Advertisement
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
আছড়ে পড়ুক প্রতিবাদের ঝড়, এগিয়ে চলুক মিছিল
R G Kar Medical College And Hospital Incident

যে বোধকে শাসক ভয় পায়

এই মুহূর্তে কলকাতার পথে পথে ‘কোরাস’, অলিতে-গলিতে বিদ্রোহ। একদিন প্রতিদিন চলচ্চিত্রের মেয়েটি ভোররাতে ঘরে ফিরেছিল। আমাদের সহনাগরিক চিকিৎসক মেয়েটির সেই সৌভাগ্য হয়নি। সে নিহত।

সম্ভাবনাময়: আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে মালদহে সাংস্কৃতিক শিল্পীদের বিক্ষোভ মিছিল।

সম্ভাবনাময়: আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে মালদহে সাংস্কৃতিক শিল্পীদের বিক্ষোভ মিছিল। ছবি: জয়ন্ত সেন।

কৌশিক সেন
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭
Share: Save:

১৯৭৯ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া এক কিশোর, একটি চমৎকার বিকেলের ফুটবল খেলা ছেড়ে, বেশ বিরক্ত হয়ে ঘামে ভেজা ইস্টবেঙ্গল জার্সিটা পরেই বিখ্যাত এক অভিনেতার হাত ধরে পৌঁছে গিয়েছিল দেশপ্রিয় পার্কের পাশে মৃণাল সেনের বাড়ি।

ওই বয়সে তার বোঝা সম্ভবই ছিল না কে ওই মানুষটি, কতটা বড়, কেমন ভাবে তিনি দেখেন এই মহাপৃথিবীটাকে। সেই বিখ্যাত অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় শুধু তাকে বলেছিল, মৃণাল সেন, একটি নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চলেছেন, যার নাম একদিন প্রতিদিন

গল্পটা জেনেছিল কিশোর, শুটিং শুরুর আগে। কলকাতা শহরে বারো ঘর এক উঠোনে বসবাস করা এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মেয়ে এক দিন বাড়ি ফিরল না। পরিবারটির নিদ্রাহীন অপেক্ষারত উৎকণ্ঠিত মুখগুলো ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে ভয়-আশঙ্কা হয়ে অভিমান-রাগ এমনকি বিরক্তিতেও। পরিবারটিকে এই ভাবে ভাসিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয়? কোথায় গেল সে? পরিবারটির চারিপাশে যে প্রতিবেশীরা, তাদের মধ্যেও রয়েছে কৌতূহল, গুঞ্জন, কানাঘুষো। অবশেষে ভোররাতে বাড়ি ফেরার পর, মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সবাই। কৌতূহল ফুরোয় না, গুঞ্জন থামে না। নিজেদের ভিতরের দীর্ণ চেহারা উন্মুক্ত হওয়ার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, কোথায়? কেন? কার সঙ্গে? না কি একা একা? কী ভাবে রাত কাটাল মেয়েটি?

মৃণাল সেন উত্তর দেননি। তাঁর মৌন যথেষ্ট বিরক্তি উৎপাদন তৈরি করেছিল বহু মানুষের ভিতর। জগদ্বিখ্যাত গুণী শিল্পীরাও মনে করেছিলেন মেয়েটি সারা রাত কোথায় ছিল, তার উত্তর দেওয়ার দায় পরিচালকের আছে। তবু মৃণাল সেন উত্তর দেননি।

পঞ্চম শ্রেণির সেই কিশোর বহু গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত পার হয়ে মধ্যপঞ্চাশে পৌঁছে সে দিন ২০২৪-এর অগস্ট মাসে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের তৈরি পদাতিক চলচ্চিত্রটি দেখল। তার মনে হল নতুন করে কিছু কিছু সময় নৈঃশব্দ্য শুধুই হিরণ্ময় নয়, কখনও কখনও তা স্তূপীকৃত বারুদের মতোই স্পর্ধিত ও সম্ভাবনাময়।

এই মুহূর্তে কলকাতার পথে পথে ‘কোরাস’, অলিতে-গলিতে বিদ্রোহ। একদিন প্রতিদিন চলচ্চিত্রের মেয়েটি ভোররাতে ঘরে ফিরেছিল। আমাদের সহনাগরিক চিকিৎসক মেয়েটির সেই সৌভাগ্য হয়নি। সে নিহত। প্রশ্নহীন থাকেননি আর জি করের সদ্য প্রাক্তন হওয়া অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, ‘মেয়েটি অত রাতে হাসপাতালে, সেমিনার হলে কী করছিল? একা একা?’ সত্যিই তো— একা-একা কর্মস্থলে রাত কাটানোর সাহস পায় কী করে একটি মেয়ে? অতএব মেয়ের ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখেও বলা হল ‘আত্মহত্যা’। এই লেখা যখন হচ্ছে, তখন রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ। মিছিল এগোচ্ছে, একশো, দু’শো, পাঁচশো, হাজার, কয়েক লক্ষ... টলমল আসন আর দুরুদুরু বুকে পশ্চিমবঙ্গে থাকা শাসক দলের সরকার নারীসুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে নির্দেশিকা জারি করেছে, ‘যতদূর সম্ভব মহিলাদের নাইট ডিউটি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে’। এই অভাবনীয় প্রস্তাবে শুধু মহিলারাই নন ‘একদিন প্রতিদিন’-এর পশ্চিমবঙ্গে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা পুরুষরাও ভয়ানক ক্রুদ্ধ। অতএব ‘কোরাস’-এ লোকসংখ্যা বাড়ছে। মিছিল এগোচ্ছে। তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা ও সাংসদ স্বমূর্তি ধারণ করেছেন। প্রতিবাদী নারীদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করছেন। থিয়েটার ও চলচ্চিত্র শিল্পীদের আক্রমণ করেছেন শ্রীরামপুরের বিজয়ী সাংসদ। বলেছেন তাঁদের প্রতিবাদ আসলে সাধারণ মানুষের রোজগার বন্ধ করে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর কৌশল। ওঁর পরামর্শ: চলচ্চিত্র, ওটিটি সব কিছুর প্রদর্শন বন্ধ হোক।

অন্য দিকে, সমাজমাধ্যমে শুধু ‘একদিন প্রতিদিন’ নয়, প্রতি মুহূর্তে বিপ্লব করে চলা বীরপুরুষরা চিহ্নিত করে দিচ্ছেন প্রতিবাদের ভাষা ঠিক কেমন হবে। তাঁদের বয়ান বা ভাবনার সঙ্গে যদি কারও মত ভিন্ন হয়, তা হলে সেটা প্রতিবাদ নয়, তাঁদের ব্যাখ্যায় ও গালিগালাজে শাসনের প্রতিচ্ছবি। সেখানে অপরের কথা শোনা বা বোঝার মতো পরিসর নেই। এটুকু বোঝার মতো স্থৈর্যও নেই যে ক্ষমতায় থাকা একটি রাজনৈতিক দল কখনওই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে এতটা ভয় পায় না, যতটা ভয় তারা নাগরিক সমাজকে পায়। কারণ, নাগরিক সমাজের স্বর কখনওই এক রকম হয় না। ভিন্নতা থাকে, বৈপরীত্য থাকে, সেটাই শাসকের ভয়ের কারণ। ভিন্ন স্বর, বৈচিত্রপূর্ণ ভাবনা ও বয়ান যখন ‘কোরাস’ হয়ে ওঠে তখন তা শাসকের কাছে ভীতিপ্রদ হতে বাধ্য। ঠিক যেমন মোহনবাগান সমর্থকের কাঁধে বসে থাকা এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের প্রতিবাদ যে চিত্র তৈরি করে, তা রাজনৈতিক, এবং তৃণমূলের কাছে চিন্তার কারণ, আর কংগ্রেস থেকে সদ্য বিজেপিতে যাওয়া এক নেতার হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাসে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মতো নীল-সাদা শাড়ি পরা এক হায়না-র চিত্রকল্প আমার ব্যাখ্যায় শুধু অরাজনৈতিক নয়, নিম্নমানের রাজনৈতিক প্রকাশ এবং তা শাসককে ভয় পাওয়ানোতে অক্ষম।

সময় এবং আদর্শগত সঙ্কট তাড়িত করত ইন্টারভিউ, কোরাস, কলকাতা ৭১, ভুবন সোম, খারিজ, চালচিত্র-র পরিচালককে। কলকাতা ২০২৪-এ অস্থির এক সময়ে মুক্তি পাওয়া ‘প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট’ মৃণাল সেনের জীবন ও কর্মে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো এক দলিল পদাতিক চলচ্চিত্রটি দেখতে দেখতে বৈচিত্রপূর্ণ প্রতিবাদের প্রয়োজন ও শক্তির কথাই বার বার মনে পড়ছিল।

শিলাদিত্য সেনের বই মৃণাল সেনের ফিল্মযাত্রা-তে উল্লেখ আছে, মৃণাল ও ঋত্বিকের নির্মাণ সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলছেন, “দে ওয়্যার মেকিং ফিল্মস ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম মাইন, ভেরি ডিফারেন্ট, বাট ভেরি পাওয়ারফুল।”

সৃজিতের ছবিতে স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে মৃণাল সেনের রাজনৈতিক ভাবনা এবং চলচ্চিত্রের ফর্ম নিয়ে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষার দৃশ্য। যে কোনও রাজনৈতিক শাসন প্রাতিষ্ঠানিকতার ছদ্মবেশ ধরে শিল্প, জীবন, এমনকি এক ব্যক্তিমানুষকেও দমনের চেষ্টা করে। আর জি করে আমাদের সহনাগরিক চিকিৎসকের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। ধর্ষণ তো বলা বাহুল্য ক্ষমতার এক কুৎসিত প্রকাশ— সে নারী, হয়তো বা সে ছিল আপসহীন, ছিল স্বতন্ত্র, ভিন্ন, অতএব তাকে দমন করো। সেখানেই শেষ নয়, দমন করার পর সত্য গোপন করো, যা পশ্চিমবঙ্গের সরকার করছে।

এর বিরুদ্ধ প্রতিবাদের ঝড় আছড়ে পড়েছে। পড়ুক। এগিয়ে চলুক মিছিল, প্রবলতর হতে থাকুক বৈচিত্রপূর্ণ প্রতিবাদের ভাষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পর দেশব্যাপী যে শোক এবং কলকাতা শহরে কবির শবদেহ ঘিরে যে আকুল শোক এবং মাত্রাহীন গণউন্মাদনা (যা কবির প্রতি সদর্থক সম্মান প্রদর্শনের সঠিক প্রকাশ নয়), তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তরুণ মৃণাল সেন। পদাতিক-এ সেই দৃশ্য বড়ই মর্মস্পর্শী। নিমতলা ঘাটের সামনে বাইশে শ্রাবণ তরুণ মৃণালের চোখ পড়ে সদ্য সন্তানহারা এক পিতার উপর। প্রবল ভিড়ের চাপ, রবীন্দ্রনাথকে শেষ বার দেখার জন্য অগণিত মানুষের আকুলতার মাঝে এক তরুণ, যে ভবিষ্যতে অন্য রকম রাস্তায় হেঁটে এক ভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র সৃষ্টির কাজে নিমগ্ন হবে, সে খুঁজে পায় মৃত্যু ও শোকের নানা স্তর। এটাই রাজনৈতিক বোধ। আমার বিশ্বাস এই বোধটাকেই যে কোনও রঙের শাসক ভয় পায়। তৃণমূল কংগ্রেস কোনও ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তাই নাগরিক সমাজের ভাষা ও ভাবনা যত দিন দলীয় রাজনীতির অনুশাসনের বাইরে থাকবে তত দিনই তাকে মান্যতা দেবে শাসক। যুক্তি ও কল্পনাশক্তি যদি থাকে, তা হলে শুধু আর জি কর হাসপাতালে অকালে চলে যাওয়া চিকিৎসক নন, তাঁর জন্য যাঁরা প্রাণ বাজি রেখে লড়ছেন, তাঁরাও সুবিচার পাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE