Advertisement
E-Paper

নির্বাচন, মরচে-বেল্ট আর ট্রাম্প

আমেরিকার ভারী শিল্পের এই পতনকে ‘আমেরিকার অবশিল্পায়ন’ বলে চিহ্নিত করা হয়। প্রচুর মানুষ চাকরি হারালেন। যাঁরা কর্মচ্যুত হলেন, তাঁরা মূলত আম শ্রমিক শ্রেণি।

পরন্তপ বসু

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:৩১
Share
Save

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন বিষয়ে যে ক’টি ওপিনিয়ন পোল দেখেছি, তাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কমলা হ্যারিসের জনপ্রিয়তা প্রায় সমান। প্রশ্ন ওঠে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা নিয়ে। যে ব্যক্তি চৌত্রিশটি ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাঁর প্রতি এ-হেন জনসমর্থন কেন?

এর কারণ খুঁজতে হবে আমেরিকার গত সত্তর বছরের ইতিহাসে। ১৯৫০ থেকে আমেরিকার ভারী শিল্পে মন্দা শুরু হল। যে সব প্রদেশ এই সব ভারী শিল্পে পারদর্শী ছিল, সেগুলি মূলত আমেরিকার উত্তর-পূর্ব, মধ্য-পশ্চিম আর দক্ষিণে অবস্থিত। এর মধ্যে আছে পেনসিলভেনিয়া, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের আপস্টেট নিউ ইয়র্ক অঞ্চল, ওহায়ো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ইন্ডিয়ানা, মিশিগান ইত্যাদি। এই অঞ্চলগুলির মূলতন্ত্রী ছিল ইস্পাত আর গাড়ি তৈরির শিল্প। সেই জন্যই এই প্রদেশগুলির নামকরণ হয়েছিল ইস্পাত-বেল্ট। এর পর আমেরিকার বাজারে এল জাপানি গাড়ি— ছিমছাম, তুলনায় কম-তেলে-চলা হন্ডা আর টয়োটা এসে আমেরিকার ফোর্ড আর জেনারেল মোটরস-এর বাজার দখল করতে শুরু করল। আমেরিকার ইস্পাত শিল্প বড় ধাক্কা খেল গত শতকের আশির দশকের গোড়ায়, যখন অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হল। অনেক ইস্পাত সংস্থা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করল। ইস্পাতের এই পতন মূলত জাপান থেকে সস্তায় ইস্পাত আমদানির কারণে। জাপানে শ্রমের খরচ আমেরিকা থেকে কম। ইস্পাত-বেল্ট হয়ে উঠল মরচে-বেল্ট।

আমেরিকার ভারী শিল্পের এই পতনকে ‘আমেরিকার অবশিল্পায়ন’ বলে চিহ্নিত করা হয়। প্রচুর মানুষ চাকরি হারালেন। যাঁরা কর্মচ্যুত হলেন, তাঁরা মূলত আম শ্রমিক শ্রেণি। একই সঙ্গে আমেরিকাতে অভিবাসন বাড়তে শুরু করল। আশির দশকে ভারত, চিন, ইউরোপ থেকে অনেক ছাত্রছাত্রী আমেরিকায় লেখাপড়া করতে এলেন। নব্বইয়ের দশকে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এল। অবশিল্পায়নের অন্ধকার কম্পিউটার প্রযুক্তি ঘুচিয়ে দিল। আমেরিকার জাতীয় আয়বৃদ্ধিতে এই অবশিল্পায়নের আঁচ পড়ল না। শুধু ইস্পাত-বেল্টের মানুষ কর্মহীন হলেন। বেশ কিছু মানুষ অভিবাসীদের দোষ দিলেন তাঁদের কর্মহীনতার জন্য।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মানুষদের কাছে ঈশ্বর। একটি স্বপ্ন বিক্রি করছেন তিনি একটি স্লোগানের মাধ্যমে— ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’! কী ভাবে আমেরিকা আবার কল্লোলিনী হবে? বাইরে থেকে জিনিসপত্রের আমদানিতে শুল্ক বসাও, যাতে দেশের শিল্পকে বাঁচানো যায়। অভিবাসন কমাও। মেক্সিকো থেকে বেআইনি অভিবাসন রুখতে প্রাচীর তোলো। এ কথা ঠিক যে, আমেরিকাতে ২০১৯ থেকে বেআইনি অনুপ্রবেশ বেড়েছে, জো বাইডেন বিশেষ কিছু করতে পারেননি। ট্রাম্প এই কথাটিকে বিলক্ষণ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। বলছেন, এই বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা খুনে, ধর্ষণকারী।

কিন্তু, ট্রাম্পের এই অর্থনীতি ধোপে টিকবে কি? আমদানির উপরে শুল্ক বসলে বা আমদানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করলে দেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হবেই। আমদানি করাই হয় এই কারণে যে, বিদেশি নির্মাতারা দেশি নির্মাতাদের তুলনায় সেই জিনিসটি সস্তায় উৎপাদন করেন এবং বেচেন। অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় এর নাম কমপ্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজ। আবার, আমরা যে পণ্য বিদেশে রফতানি করছি আমাদের উৎপাদন দক্ষতার জন্য, বিদেশিরা সেগুলির উপরে প্রতিশোধমূলক শুল্ক বসালে, আমাদের রফতানি শিল্পের ক্ষতি হবে। এতে দেশে কর্মহীনতা আরও বাড়বে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসে আরও অনেক জটিলতা সৃষ্টি করছে। এলন মাস্ক চালকহীন রোবট গাড়ি বানাচ্ছেন। অর্থাৎ যে আমজনতাকে কল্লোলিনী আমেরিকার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ট্রাম্প, খুব শীঘ্রই তাঁরা দেখবেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সন্তানদের ভবিষ্যৎ? অন্ধকারতর।

হ্যারিসও খুব সুচিন্তিত অর্থনীতির পথ দেখাচ্ছেন না। তাঁর স্লোগান হল, ‘অপর্চুনিটি ইকনমি’— আশ্বাস, তাঁর জমানাতে নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হবে সবার জন্য। বলছেন মধ্যবিত্তকে প্রচুর কর ছাড় দেবেন, বাড়ি কিনতে সহায়তা করবেন। কিন্তু এর জন্য যে বিপুল বাজেট ঘাটতি হবে, সেটি কী ভাবে সামলাবেন, সেই উত্তর দেননি।

আসলে আমেরিকার প্রয়োজন একটি সুচিন্তিত শিল্পনীতি এবং শিক্ষানীতি। গতানুগতিক কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খেয়ে ফেলবেই। আবার, অনেক নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক চাকরিও তৈরি হবে। এই নতুন কাজগুলি করার জন্য যে দক্ষতার দরকার, এই মুহূর্তে খুব কম সংখ্যক লোকেরই সেই দক্ষতা আছে। এর জন্য শিক্ষার জগতে আমূল সংস্কারের প্রয়োজন।

আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল শুধু ভোটের সংখ্যা থেকে নির্ধারিত হয় না। সে দেশে কয়েকটি প্রদেশের ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হতে পারে। কিছু প্রদেশ চিরকালই রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোট দেয়, কিছু প্রদেশ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। এবং, কিছু এমন প্রদেশ আছে, যেখানকার ভোটাররা যে কোনও দিকেই হেলতে পারেন। সেগুলিকে বলা হয় সুইং স্টেট বা ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট। এ রকম চার-পাঁচটি রণভূমি প্রদেশের মধ্যে তিনটি হল পেনসিলভেনিয়া, উইসকনসিন আর মিশিগান— তিনটিই কিন্তু মরচে-বেল্ট প্রদেশ। সেই ভোটের হাওয়া কোন দিকে বইবে, প্রশ্ন থাকছেই।

অর্থনীতি বিভাগ, ডারহাম ইউনিভার্সিটি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump USA President Election 2020 US President Election 2024 Kamala Harris USA

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}