Advertisement
E-Paper

মাটিতে পা রেখে সত্যসন্ধান

এ বারের ভোট আর একটি বিভাজন স্পষ্ট করে দিয়েছে— প্রথাগত, প্রাতিষ্ঠানিক, বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সমাজমাধ্যম, বিশেষত ইউটিউব-নির্ভর ছোট মাপের সংবাদমাধ্যমের বিভাজন।

সুজিষ্ণু মাহাতো

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২৪ ০৮:৪৪
Share
Save

বিভাজন, মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে এ বারের লোকসভা ভোটে জনতার একটা বড় অংশ রায় দিয়েছে। সেই সঙ্গেই এ বারের ভোট আর একটি বিভাজন স্পষ্ট করে দিয়েছে— প্রথাগত, প্রাতিষ্ঠানিক, বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সমাজমাধ্যম, বিশেষত ইউটিউব-নির্ভর ছোট মাপের সংবাদমাধ্যমের বিভাজন। কোনও প্রতিষ্ঠানে কাজ না করে বহু সাংবাদিক স্বাধীন ভাবে এই ভোটের খবর করেছেন। তাঁরাও দ্বিতীয় গোত্রের, অর্থাৎ ইউটিউব-নির্ভর সংবাদমাধ্যমেরই অংশ।

এই বিভাজনের একটা বড় কারণ জনসাধারণের কাছে, আমজনতার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তুঙ্গ সাফল্য পাওয়া বিজেপির বিরুদ্ধে যে এ বার দেশের নানা জায়গায়, নানা বিষয়ে ব্যাপক ক্ষোভ জমেছে, প্রথাগত টিভি চ্যানেল বা অন্য মাধ্যমে প্রচারিত খবর দেখলে তার আঁচ তেমন মেলেনি। এ বার সংসদে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়িয়ে বহু দূর চলে যাওয়ার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, তা প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের দ্বারা আমজনতার কাছে এসেছে। সেই ঘোষণা এক বার নয়, বার বার সম্প্রচারিত হয়েছে। যা তেমন হয়নি, তা হল এই দাবির যৌক্তিকতা কতটা, বা মাটির বাস্তবতা কী বলছে?

প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের বাইরে দেশ জুড়ে থাকা, স্থানীয় ভাবে কাজ করা বহু ইউটিউব-নির্ভর সংবাদমাধ্যম থেকে অবশ্য জানা যাচ্ছিল যে, ‘চারশো পার’-এই বাতাবরণের বাইরে বাস্তবে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভের স্রোত আছে। সেই স্রোত ফল্গুধারার মতো গোপন নয়, যথেষ্ট প্রকট। ধর্মীয় আবেগ চাপা দিতে পারছিল না মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের মতো বিষয় নিয়ে তৈরি হওয়া সেই ক্ষোভকে। কিন্তু সেই বাস্তব ২৪ ঘণ্টার খবরের চ্যানেলের পর্দায় তেমন ভাবে উঠে আসেনি। তাই একটা বড় অংশের দর্শক প্রথাগত সংবাদমাধ্যম থেকে সরে গিয়ে ইউটিউব-নির্ভর সাংবাদিকদের কথা শুনেছেন। তার প্রমাণ ইউটিউবে পরিচিত সাংবাদিকদের আপলোড করা ভিডিয়োগুলির দর্শকের বিপুল সংখ্যা থেকেই পাওয়া যায়।

ইউটিউবার ধ্রুব রাঠী মাস তিনেক আগে একটি ভিডিয়ো আপলোড করেন, যার বিষয় ছিল, ‘ভারত কি একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে?’ ভোট শেষ হওয়ার মুখে সেই ভিডিয়োর ভিউ আড়াই কোটি ছাড়িয়ে যায়। ধ্রুবকে সাংবাদিক বলা যাবে না। কিন্তু যে কারণে ধ্রুবের ভিডিয়ো এমন প্রবল ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই কারণ ইউটিউব-নির্ভর জনপ্রিয় সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও সত্যি। তা হল, প্রশ্ন
করার অভ্যাস। শাসকের দাবিকে প্রশ্ন না করে, যুক্তিজালে বিশ্লেষণ না করে কেবল বারংবার সম্প্রচারের কারণেই হয়তো প্রথাগত সংবাদমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়েছেন বহু দর্শক। তাঁরা ভিড় জমিয়েছেন, ভিউ বাড়িয়েছেন স্বাধীন সাংবাদিকদের ইউটিউব চ্যানেলে।

প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচারের বেশির ভাগটা এ ভাবে শাসককেন্দ্রিক হওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারাও পাল্টা কৌশল নেন। কয়েক মাস দীর্ঘ ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কোনও প্রথাগত সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেননি। দিয়েছেন ইউটিউবারদের। ভোটের ফল বেরোনোর পরেও বিরোধী পক্ষের বহু নেতানেত্রী সংবাদমাধ্যমকে প্রকাশ্যে কটাক্ষ করেছেন। ফল বেরোনোর ঠিক আগে সম্প্রচারিত বুথফেরত সমীক্ষার হিসাবও প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জমি তৈরি করে দিয়েছে। কারণ, ইউটিউব-নির্ভর বহু সাংবাদিকই যে সমীক্ষা করেছিলেন, সেগুলি ছিল বিখ্যাত সংস্থাগুলির করা সমীক্ষার উল্টো। ফল বেরোনোর পর দেখা গিয়েছে, সেগুলিই বাস্তবের সবচেয়ে কাছাকাছি।

দেশের অন্য কোনও রাজ্য নয়, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গই বুথ ফেরত সমীক্ষা ভুল প্রমাণ হওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রাজ্যে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে নানা বিষয় নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের কথা ন্যায্য কারণেই সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু তার আড়ালে জনতার একটা বড় অংশ কোন কারণে রাজ্য সরকারকে সমর্থন করছে, তার স্পষ্ট আঁচ মেলেনি। এর একটা বড় কারণ পেশায় লিঙ্গ-অসাম্যও। শুধু বাংলাতেই নয়, সারা দেশে ব্লকে, জেলায় যে সব সাংবাদিক দৈনন্দিন মাটির কাছাকাছি থেকে কাজ করেন তাঁদের মধ্যে পেশাদার হিসেবে সংখ্যায় নারীরা অনেক পিছিয়ে। তাই যেখানে রাজ্যের ভোটারের প্রায় অর্ধেক মহিলা, সেই মহিলারা কী চাইছেন, কী পাচ্ছেন, কী ভেবে ভোট দিচ্ছেন, সেই চিন্তার পরিসর হয়তো পুরুষপ্রধান সংবাদমাধ্যম আঁচই করতে পারেনি। জিনিসের দাম নিয়ে ক্ষোভ, লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রাপ্তি, আমিষ-নিরামিষ খাবার নিয়ে দ্বন্দ্ব— সব কিছুর সরাসরি প্রভাব পড়ে মহিলাদের উপর। সেই প্রভাব যে সমীক্ষার ফল উল্টে দিতে পারে, তার কিছু আঁচ পাওয়া গিয়েছিল ইউটিউব-নির্ভর সাংবাদিকের অনেকের বক্তব্যে। মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের বয়ানে তা খুব বেশি জায়গা পায়নি।

সংবাদমাধ্যমের এমন বিভাজন হয়তো থাকবেই। তবে বিভাজনের দুই দিকে থাকা দুই বয়ান পরস্পরের বিপরীত বা প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে পরিপূরক হয়ে ওঠুক। তা হলে তা সহায়ক হবে বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রেও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 media Post Editorial

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy