দেশের সুপারস্টার আটটি আফ্রিকান চিতা।
এই মুহূর্তে দেশের সুপারস্টার আটটি আফ্রিকান চিতা। তারা রাজঅতিথি। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে চিতারা নামিবিয়া থেকে বিশেষ বাহনে কুনো জাতীয় উদ্যানে এসেছে। এক্ষণে কোটি টাকার প্রশ্ন, আফ্রিকার চিতারা কি মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে টিকতে পারবে? আশাবাদীরা বলছেন, আগে এই জঙ্গলে বাঘ, সিংহ, লেপার্ড (গুলবাঘ), চিতারা এক সঙ্গে থাকত। অতএব, পরিবেশ আগেভাগেই চিতাদের জন্য প্রস্তুত। অন্য দলের মত, এই সহাবস্থানের কোনও নথি নেই। চিতাদের প্রয়োজনের তুলনায় এই জঙ্গলের চারণভূমি ছোট, এই প্রকল্প ব্যর্থ হবে। সরকারের আশ্বাস, ধাপে ধাপে ৫০টি চিতা আসবে নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। পাঁচ বছর ধরে চিতা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলবে।
মাংসাশীকে পুনর্বাসন দেওয়া কিন্তু বেশ শক্ত। তায়, চিতা ‘বিগ ক্যাট’দের একটি অদ্ভুত সম্প্রদায়। বন্য, শিকার করে, দ্রুততম স্থলচর। অথচ ধূর্ত নয়, খানিক নিরীহ, বনবাস্তুতন্ত্রের ‘অ্যাপেক্স প্রেডেটর’ বা শীর্ষ শিকারি তো নয়ই, অন্য মাংসাশীদের ‘কিলার ইনস্টিংক্ট’-এর কাছে নেহাত দুধভাত। আফ্রিকায় সিংহ, লেপার্ড, শিকারি কুকুররা চিতাশাবক ও পূূর্ণবয়স্ক চিতাকে মেরে ফেলে। চিতার ধরা শিকার কাড়তে চিতাটিকেই মেরে যায় স্পটেড হায়নারা। কিন্তু, চিতা তো দৌড়েই নিমেষে নাগালের বাইরে চলে যাবে। তবে, মারা পড়ে কেন? কারণ, শ্বাপদেরা গুটি গুটি পিছন থেকে এসে চিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চিতাও খোলা প্রান্তরে শুয়েবসে বিপদ ডেকে আনে। কুনোয় কিন্তু লেপার্ডসংখ্যা ভালই। এখানকার স্ট্রাইপড হায়না, শিয়াল, জঙ্গলের গুন্ডা ঢোলেরাও চিতাদের মারতে চাইবে। ভারতের বন্যপ্রাণের ত্রাস গ্রাম-পালানো পথকুকুর তো চিতাদের পেলে ছিঁড়ে দেবে। আরও ভয়ের কথা, রণথম্ভোরের কেঁদো বাঘগুলোও মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরের কুনোয় মাঝেসাঝেই চলে আসে। কুনো পালপুর বাঘেদের বন থেকে বনে বিচরণের প্রাকৃতিক করিডর!
মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলগুলো তো আসলে বাঘেরই বাসা। এখানে চিতাদের প্রিয় বিস্তীর্ণ সাভানাগোত্রীয় তৃণভূমি কোথায়? প্রধানত মালভূমি ঘেঁষা জঙ্গল। এবড়ো-খেবড়ো জমি, বড় গাছ, ঝোপ, পাথর। বাঘ-লেপার্ডরা যেমন চায়। চিতাদের খাওয়ার জন্য চিতল হরিণ থাকছে। তারাও লুকোতে দক্ষ। চিতারা এদের ধরতে মুশকিলে পড়বে। বন্ধুর জমিতে কতটা গতি তুলতে পারবে— সেও চিন্তার। বরং, গাজলা হরিণ, কৃষ্ণসাররা ঘেসোজমিতে চরে বেশি। তাদের খেতেই চিতাদের সুবিধা। পুনর্বাসন সফল করতে এই ধরনের হরিণও চাষের প্রয়োজন। অন্য পশুর ছানা, পাখি, বাঁদরও ধরে চিতারা। মানুষকে আক্রমণ করবে না, কিন্তু পোষা প্রাণী, হাঁস-মুরগি নিয়ে যাবে।
খাবারের নিশ্চয়তা নেই, শত্রু অঢেল। উপরন্তু, মানুষ-পশু সংঘাতের সমস্যা। সাত দশক আগে এশীয় চিতাদের দেশ থেকে বিলুপ্তির প্রধানতম কারণই ছিল মানুষের উৎপাত ও চিতাদের বাসস্থান ঘেসোজমি মুড়িয়ে দেওয়া। আজ যখন বনসঙ্কোচন আরও শতগুণে বেড়েছে, চিতারাও তখনই ফিরছে! কুনোকে জাতীয় উদ্যান করতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে, বন সম্প্রসারণ হয়েছে। বাস্তুহারা হয়েছেন সহরিয়া জনজাতির মানুষেরা। বস্তুত, কুনোয় প্রথমে গির থেকে সিংহ এনে রাখার কথা ছিল, তার জন্যই গ্রামগুলি সরানো হয়েছে। সিংহের গৌরব গুজরাত ভাগ করতে চায়নি, সে যতই একই জায়গায় থেকে সিংহেরা রোগে ভুগে মরুক গে— তাই কুনোয় সিংহ আসেনি। সিংহ প্রকল্প থেকে নজর ঘোরাতে চিতা ফেরানোর উৎসব হল কি না, সে চর্চাও চলছে।
যা-ই হোক, টিকিয়ে রাখতে হলে চিতাসংখ্যাকে এমন অঙ্কে নিয়ে যেতে হবে যেখানে প্রাকৃতিক মৃত্যু, শিশুমৃত্যু, অন্যের পেটে যাওয়ার পরও, কয়েকটি চিতা অন্তত বাঁচে। আফ্রিকাতেও ভীষণ চিতা মরে। চিতা সংরক্ষণের নানা পদ্ধতি নিয়েছে তারা। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য তাতে সহায় হয়েছে। সেটাই ভারতে অন্তরায়। আফ্রিকার কুড়িটি দেশে ত্রিশ লাখ বর্গকিলোমিটারে ছড়িয়ে আছে সাত হাজার চিতা। চিতার সবচেয়ে উপযুক্ত বাসস্থান সেরেঙ্গেটিতেও চিতাশাবকের মৃত্যুহার ৯৫%। সেখানে ৩০,০০০ বর্গকিমি এলাকায় ৩০০ চিতা পড়ে রয়েছে, তাদের জন্য রয়েছে লাখো শিকার। আর, ভারত কুনোর ৭৫০ বর্গকিমিকে ২০-২৫টা চিতার আবাসস্থল ধরে অঙ্ক এগোচ্ছে! এত ঠাসাঠাসিতে চিতার বাঁচা, থাকা, খাওয়া, প্রজনন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে অসম্ভব দেখাচ্ছে।
চিতা বাড়াতে আফ্রিকাতেও জঙ্গল থেকে জঙ্গলে চিতা স্থানান্তর চলে। এই প্রকল্পে সেখানকার বেসরকারি গেম রিজ়ার্ভগুলি খুব উপযোগী। সেখানে বেষ্টনীর মধ্যে বিশাল এলাকায় পশুদের প্রজননের ব্যবস্থা। ‘বিগ ক্যাট’-দের খাবারের বন্দোবস্ত থাকে, শিশুকাল থেকে সবাই এক সঙ্গে থেকে অভ্যস্ত। ভরা পেটে পশুদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিছুটা কম। আফ্রিকার ন্যাশনাল পার্কগুলোর সম্প্রসারণের সময় ‘গোষ্ঠী সংরক্ষণ’-এর চেষ্টা হয়। এতে মানুষদের উৎখাত হতে হয় না। তাঁরা বনের সঙ্গে মিশে গিয়ে বাঁচেন, বুনো জন্তুই তাঁদের কাছে লক্ষ্মী। গ্রামবাসীরাই সাফারি, পরিবেশ-বান্ধব অতিথিনিবাস চালান। রেঞ্জার, গার্ড, গাইড তাঁরাই। পশু-পাখির হাড়-চামড়ার পণ্য, গয়নার বেসাতি করেন। আফ্রিকার শিকারের ঐতিহ্য এই ব্যবস্থায় সহায়ক। ভারতে সে সুযোগ নেই। তবুও, কুনো বা অন্য বনের সীমানা পরিবর্ধনের আগে এলাকাবাসীদের জন্য দেশোপযোগী কোনও ‘গোষ্ঠী সংরক্ষণ’-এর উপায় কি ভাবা যায় না?
১৯৬৫-২০১০ পর্যন্ত আফ্রিকায় ৬৪টি জায়গায় অন্তত ৭২৭টি চিতার স্থানান্তর হয়েছে। বংশবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬টি জায়গায়। সহায়ক পরিবেশ থাকার পরও, আফ্রিকার এই চিতা প্রকল্পগুলি সফল হতে ১০-১৫ বছর লেগেছে। ভারতের ভাগ্যে কী আছে?
সরকার, বন্যপ্রাণপ্রেমী বা বিশেষজ্ঞরা নন। সেই উত্তর দেবে জঙ্গলের কানুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy