহার যে পথ দেখিয়েছিলেন, তাতে ধরে নেওয়া যায়, বর্তমান কালের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের জন্মসূত্র এখানেই। সেই মডেলেরই বহু-পরীক্ষিত আধুনিক রূপ এখনকার মাইক্রোফিনান্স।
গ্রামাঞ্চলে কৃষির পাশাপাশি শিল্পকেও তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই শ্রীনিকেতনে কৃষি ভবনের পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন শিল্প ভবন। বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়ন খুব জরুরি, সে কারণেই তিনি শ্রীনিকেতনে কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্রশিল্পের প্রসারে বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ করেছিলেন— বয়ন ও কারুশিল্প, চামড়া শিল্প, বাঁশ ও বেতের কাজ, এ রকম আরও অনেক।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, সমাজের আর্থিক সংস্কার বাস্তবায়নের প্রাথমিক উদ্যোগ রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিবার থেকেই শুরু করেছিলেন। বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজের ছেলেকে অক্সফোর্ডে না পাঠিয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন, পরে জামাতা ও আর এক বন্ধুপুত্রকেও। ভারতীয়দের অক্সফোর্ডে গিয়ে ‘উন্নত ভদ্রলোক’ হওয়ার থেকে ইলিনয় গিয়ে ‘উন্নত কৃষক’ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, বলতেন এমনটাও।
ছাত্র-ছাত্রীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বা ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’-এর কৌশলও শেখাতে চেয়েছিলেন তিনি, যাতে ক্রমে সমাজের সব স্তরের মানুষের একটা সার্বিক সামাজিক ও আর্থিক অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব হয়। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে আজ আমরা যখন গ্রামীণ প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে পৌঁছে যাই ও নিয়মিত আর্থিক সহায়তার মধ্যে দিয়ে সেখানকার মানুষের সামাজিক উত্তরণের সাক্ষী হই, তখন আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে পারি রবীন্দ্রনাথের সমাজচেতনা কত যুগোপযোগী ছিল।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy